এপিক অ্যাক্টরসের 'নিরস্ত্র' মঞ্চায়ন

‘নিরস্ত্র’ নাটকের একটি দৃশ্য
‘নিরস্ত্র’ নাটকের একটি দৃশ্য

নিউইয়র্কের নাট্যদল ঢাকা ড্রামার আহ্বান ছিল আন্তরিক। তারা বলেছিল, নিউজার্সি ভিত্তিক নাট্যদল এপিক অ্যাক্টরস ওয়ার্কশপের নাটক ‘নিরস্ত্র’ নিউইয়র্কে মঞ্চায়ন করতে চায়। ‘নিরস্ত্র’ নিউজার্সির সাউথ এশিয়ান থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে একবার মঞ্চস্থ হয়ে দর্শক প্রশংসিত হয়েছে। সেই প্রশংসাকে পুঁজি করে তারা থিয়েটারের সৎ প্রয়াসকে বাংলাদেশি জনসমাজের কাছে হাজির করতে চায়।
ঢাকা ড্রামা কয়েক বছর ধরে নিউইয়র্কের নাট্য প্রয়াসী দল। বাংলাদেশি জনসমাজের নিউইয়র্কবাসী কয়েকজন নিবেদিত নাট্যকর্মীর সংগঠন এটি। তাঁরা চান ভালো নাটক ভালোভাবে করতে। অতিক্রম করতে নিউইয়র্কের বাংলাদেশি জনসমাজের সব সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতাকে। তাদের সেই অঙ্গীকারেরই বাস্তবায়ন ‘নিরস্ত্র’; মহাশ্বেতা দেবীর দুটি গল্পের একীভূত নাট্যরূপ। দুটি গল্পের ভিন্ন বক্তব্যকে এক আঁধারে আনার যৌথ প্রয়াসে প্রয়াসী হয়েছেন অভিজ্ঞ নাট্যকর্মী অভিনেতা কণ্ঠশিল্পী ও নাট্যনির্দেশক গোলাম সারওয়ার হারুন এবং অভিনয়শিল্পী গার্গী মুখোপাধ্যায়। দুটি ভিন্ন বক্তব্যকে এক নাটকের আঁধারে কতটা আনা গেছে সে প্রশ্নের চেয়ে মঞ্চায়নের পরে এর সামগ্রিক প্রযোজনা যে উপস্থিত দর্শকদের সমাদর পেয়েছে তা দর্শকদের মুখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বোঝা গেছে।
সকলেরই জানা আছে যে নিউইয়র্ক নাট্যমঞ্চের নগরী। মঞ্চরূপের চোখধাঁধানো পরিবেশনার জন্য এখানকার ব্রডওয়ের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। শিল্পসৃষ্টির প্রয়াসী থিয়েটারের জন্য এখানে রয়েছে অফ ব্রডওয়ে, অফ অফ ব্রডওয়ে! কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশি জনসমাজের কোনো সম্পর্কই প্রায় নেই। অথচ আমাদের বাংলাদেশের থিয়েটারকর্মীদের অনেকেই তো নিউইয়র্কবাসী। তাঁদের নাট্য স্বপ্নও নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যায়নি। গোলাম সারওয়ার হারুনও তাঁদের মতো একজন।
কিন্তু নিউইয়র্কে বাঙালি সমাজে ভালো নাটক ভালোভাবে করার ব্যাপারে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তা ছাড়া পৃষ্ঠপোষক-ভিক্ষা করে যেভাবে অর্ধ হৃদয় দিয়ে নাট্য মঞ্চায়ন হয় তাতে আর যাই হোক সৎ থিয়েটার হওয়া সম্ভব নয়। খাঁটি থিয়েটার নিয়ে দর্শকদের সামনে না গেলে দর্শকেরা মিলনায়তনে এলেও রসিক সত্তা নিয়ে নাটক দেখবে কেন! রসিক দর্শক না পেলে তাদের সশরীর হাজিরা থিয়েটারে প্রতি করুণা বৈ ভিন্ন মনে হবে না। করুণা আকর্ষণ করে বড় কাজ হয় না। এই উপলব্ধি ঢাকা ড্রামার নাট্যকর্মীদের হয়েছে। তাঁরা এখন স্বপ্ন দেখছেন নিউইয়র্ক মহানগরীর থিয়েটারি ঐতিহ্যের অনুসরণে এখানে বাংলা নাটক করবেন। অথবা বাংলাদেশের নাটক করবেন ইংরেজি ভাষায়।
গেল আগস্ট মাসে নিউজার্সির পেশাদারি মঞ্চে সাউথ এশিয়ান থিয়েটার ফেস্টিভ্যালে মহাশ্বেতা দেবীর ‘দ্রৌপদী’ এবং অন্যান্য গল্প থেকে উপাদান নিয়ে রূপায়িত গার্গী মুখার্জি এবং গোলাম সারওয়ার হারুনের পরিচালনায় এপিক অ্যাক্টরস ওয়ার্কশপের পরিবেশনায় নাটক ‘নিরস্ত্র’ দেখে খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম। একই সঙ্গে মনও খারাপ হয়েছিল এটা ভেবে যে এমন একটা থিয়েটারি প্রয়াস মাত্র একবারের মঞ্চায়নেই নিঃশেষিত হবে? না তা যে হবে না তার আভাস আমরা দেখতে পেলাম ১৪ই অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় জ্যামাইকা পারফর্মিং আর্টস সেন্টারে।
ঢাকা ড্রামার আয়োজনে দর্শনীর বিনিময়ে আবারও মঞ্চস্থ হলো এপিক অ্যাক্টরস ওয়ার্কশপের পরিবেশনায় ‘নিরস্ত্র’ নাটকটি। হলের সবগুলো আসন পূর্ণ না হলেও তিন চতুর্থাংশ ছিল পূর্ণ। নাটক শুরু হওয়ার পর পিনপতন নিস্তব্ধতা! পুরো সত্তর মিনিট জুড়ে নৈশব্দই বলে দেয় এপিক অ্যাক্টরস ওয়ার্কশপের থিয়েটারীয় প্রয়াস সফল হয়েছে। প্রদর্শনীটির শেষে দর্শকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ঢাকা ড্রামার পক্ষ থেকে বলা হলো এই প্রদর্শনীর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নিউইয়র্কের বাংলাভাষী রসিক নাট্য দর্শকেরা। তাঁরা আশা করেন এখানেও বাংলাদেশের নাটক হবে দর্শনীর বিনিময়ে। নিউইয়র্কেও বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটারের মতো নাট্যদলগুলো নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন করবে। একজন দুজন পৃষ্ঠপোষকের দয়ায় নয়, রসিক দর্শকের নাট্য তৃষ্ণার পৃষ্ঠপোষকতায় উজ্জীবিত হবে নিউইয়র্কের বাংলাদেশি জনসমাজের নাটক।
এপিক অ্যাক্টরস ওয়ার্কশপের ‘নিরস্ত্র’ বেশ সাহসী প্রযোজনা। গার্গী মুখোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন প্রাণ ঢেলে ও তাঁর পেশাদারি সামর্থ্য দিয়ে। গোলাম সারওয়ার হারুনের অভিনয়ে ও নির্দেশনায় আন্তরিক প্রয়াস ও দলের সবার নিবেদন উপস্থিত দর্শকদের এই বার্তা দিয়েছে যে তাঁদের নাট্যপ্রয়াস সৎ ও আন্তরিক। এ রকম একটি প্রযোজনার সাফল্য অর্জন যে কতটা দুঃসাধ্য তা অনুভব করলে স্বীকার করতেই হবে নাটকটির শেষ দৃশ্যের গণধর্ষণকে মঞ্চে দৃশ্য হিসেবে উপস্থাপনে যথেষ্ট দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছেন কুশীলবেরা। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রেও গার্গীর সাফল্যের কথা আলাদা করে বলতে হবে।
‘নিরস্ত্র’ নাটকটি অতীতের একটা সময়ের ঘটনাকে অবলম্বন করে রচিত হলেও এর জীবনদৃষ্টি বর্তমান কালের। নাটকটিকে দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক থেকে নারীবাদী যেমন বলা যায় তেমনি বলা যায় চিরকালীন মানবিকতার নাটকও। তবে কেবল নারীবাদ আর মানবতা বেচলে তো হবে না, থিয়েটারও হতে হবে। রসিক দর্শকদের কাছে এর কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি হয়তো ধরা পড়বে। সব মিলিয়ে নাটকে বিষয় ও কালের ঐক্যে ফাটলও হয়তো কারও কারও মনে প্রশ্ন তুলবে। কিন্তু ‘নিরস্ত্র’যে আন্তরিকভাবে একটা ভালো থিয়েটারই হতে চেয়েছে সে ব্যাপারে দর্শকেরা নিশ্চয়ই একমত হয়েছেন। কারণ প্রদর্শনী-উত্তর দর্শকদের শরীরের ভাষা বলে দিচ্ছিল যে টিকিট কেটে এই নাটক দেখে তাঁরা খুশি হয়েছেন। সুতরাং এই কথা আমরা বলতেই পারি যে ‘নিরস্ত্র’ নাটকের মধ্য দিয়ে নিউইয়র্কে দর্শনীর বিনিময়ে নিয়মিত বাংলাদেশি নাট্য মঞ্চায়নের সূচনা হয়ে গেল। সেই সঙ্গে এই স্বপ্নও জাগিয়ে দিল যে একদিন ব্রডওয়ে বা ব্রডওয়েতর বাংলাদেশি নাটকের নবধারা সূচিত হবে নিউইয়র্কের বাংলাদেশি জনসমাজে।