কথার বোমা বনাম প্যাকেট বোমা

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি
ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয় সময় গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১০টি প্যাকেট বোমার খোঁজ পাওয়া গেছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, অভিনেতা রবার্ট ডি নিরো থেকে শুরু করে গত চার দিনে বেশ কয়েকজনের কাছে এসব বোমা পাঠানো হয়েছে। যাঁদের বোমার প্যাকেট পাঠানো হয়েছে, তাঁরা সবাই ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা বা সমর্থক।

সিএনএনের নিউইয়র্ক অফিসে একটি প্যাকেট গেছে। যাঁরা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর সমালোচক, তাঁদের কাছেই এ ধরনের বোমার প্যাকেট গেছে। ঘরে বানানো ও তুলনামূলকভাবে কম কার্যকর এসব বোমা পাইপবোমা নামে পরিচিত। এ বোমাগুলো ডাকযোগে পাঠানো হয়। তবে বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই নিরাপত্তাকর্মীরা এই বোমাগুলো শনাক্ত করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহলে এসব বোমা কে পাঠাল, কেন পাঠাল, তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলছে। উদারনৈতিক হিসেবে পরিচিত ভাষ্যকারেরা খোলামেলাভাবেই আঙুল তুলেছেন ট্রাম্পের দিকে। তিনি দিনের পর দিন তাঁর বিরোধী পক্ষ, বিশেষত মূলধারাভুক্ত দেশের প্রধান পত্রপত্রিকার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন। এতে দেশে অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। সাংবাদিক ও বিরোধী ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে ট্রাম্প নিজের সমর্থকদের লেলিয়ে দিয়েছেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক দক্ষিণপন্থী ওয়েবসাইট ও ভাষ্যকারেরা কোনো প্রমাণ ছাড়াই দাবি করছেন, এর পেছনে ডেমোক্র্যাটরা রয়েছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে দেশজুড়ে ট্রাম্পের পক্ষে একটি হাওয়া উঠেছে। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কয়েক হাজার মানুষের যে ক্যারাভান আসছে, ট্রাম্প সে কথা উল্লেখ করে নিজের সমর্থকদের ভোটের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করছেন। সেদিক থেকে নজর ফেরাতে ডেমোক্র্যাটরা নিজেরাই এখন ঘরে ঘরে বোমা পাঠাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এফবিআই) এই বোমা কে পাঠিয়েছে, তা উদ্ধার করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আগে শোনা গেছে, বোমাগুলো যে প্যাকেটে করে পাঠানো হয়, তা হাতে হাতে বিলি করা হয়। এখন জানা গেছে, সে কথা ঠিক নয়। সব প্যাকেটই ডাক বিভাগ মারফত বিলি করা হয়। জানা গেছে, ফ্লোরিডার এক বা একাধিক ডাকঘর থেকে প্যাকেটগুলো পাঠানো হয়। প্রতিটি বোমায় ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদান নিয়ে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞেরা কাজ শুরু করেছেন। তাঁদের ধারণা, এই পরীক্ষার পর কে বা কারা এসব পাঠিয়েছে, তা নির্ণয় করা অসম্ভব হবে না।

বোমা কে পাঠিয়েছে, তা খুঁজে বের করার আগে যতটা নির্বাচনী ফায়দা আদায় করা সম্ভব, সে চেষ্টায় দুপক্ষই সমানভাবে মাঠে নেমেছে। ট্রাম্পের হাতে প্রেসিডেন্টের মেগা ফোন রয়েছে। তিনি স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কথায় ও কাজে মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছেন। ভাবা হয়েছিল, এমন একটা সংকটের সময় তিনি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানাবেন। গত বুধবার তাঁর প্রথম বিবৃতিতে তেমন একটা আভাস মিলেছিল। কিন্তু সন্ধ্যা হতে না–হতেই তাঁর গলার আওয়াজ বদলে গেল। সেদিন সন্ধ্যায় এক নির্বাচনী জনসভায় অসহিষ্ণুতার জন্য তিনি দোষ চাপালেন তথ্যমাধ্যমের ওপর। পরের দিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার এক প্রভাতী টুইটে অভিযোগ আরও স্পষ্ট করে ট্রাম্প বলেন, সারা দেশের মানুষের মধ্যে যে ক্রোধের মনোভাব কাজ করছে তার পেছনে রয়েছে তথ্যমাধ্যমের মিথ্যাচার ও রোষ।

একাধিক সূত্র বলছে, বোমাবাজির জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে শুনতে পেয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অত্যন্ত রুষ্ট হয়েছেন। তাঁর উপদেষ্টাদের জানিয়েছেন, তথ্যমাধ্যমের সমালোচনা অথবা প্রতিপক্ষের প্রতি কটাক্ষ তিনি বন্ধ করবেন না। নির্বাচনের আগে আগে উত্তেজক কথাবার্তা অব্যাহত রাখবেন।

বেশির ভাগ ভাষ্যকার বলছেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে যে চূড়ান্ত অসহিষ্ণুতা বিদ্যমান, তার জন্য দুই প্রধান দলের নেতারাই কমবেশি দায়ী। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই অসহিষ্ণুতাকে অশিষ্টাচারে পরিণত করেছেন। সিএনএন বা ‘নিউইয়র্ক টাইমস’–এর মতো মাধ্যমকে ট্রাম্প বরাবরই ‘গণশত্রু’ নামে অভিহিত করেছেন। প্রতিটি নির্বাচনী সভায় তিনি সাংবাদিকদের দিকে আঙুল তুলে বলতে ভালোবাসেন, ‘এই যে এরা যারা সামনে বসে আছে, এরা সবাই মিথ্যাবাদী, ফেইক নিউজ।’

মন্টানার এক কংগ্রেসম্যান একজন সাংবাদিকের গায়ে হাত তুলেছিলেন। সে কথা উল্লেখ করে ট্রাম্প তাঁকে নিজের পছন্দের মানুষ বলে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তাঁর প্রতিটি নির্বাচনী সভায় হিলারি ক্লিনটনকে ‘জেলে ঢোকাও’ এই স্লোগান দেওয়া হয়। ট্রাম্প তাঁর সমর্থকদের শান্ত করার বদলে এই স্লোগান দিতে উৎসাহিত করে থাকেন।

‘নিউইয়র্ক টাইমস’–এর কলাম লেখক চার্লস ব্লো বলেছেন, এখন যে পরিস্থিতি হয়েছে, সে জন্য ট্রাম্প দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। যে ১০ জনের কাছে প্যাকেট বোমা পাঠানো হয়েছে, ট্রাম্প তাঁদের প্রত্যেকের নাম নিয়ে আক্রমণ করেছেন। তাঁর সব আক্রমণের প্রধান অস্ত্র দুটি। মিথ্যা ও ভীতি।

চার্লস ব্লো বলেছেন, ট্রাম্পের নির্দেশেই যে এই বোমাগুলো পাঠানো হয়েছে, সে কথার কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু ট্রাম্প যেভাবে নিজের রাজনৈতিক বিরোধীদের ব্যাপারে ভীতি ও ঘৃণা ছড়াচ্ছেন, তাতে যে এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে, সে ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই।

মধ্যবর্তী নির্বাচনের এখনো ১০ দিন বাকি। আগামী দিনগুলোতে সম্ভবত প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের মধ্যে কথার যুদ্ধ আরও বাড়বে। অনেকেই ভয় পাচ্ছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে সামাল না দিলে এ কথার যুদ্ধ সত্যি সত্যি বোমার যুদ্ধে পরিণত হতে পারে।