মন ভালো করে দেওয়া টেবল রকে

পড়ন্ত বিকেলে এমন সোনালি রোদ গায়ে মাখিয়ে ওপরে উঠতে হবে
পড়ন্ত বিকেলে এমন সোনালি রোদ গায়ে মাখিয়ে ওপরে উঠতে হবে

তখন সবেমাত্র আমেরিকায় এসেছি পড়াশোনা করতে, আইডাহোর বয়েসি শহরে। আসার পর থেকেই বাসায় বন্দী। গাড়ি ছাড়া বাজারেও যাওয়া যাচ্ছে না। কোন জায়গা থেকে কীভাবে বাসে উঠব, সেটাও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারছি না। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা গ্রুপ যাবে হাইকিং করতে। যাওয়া-আসা সব ওরাই ব্যবস্থা করবে, রাজি হয়ে গেলাম। প্রায় ২৫ জনের একটা বড়সড় দল হলো। সবাই ভিনদেশি শিক্ষার্থী। এর মধ্যে আমরা বাংলাদেশি ছিলাম তিনজন। সবাই নতুন এসেছি। গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছে স্থানীয় এক আমেরিকান, স্টিভ ডান। বিদেশি শিক্ষার্থীদের নতুন দেশ ও পরিবেশে মানিয়ে নিয়ে সবার সঙ্গে মেশার সুযোগ করে দিতেই এই উদ্যোগ। আমাদের গন্তব্যস্থল টেবল রক। এই পাহাড়চূড়ার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ৬৫০ ফুট। যার ওপর থেকে পুরো বয়েসি শহরটাই দেখা যাবে।
আমাদের দেশে সন্ধ্যা নামে সর্বোচ্চ ৭টায়, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি সন্ধ্যা নামে রাত ৯টায়। তাই বিকেল বলতে আসলে বোঝায় ৭টার পর! বয়েসি স্টেট ইউনিভার্সিটির মূল ক্যাম্পাস থেকে টেবল রক গাড়িতে ২৫ মিনিটের দূরত্বে। এখানকার একটা চমৎকার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যত দুর্গম এলাকাতেই আপনি যান না কেন, খুব সুন্দর শৌচাগার ব্যবস্থা পাবেন—যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে পাহাড়ের গোড়ায় গাড়ি পার্ক করে সবাই রওনা হলাম। সরু সর্পিলাকার পাথুরে পথ দিয়ে শুরু হলো আমাদের হাঁটা। প্রথমেই পরিচয় হলো একদল নেপালি শিক্ষার্থীর সঙ্গে। একে তো এশিয়ান, তার ওপর দেখতেও আমাদের মতো অনেকটা। তাই খাতির জমতে বেশি সময় লাগল না। এদের সঙ্গে পরে আরও অনেক জায়গায় ঘুরতে গেছি, এমনকি ক্রিকেটও খেলেছি। এরপর পরিচয় হলো আফগান ও মেক্সিকান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। গল্প করতে করতে ওপরে উঠতে গিয়ে এক সময় পিছিয়ে পড়লাম। এটাই ছিল আমার প্রথম হাইকিং। এ ছাড়া ভিনদেশিদের তুলনায় ফিটনেসে আমি যথেষ্ট পিছিয়ে। তারপরও বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, বিরতি নিয়ে ছবি তুলে এগিয়ে যেতে থাকলাম।
একদম পাহাড়ের চূড়ায় একটা ক্রস চিহ্ন আছে, যা বয়েসি শহর থেকেই দেখা যায়। এমনকি রাতের বেলায়ও ক্রসের গায়ে লাইট লাগানো থাকায় ক্রসটি চোখে পড়বে অনেক দূর থেকেও। অধিকাংশ অভিযাত্রী সেই ক্রসের কাছে পৌঁছে গেল ৩০ মিনিটের মধ্যে। আমরা পৌঁছালাম সবার শেষে, আমাদের লাগল প্রায় ৪৫ মিনিট। ভাগ্যিস স্টিভের কথা শুনে আসার সময় পানিভর্তি বোতল নিয়ে এসেছিলাম! পাহাড় চূড়ায় উঠে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পুরো শহরটা চোখের সামনে। বিস্ময়ের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর বুঝতে পারলাম আমি অনেক ক্ষুধার্ত। স্টিভ আমাদের জন্য নিজ বাসায় বানানো আমেরিকান চকলেট কুকিজ নিয়ে এসেছে! ব্যাপক আগ্রহ ছিল এই কুকিজ নিয়ে। মুখে নিয়ে বুঝলাম স্বাদ আসলেই খুব ভালো। পরে অবশ্য এক সময় এই জিনিস খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে গেছি। তবে এক ছেলে কোকের ক্যান পাহাড়ের ওপর থেকে নিচে ফেলে দিল। স্টিভ তাকে আচ্ছা করে ভৎসনা করল! স্টিভের সঙ্গে আমি এরপর আরও অনেকবার ঘুরতে গেলেও সেটাই প্রথম ও শেষ আমি স্টিভকে রাগতে দেখেছি। আমেরিকানরা কখনই ডাস্টবিন ছাড়া ময়লা ফেলে না।
সুবিশাল সমুদ্র আর পাহাড়ের চূড়া, এই দুটোর সৌন্দর্যই আলাদা। কিন্তু এরা আমাকে বিষণ্ন করে তোলে। মনে হয় এই বিশালতার মাঝখানে আমি খুবই ক্ষুদ্র! সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই বিশাল এই লালচে আকাশে অনেক দূরে একটা উড়োজাহাজ অবতরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য। অন্ধকার হওয়ার আগেই আমরা নামতে শুরু করলাম। অনেক নিচে বাড়িগুলোতে বাতি জ্বলতে শুরু করেছে। পুরো শহরটা এখন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। নিচে নামতে নামতে কথা হচ্ছিল মেক্সিকান আন্দ্রেয়ার সঙ্গে। বাংলাদেশ কোথায়, কী বিষয়ে পিএইচডি করতে এসেছি, এমন হাজারো প্রশ্ন। দেশ থেকে আসার সময় আমরা শৌচাগারে ব্যবহারের জন্য বদনা নিয়ে এসেছি, এটা আন্দ্রেয়াকে ব্যাপক অভিভূত করল! সে বদনা দেখার জন্য আমার বন্ধুর বাসায় যেতে আগ্রহী। মেক্সিকানরা স্পাইস পছন্দ করে, তাই আমাদেরও বলল, ওর বাসায় রান্না করে খাওয়াবে। তবে একটা কথা না বললেই নয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুক্ত আমাদের যে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে এবং ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমহানি হয়েছে—এটা কত বিশাল একটা সংখ্যা এবং মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এই তথ্যগুলো আন্দ্রেয়াকে সবচেয়ে বেশি বিমোহিত করেছে। বাংলাদেশ থেকে দেড় গুণ বড় আইডাহো অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা মাত্র ১৭ লাখ।
সেদিন সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এলেও, পরেরবার টেবল রক গিয়েছি গভীর রাতে। রাত ১২টা বাজে প্রায় ২৫ জনের একটা দল, সবাই বাঙালি। যে কেউ বয়েসিতে নতুন আসলে তাকে প্রথমেই টেবল রকে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০১৭ সালের ফল সেমিস্টারে বয়েসিতে আমরা নতুন শিক্ষার্থী এসেছিলাম ১২ জন। পুরোনো শিক্ষার্থীরা হুট করে প্ল্যান করে সবাইকে ৫-৬টা গাড়িতে করে নিয়ে এল টেবল রকের রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। প্রায় ২ ঘণ্টা সময়, নয়ন জুড়ানো দৃশ্যের পাশাপাশি চলল গান ও আড্ডা। কেউবা পাহাড়ের শেষ সীমানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে, কেউবা শহুরে আলো দূষণমুক্ত পরিষ্কার আকাশে অসংখ্য তারা গুনতে পাথরের ওপর শুয়ে আছে...
শেষবার টেবল রক গিয়েছি আমার চীনা রুমমেট ইবোর জন্মদিন পালন করতে। সে সময় পাহাড়ে ওঠার রাস্তার কাজ চলছে বলে বিকেল ৭টার পর গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যবশত সেই নোটিশ আমাদের চোখে পড়েনি। রাত ৯টার পর আমরা যখন ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছি, দেখি পার্কিং লটে একটি গাড়িও নেই। শুধু আমরাই আছি, কেমন যেন একটা অনুভূতি! বিপদ হলো, একটু নিচে নেমে দেখি গেট বন্ধ এবং লক করা। গাড়ি নিয়ে আটকা পড়ে গেলাম। এবার নোটিশ চোখে পড়ল এবং শাস্তি হচ্ছে জরিমানা অথবা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে পুলিশ এসে গাড়ি নিয়ে যাবে। চিন্তায় পড়ে গেলাম। টেবল রক কর্তৃপক্ষকে ফোন দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না আমাদের সামনে। এক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর অবশেষে সিকিউরিটি অফিসার এসে গেট খুলে দিল বিনা বাধায়। সেদিন বড় হাফ ছেড়ে বেঁচেছি।
যাই হোক, সারা দিন পড়াশোনা কিংবা গ্র্যাজুয়েট অফিসে কাজ করে ক্লান্ত? কিংবা প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে খুব মন খারাপ? অথবা বন্ধুর জন্মদিন? সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত কিংবা গভীর রাত, টেবল রক আছে আমাদের মন ভালো করে দেওয়ার জন্য।