তারা বিবির যত মৃত স্বপ্ন

জন্মের পর প্রথম নামকরণ ছিল তারা। তারা জানে না তার জন্মকে ঘিরে দরিদ্র পিতার একটিমাত্র মাটির ঘরের সংসারে সেদিন গরিবদের মতো করেও কোনো আনন্দ হয়েছিল কিনা! শুধু নিশ্চিত করে জানে জন্মের সংবাদ পেয়ে তার বাবাকে আজান দিতে হয়নি। মেয়ে সন্তানের কানে জন্মের পর আজানের ধ্বনি শোনাতে হয় না। অবশ্য সে জানেই না তার অশিক্ষিত খেতমজুর বাবা আজান দিতে জানে কিনা! বড় হয়ে মা চাচিদের কাছে শুনে জেনেছে প্রথমে তার দাদি তার মুখ দেখে খুশিতে বলে উঠেছিল, ‘মুখখান এক্করে ফটফটা তারার লাহান, আমি অর নাম দিলাম তারা।’ পরে চাচি ও পড়শিরাও দাদির কথায় সায় দিয়েছিল। সেই থেকে সে তারা হয়েই ফুটে রইল মাটির কুটিরে।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া মেয়েটি শখের জিনিস, ভালো খাবার কিছুই তেমন না পেলেও মায়ের স্নেহ, বাপের আদর কম কিছু পায়নি। বাপের সামর্থ্য ছিল না, তাই গ্রামের অবৈতনিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শেষ পাঠ দিয়ে আর এগোতে পারেনি। পড়ালেখা করে বড় হবার স্বপ্ন সেদিনই মরেছিল। ঘরেই থাকে। মায়ের কাজে সাহায্য করে। দুটি ছাগল আর একপাল বাচ্চাসহ একটা মা-মুরগি আর গোটা তিনেক ডেকি মুরগি আছে তাদের, ছোট ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সেগুলোর দেখভাল করে দিন কেটে যায়। বাদ মাগরিব সাঁঝবেলায় কুপির বাতির আলোয় মক্তবে হুজুরের কাছে শেখা আমপারার সুরা সুর করে পড়ে।
বাবা এসে হাতমুখ ধুয়ে দাওয়ায় বসলে মা ভাতের পাত বাড়ে। মাছ, গোশত কালেভদ্রের ব্যাপার। মোটা চালের ভাত, খেসারির ডাল বা মাস কলাই, মধ্যে মিশালে মসুর আর শাক পাতা কি আলু কি বেগুন সেদ্ধ। কাঁটা বাছতে হয় না, হাড়ের খোঁচা খাওয়ার ভয় নেই, কুপির আগুন আলোয় খাওয়ার পাট সারা হয়ে যায়। মা ধোয়া-মোছা সেরে কুপি নিয়ে ঘরে আসে। তারপর কুপি নিভিয়ে সবাই ঘুমের রাজ্যে। দাদি বেঁচে থাকতে আগে প্রতি রাতে রাজা-রানির গল্প বলত। রাজপুত্রের কথা এলেই দাদি আনন্দে কলবল করে হেসে বলত, ‘তারা, দেখিস তোকেও একদিন এক রাজপুত্তুর এসে তোর বাবার কাছে চেয়ে সোনা, মণি-মাণিক্যের গয়নায় সাজিয়ে নিয়ে যাবে।’
তারা লজ্জা পেয়ে যেত। মুখে বলত, ‘দাদি, তুমি যে কী কও; রাজপুত্তুরের ঠ্যাকা পড়ছে যে, সে রাজকন্যা থুইয়া গরিব চাষার মাইয়ারে বিয়া করব।’ দাদি আবার খুশির ভাব নিয়ে নাতনির কপাল মুখে হাত বুলিয়ে বলত, ‘করব, করব, অমন আকছার হয়। গরিবের দুঃখে কষ্ট পাইয়া, গরিবের মাইয়ার রূপে মুগ্ধ হইয়া, তারে বিয়া কইরা রাজরানি বানায়।’ দাদির সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক করলেও মনে মনে খুশি হয় তারা। ঘুমের মধ্যে খোয়াব দেখে, সে রাজরানি হয়েছে। দাদি মারা যাওয়ার পর মা মাঝে মাঝে গল্প বলে। কোনো কোনো দিন আবার গল্প-গুজব হয় না। মা বাবার সঙ্গে কথা বলে। বাবাও দাদির মতো বিশ্বাস করে কোনো এক ধনীর শিক্ষিত দুলাল তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করে সুখে রাখবে। বাবার শুধু দুশ্চিন্তা বিয়ের খরচ নিয়ে।
বয়সটা পনেরো পেরিয়ে ষোলোতে যেতেই কাবিননামায় আঠারো লিখে তারাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো এবং তারা সেই প্রথম ‘তারা বিবি’ নামে নিবন্ধিত হলো। রাজপুত্র না হলেও ছেলে সুপাত্র। ম্যাট্রিক পাস। স্থানীয় স্কুলে পিয়নের চাকরি করে।
ছেলের বাবা কিছুই দাবি করেনি। শুধু মেয়ে জামাইকে গরিবি হালে সাজিয়ে দিতেই তারা বিবির বাবার বসতবাড়ির ভিটেটুকু ছাড়া একমাত্র সম্বল সাত কাঠার ধানি জমিটা বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। বরপক্ষের লোক খাওয়াতে ঘরের ছাগল দুটিও জবাই দিতে হয়েছিল। তারার বাবা সুপাত্রের হাতে তারাকে দিতে পেরেছে মনে করে খুশি। ছোট ভাইটি দুলাভাই পেয়ে মহা আনন্দে।
শ্বশুরবাড়ি এসে প্রথম প্রথম তারা বিবি বেশ একটা ধাক্কা খেয়েছিল। বুঝে নিয়েছিল ঘটকরা বিয়ে লাগিয়ে দিয়ে কিছু আয়ের আশায় এ রকম অনেক মিথ্যা বলে। আর তা ছাড়া তার বাবারই বা এমন কী আছে? বরং চাইলে এ ছেলে আরও ভালো ঘরে বিয়ে করতে পারত। কিছুদিনেই তারা সত্যিকারের তারাবিবি হয়ে সংসারটাকে গুছিয়ে নিল। স্বামী ফজলুর রহমান খুব ভালো মানুষ। ভাব ভালোবাসা হতে সময় লাগেনি। বছর ঘুরতেই তারাবিবি বেশ অনেক দিনের জন্য বাপের বাড়ি গিয়েছিল প্রথম সন্তান জন্ম দিতে। ফজলু ফি হপ্তায় এসে দেখে যেত। সঙ্গে কত কিছু আনতো। তারার লজ্জা করত। পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার চল্লিশ দিন পর সে শ্বশুর বাড়ি ফিরে আসে। শ্বশুর-শাশুড়ি নাতি পেয়ে মহা খুশি। ফজলু তাদের একমাত্র সন্তান। তারাবিবিকে তারা খুব যত্ন করত এবং ভালোবাসত। আকিকা দিয়ে নাতির নাম রাখল তাওহীদ রহমান। তাওহীদ মা-বাবা, দাদা-দাদির কোলে কোলে বড় হতে থাকে। দু বছর পর তারাবিবির কোল আলো করে ফুটফুটে চাঁদনি আসে। এবার মার বাড়িতে যাওয়া হয়নি। চাঁদনির নানা-নানি-মামা দেখতে আসে। দাদা-দাদি, নানা-নানি চাঁদনির রূপে মুগ্ধ।
সবাই খুশি। এক ছেলে, এক মেয়ে। তারাবিবি ও ফজলুর রহমান আল্লাহ্পাকের শুকরিয়া আদায় করে।
সচ্ছলতা তেমন ছিল না। বলতে গেলে টানাটানির সংসার। তবুও দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল সহজ স্বচ্ছন্দে। হঠাৎ ছন্দ পতন ঘটল। তারা বিবির শাশুড়ি মারা গেল পাঁচ দিন জ্বরে ভুগে। সবাই কতক দিন বিমর্ষ হয়ে থাকল। তারপর আবার সব সহজ স্বাভাবিক। শ্বশুর স্ত্রীকে ছাড়া, ফজলুর মাকে ছাড়া, তারা শাশুড়িকে ছাড়া অভ্যস্ত হয়ে গেল জীবন যাপনে। কিন্তু ছন্দ পতন ঘটল। দেশে কি যেন হতে যাচ্ছে। শোনা গেল দেশে যুদ্ধ হবে। ফজলুর বাসায় ফিরতে প্রতি দিন রাত হয়। জিজ্ঞেস করলে খোলাসা করে কিছু বলে না। শোনা যায় স্কুলের মাঠে বলে কি যুদ্ধের ট্রেনিং হয়। ট্রেনিং শেষে হেড স্যারের বাড়িতে মিটিং হয়।
এরপর সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষকে দলে দলে গুলি করে হত্যা করতে শুরু করে। স্কুল মাঠে যারা ট্রেনিং নিচ্ছিল, তারা সকলেই বর্ডার ক্রস করে ভারতে গেল। মুক্তিযুদ্ধে নাম লিখে, ট্রেনিং নিয়ে তারা দেশে ফিরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। দেশকে শত্রুমুক্ত করবে; দেশটা নিজের হবে। তারা সব খেয়ে-পরে সুখে থাকবে। এমনি করেই সে তারাবিবিকে বুঝিয়েছিল। এও বলেছিল দেশ ও দেশের মানুষের এই বিপদের সময় দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া ধর্মেরই কাজ। ছেলে-মেয়ে দুটি ঘুমে। পাশের ঘরে শ্বশুর আব্বা নাক ডাকছেন। তারা বাবার কাছে অনুমতি নিতে বলেছিল। ফজলু কোনো জবাব না দিয়ে দ্রুত ঘর ছেড়েছিল কান্না গোপন করে। সেই শেষ। মানুষটার সঙ্গে এ জনমে আর দেখা হলো না। পর দিন শ্বশুর আব্বা খুব ঝামেলা করেছিল। তারাবিবি কয়েক দিন কেঁদে কেঁদে চুপ হয়ে গেছে। ছেলে মেয়ে রাতদিন কেবল বাবা বাবা করেছে! সপ্তা দুই বাদে বাবা এল, তাদের কাছে নিয়ে যেতে। শ্বশুরের কথা ভেবে যেতে চায়নি। শেষে শ্বশুরই বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে।
সপ্তাহ দু-এক সময় পার হয়েছে। মা-বাবা, ভাই-বোন, সবাই মিলে আনন্দে সময় রেলগাড়ির চাকার মতো গড়গড়িয়ে পার হওয়ার কথা। হচ্ছে না। খুব কষ্টে-সৃষ্টে ধাক্কা দিয়ে দিনগুলো কাটছে। রাতগুলো পাথরের মতো চেপে বসে। বারবার ঘুম ভেঙে যায়। খোয়াব দেখে তাওহিদের বাবা এসে দাঁড়িয়ে জানালার পাশে, চাঁদনির নাম ধরে ডাকছে। দরজা বন্ধ, ভিতরে আসতে পারছে না। ধড়মড় করে জেগে উঠে হারিকেনটা উসকে দিয়েই বুঝে যায়, সে খোয়াবে দেখছে। পইঠায় বসে হাউমাউ কাঁদে। একসময় মন শান্ত হলে ঘরে গিয়ে বাচ্চা দুটোকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যায়।
সেদিন ছিল জুম্মাবার। সূর্য মাথার ওপর খাড়া। কোথা থেকে কয়টা শকুন এসে বাড়িটার ওপর দিয়ে উড়ছে। তারার শ্বশুরের জ্ঞাতি কুটুমরা খবর আনল, তাদের গ্রামের অনেক যুবক মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে, এই খবর জেনে পাক হানাদার বাহিনী এসে অনেকগুলো বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তুলে নিয়ে গেছে বেশ কজন মেয়েকে। অনেককে মেরে ফেলেছে। কাউকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, কাউকে কাউকে গুলি করে। তারার শ্বশুরকে মেরেছে গুলি করে। কথাটা শোনামাত্র তারাবিবি ‘ও আল্লাগো, ও তাওহীদ ময়নার বাপগো, এ কী সর্বনাশ হলো গো’, বলে দাঁত কপাটি লেগে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফিরে খানিকটা সুস্থ হওয়ার পর সে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে চেয়েছিল। মা বাবারা যেতে দেয়নি। এরপর তারাও বেশি দিন এ গ্রামে থাকতে পারেনি।
প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে তাদের এক ফুপুদের ওখানে চলে যায় তারারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাবাদের সঙ্গে বাবার বাড়ি ফিরে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা ঘরে ফিরে। শরণার্থী হয়ে যারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তারাও ফেরে। ফেরে না মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান। খোঁজ খবর করে জানতে পায়, অনেক দিন আগেই ফজলু হানাদার বাহিনীর সঙ্গে এক লড়াইয়ে শহীদ হয়েছে। তারাবিবির সবচেয়ে বড় স্বপ্নটির মৃত্যু এভাবেই হয়েছিল।
তারাবিবির জীবনের বাকি অংশ কেবলই কষ্ট আর সংগ্রামের দীর্ঘ পথ। তবে সে পথ চলা থামায়নি। বাচ্চা দুটি আর ছোট ভাইটাকে সঙ্গে করে শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসে। ঘর বাড়ি গুছিয়ে নিয়ে আবার জীবন শুরু করে। মেম্বার-চেয়ারম্যান, নানা মুরুব্বি ধরে সরকারি সাহায্য পাওয়ার ব্যবস্থা করে; তবে সে সামান্যই। নতুন দেশ গড়ে তোলার জন্য চারদিকে নানা উদ্যোগ আয়োজন। তাদের এলাকায়ও পৌঁছে যায় এনজিও। অনেক চোখের পানি ঝরিয়ে, অনেক দুঃখের গীত গেয়ে তারও একটি কাজ জোটে এনজিওতে। সেখানে সবাই তার ওপর খুব খুশি। সে মন-প্রাণ দিয়ে কাজ করে। বেশ কিছুদিন পর সে এখান থেকে ঋণ নিয়ে বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও গরু পালন শুরু করে। সচ্ছল না হলেও তাদের দিন চলে যায়। ছেলে-মেয়ে বড় হতে থাকে। ফজলুর বড় ইচ্ছা ছিল ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। তারাবিবি সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিল। শেষ রক্ষা করতে পারেনি। এনজিওর এখানকার কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ায় তার কাজটা আর থাকে না । শুধু হাঁস-মুরগি পালন, আর একটা গাভির দুধ বিক্রি করে এত বড় স্বপ্ন দেখা যায় না। ছেলেটা আইএ পাস করে আর পড়তে চাইল না। চাইল না বলতে পারল না। তারাবিবির আরেকটি স্বপ্নের মৃত্যু এভাবেই হলো।
বেশ কিছুদিন চাকরির চেষ্টা করে না পেয়ে শেষে রংপুর-ঢাকাগামী বাসের সুপারভাইজারের কাজ নিল ছেলেটা। আয় উপার্জন মোটামুটি ভালো হলেও মাস কাবারে কিছু নয়। কাজটাই এমন যে দুদিন করে এসে আবার দুদিন বাড়িতে। তবু সে চেয়েছিল বোনটা লেখাপড়ার চালিয়ে যাক। সেটাও হয়নি। সংসারের হালহকিকত দেখে সে ম্যাট্রিক পাশের পর সেবিকা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হলো। সকালে যায়, সন্ধ্যার পর বাসায় ফেরে। মোকামতলা বাস থেকে নেমে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়। রিকশা ভাড়া দিয়ে যাতায়াতের ক্ষমতা তাদের নেই। কোনো কোনো দিন ফিরতে দেরি হয়ে যায়। বাস স্ট্যান্ডে রাজনীতির নামে দলবাজি করা বখাটেরা উৎপাত করে; নোংরা কথা বলে। কখনো কখনো পিছু ধেয়ে গ্রামের মোড় পর্যন্ত আসে; কুৎসিত ইঙ্গিত করে। চাঁদনি বাসায় এসে কান্নায় ভেঙে পড়ে। মা-ভাই প্রতিকারের জন্য মুরুব্বিদের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে। ফল হয় না। বরং একদিন চাঁদনির ফিরতে অনেক দেরি হচ্ছে দেখে মা বিচলিত হয়। ছেলেকে খোঁজ নিতে বলে। ছেলে বাস স্ট্যান্ড বাজার পর্যন্ত গিয়ে খোঁজ খবর করে ফিরে আসে। সারা রাত উৎকণ্ঠায় পার হয়। পরদিন সকাল বেলা তাওহীদ বোনকে পাঁজাকোলা করে বাড়ি নিয়ে আসে। মা বুঝতে পারে না এত বড় ধাড়ি মেয়ে ভাইয়ের কোলে কেন!
কাছে এলে সব পরিষ্কার হয়। বলাৎকার করে হত্যা করার সব চিহ্ন সারা শরীরে স্পষ্ট ছিল চাঁদনির। স্থানীয় মুরুব্বি, মেম্বার, চেয়ারম্যান, থানা-পুলিশ কারও কাছে গিয়েই কিছু হয়নি। উল্টো মা-ছেলেই শাসানি, চোখ রাঙানি, মৃত্যুর হুমকি পেয়েছে। চাঁদনির নামে নোংরামির কথা চাউর করিয়েছে। এরপর তারাবিবি শোকে ও যন্ত্রণায় মূক হয়ে যায় প্রায়।
ছেলেকে বিয়ে করিয়েছে বছরখানেক বাদে। খরচ মেটাতে এবার তার এক ফালি জমি ও গরু বিক্রি করতে হয়েছে। সংসারের কাজ এখন বউটাই সামলায়। সংসারে মানুষ বাড়ে। একে একে দুই ছেলে এক মেয়ে আসে। বড় হতে থাকে। স্কুলে যেতে থাকে তারা। সংসার সংসারের জায়গায় খাড়া হয়; শুধু অভাব পিছু ছাড়ে না।
এত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও তাওহীদ মাকে একটা ছোট টেলিভিশন কিনে দেয়। মা সারা দিন গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগি দেখাশোনা করে, লাউ-শিম-বেগুন গাছের যত্ন নিয়ে সাঁঝবেলায় মাগরিব সেরে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে বসে টিভিতে নাটক দেখে, খবর দেখে, দেশের উন্নতির কথা শুনতে পায়। দেশটা নাকি বড়লোকদের দেশ হয়ে যাবে!
দেশটা তো বদলেছেই। টেলিভিশনে দেখতে পায়। কত বড় বড়, সুন্দর সুন্দর রাস্তা, বড় বড় ব্রিজ, দোতলা রাস্তা দেখে তারাবিবি। কত কত লাইট, সেই লাইটগুলো আবার দৌড়ায়। কী বাহারী সব জামা-কাপড় গায়ে কী সুন্দর সুন্দর গাড়ি চড়ে মানুষ ঘুরে বেড়ায়! এসবের কিছুই আল্লাহ তাদের জন্য দেয় না। কেন দেয় না, বুঝতে পারে না।
টেলিভিশনে তারা বিবি দেখে ঢাকা শহরে নতুন ধরনের মিছিল; আন্দোলন। ছাত্র-ছাত্রীরা রাস্তায়। রাস্তাঘাটের আইন তারা চালাবে। কোনো জ্যাম লাগতে দেবে না রাস্তায়। কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হতে দেবে না। কেউ গাড়ি চাপা পড়ে মরবে না আর। সরকার এদের দাবি মেনে নিয়েছে। তারাবিবি খুব খুশি হয়। ছেলেটার জন্য আর সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা হবে না। কিন্তু সপ্তাহ না যেতেই শোনে আবার রোড অ্যাক্সিডেন্ট। পুলিশকেই গাড়ি চাপা দিয়েছে। তারপর প্রতি দিনই জানা যায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় অ্যাক্সিডেন্টের খবর। মাস না ঘুরতেই ঢাকা থেকে আসা রংপুরগামী নাইট কোচ পলাশবাড়িতে উল্টোদিকের আরেকটা বাসের ধাক্কায় খাদে উল্টে ১৫ জন মারা যায়, যার একজন বাসের সুপারভাইজার তাওহীদ। তারাবিবি ছেলের লাশের ওপর আছড়ে পড়ে জ্ঞান হারায়। সেই দিনই তারা বিবির জীবনের শেষ স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। বউটা সারাক্ষণ বিলাপ করে কাঁদে। বাচ্চা তিনটার মুখ শুকনা। স্কুল যাওয়া বন্ধ। খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই। তারাবিবি জানে না, কী হবে, কেমন করে চলবে!
ঘরে যা ছিল, দিন চারেক কোনোভাবে চলেছে। তারপর উপায়ান্তর না পেয়ে টেলিভিশনটি বেচে দিয়েছে। ভালোই হয়েছে, উন্নয়নের চেহারা আর গালভরা স্বপ্নের কথা আর দেখতে ও শুনতে হয় না। সারি সারি গাড়ির বহর, দোতলা রাস্তা, রাজার বাড়ির মতো বাড়ি, পরির মতো সুন্দর সব দামি পোশাক পরা মেয়ে, এসব কিছুই আর তারাবিবি দেখে না।
তারাবিবি বেশির ভাগ সময়ই দাওয়ায় বসে চোখ জোড়া বন্ধ করে তার ছেলেকে দেখে, তার মেয়েকে দেখে, আর দেখে তার সোয়ামি ফজলুকে। চোখ খুললে দেখে কয়েকটি ক্ষুধার্ত মানুষের অসহায় ক্লিষ্ট মুখ। তার কান কেবল ক্রমাগত শোনে, ‘দাদি, খাওন দাও, ভুখ লাগছে।’