আজগর আলী মাস্টার

ভোর পাঁচটা বাজে, আজ ঘড়ির অ্যালার্মের আগেই আজগর সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। উনি বিছানা ছেড়ে উঠে হাত মুখ ধুয়ে নিলেন, অজু করে ফজরের নামাজটা সেরে ফেললেন। ফজর আর এশার নামাজ উনি ঘরেই পড়েন। কারণ গ্রামের সবচেয়ে কাছের মসজিদটা কম করে হলেও দুই মাইল দূরে। হেমন্ত কালের সকাল । বেশ শীত শীত ভাব, শেষ রাতে কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমাতে হয়। সকালে নরম ঘাসে শিশিরের ঝিকিমিকি দেখা যাচ্ছে। পৃথিবীর এই অপরূপ সৌন্দর্যের জন্য আজগর সাহেব আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন।
আজ আজগর সাহেবের স্কুলে জেলা শিক্ষা অফিসার পরিদর্শনে আসবেন। তাই আজকের দিনটি অন্য দিনগুলোর মতো সাধারণ নয়। চট করে কিছু একটা গায়ে দিয়ে, ছাতা নিয়ে সাইকেলে করে স্কুলে রওনা দিলে হবে না। তাই ট্রাঙ্কে তুলে রাখা একমাত্র পায়জামা-পাঞ্জাবি, যেটা তিনি বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে পরেন, সেটা বের করা হয়েছে। পায়ের জুতাজোড়া আগের দিন বাজার থেকে নির্মল মুচিকে দিয়ে কালি করিয়ে এনে রেখেছেন। মোটামুটি সব ঠিকঠাক আছে।
স্কুলের বাচ্চাদের সপ্তাহ খানেক ধরে নানান রকমের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। যেমন, ক্লাসে টু শব্দটিও করা যাবে না। শিক্ষক ক্লাসরুমে ঢোকা মাত্র সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে সালাম দিতে হবে। প্রত্যেকের জামা কাপড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। কিন্তু সমস্যা হলো, অজ পাড়াগাঁয়ের স্কুল। এখানকার বেশির ভাগ লোকই নিম্ন আয়ের। ঠিকমতো দুবেলা খেতে পারে কিনা সন্দেহ আছে। এ রকম একটা পরিবেশে পরিচ্ছন্ন কাপড় আর চকচকে জুতা আশা করাটাই অন্যায়। কিন্তু শিক্ষা পরিদর্শক কী আর এসব বুঝবেন?
স্কুলের একমাত্র ফ্ল্যাগটাও ধুয়ে ইস্ত্রি করে রাখা হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক দপ্তরি সবাই মিলে স্কুলটাকে মোটামুটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কারণ আজকের পরিদর্শনের ওপর নির্ভর করছে এই স্কুলের ভবিষ্যৎ। চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে উড়ো উড়ো খবর এসেছে, স্কুলটি সরকারি হয়ে যাওয়ার চান্স আছে। এই খবর শোনার পর থেকে আজগর সাহেবের ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না। ঘুমের মধ্যেও স্বপ্ন দেখছেন, স্কুল সরাসরি হয়ে গেছে। আধা পাকা জোড়াতালি দেওয়া গ্রামের শতবর্ষীয় স্কুলে নতুন দালান উঠেছে। আজগর সাহেব চমৎকার একটা রুমে বসে আছেন। এটা প্রধান শিক্ষকের অফিস রুম। জানালায় নূতন পর্দা ঝুলছে। মাথার ওপর দামি পাখা ঘুরছে। সাজানো গোছানো, ঠিক যেমন শহরের স্কুলে গেলে দেখা যায়, সেরকম ।
স্বপ্ন বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না । পাশ ফিরলেই ভেঙে যায় । তখন আর ঘুমাতে পারেন না । ঘুম থেকে উঠে পায়চারি করেন। স্কুল নিয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা করেন। এভাবেই গত কয়েকটা দিন কেটেছে।
ইজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ!
আজগর সাহেবের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন, আজকের নাশতায় বিশেষ মেন্যুর ব্যবস্থা করেছেন। পরোটা সেমাই আর একটা করে ডিম পোচ। অভাবের সংসারে এ রকম আয়োজন সচরাচর হয় না । তিন সন্তান নিয়ে আজগর সাহেব নাশতা করতে বসলেন ঠিকই, কিন্তু কিছুই খেতে পারলেন না। কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে উঠে গেলেন। স্ত্রীকে এক কাপ চা দিতে বলে উঠানের মোড়াতে এসে বসলেন। পকেট থেকে লম্বা একটা লিস্ট বের করে চোখ বুলিয়ে নিলেন। লিস্টের একপাশে স্কুলের বহুবিধ সমস্যার কথা লেখা আর অন্য পাশটায় আজকে স্কুলে শিক্ষা অফিসারের সম্মানে কাকে কাকে দাওয়াত করলেন, সেই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তালিকা। সকাল নয়টার মধ্যে সবার স্কুলে উপস্থিত হয়ে যাওয়ার কথা। এখন বাজে ০৮ টা ১০। দুপুরে শিক্ষা অফিসার আর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় খানার ব্যবস্থা করা হয়েছে ।
আজগর সাহেব বিগত প্রায় বিশ বছর এই নুরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে আছেন। যত সামান্য বেতন, তাও কোনো কোনো মাসে আটকে থাকে । টেনেটুনে কোনো রকম সংসার চলে যায়। আসলে উনি ভেবে পান না, রাবেয়া কী করে সব সামাল দিচ্ছে। ভয়ে লজ্জায় জিজ্ঞাসাও করেন না। বড় মেয়ে শহরের কলেজে পড়ে, ছেলে দুটো বাবার স্কুলে।
গ্রামে দুটো স্কুল, একটা চেয়ারম্যান সাহেবের দাদার দান করা জমির ওপর। সেটাতে অবশ্য দালান আছে। শিক্ষকদেরও বেতন-বোনাস আটকে থাকে না। ছাত্র-ছাত্রীও কম না। কিন্তু এসএসসির রেজাল্টের দিক থেকে নুরপুর উচ্চ বিদ্যালয় এগিয়ে আছে। প্রতি বছর বাচ্চারা ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিও পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় শহরের স্কুলকে পর্যন্ত হারিয়ে দিচ্ছে। এসবই সম্ভব হয়েছে শিক্ষকদের একনিষ্ঠ পরিশ্রম আর আন্তরিকতার জন্য। গত বছর এসএসসি পরীক্ষায় ৬০ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৫ জন A+,৩০ জন A আর বাকিরা B গ্রেড পেয়েছিল। ১৫ জনA+ পাওয়া ছেলেমেয়েদের চাঁদা তুলে সংবর্ধনার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।
আজগর সাহেব একটা ডায়েরিতে স্কুলের সব রকম সফলতার কথা লিখে রেখেছেন ।
সকালে জাতীয় পতাকা উত্তোলন আর জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর শিক্ষা পরিদর্শকের উদ্দেশে একটা বাণী দেওয়া হবে । ওনার মেয়ে শম্পা এসব কাজে বাবাকে সহযোগিতা করেছে। শম্পা এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী । ওর ছোট দুই ভাই রিপন আর শিপন এসএসসি পরীক্ষার্থী ।
আজগর সাহেব সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে স্কুলে রওনা দিলেন। গিয়ে দেখলেন সবাই মোটামুটি উপস্থিত । কেবল চেয়ারম্যান সাহেবের আসতে একটু দেরি হচ্ছে। সকাল ১০ টা বাজে পরিদর্শক সাহেব আসলেন। স্কুলে ঢোকার মুখে তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হলো। এই অজ পাড়া গাঁয়ে গাঁধা ফুলটাই বেশি পাওয়া যায়। তাই মালার জন্য অন্য ফুলের আর ব্যবস্থা করা গেল না। পরিদর্শকের সঙ্গে চেয়ারম্যান সাহেবও এসেছেন। সবাইকে অ্যাসেম্বলিতে নেওয়া হলো। যথারীতি সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো। পরিদর্শক সাহেব স্কুল পরিদর্শন করলেন। ছাত্র শিক্ষকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমন প্রত্যন্ত গ্রামে এত চমৎকার পড়াশোনার পরিবেশ নাকি তিনি কল্পনাও করেননি।
তবে কিছু কিছু বিষয় পরিদর্শক সাহেবের খারাপ লেগেছে। যেমন ক্লাস টেনে গিয়ে উনি প্রশ্ন করলেন, বাংলাদেশের আয়তন কত? ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তরে বলেছে ৫৫,৫,৯৮ বর্গ মাইল। পরিদর্শক সাহেবের কথায় আজগর সাহেব নিজেও লজ্জা পেলেন। তিনি নিজেও জানতেন না যে কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বেড়ে গেছে! পরিদর্শক সাহেব চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় যাওয়ার আগে বলে গেলেন, হেড মাস্টার সাহেব, স্টুডেন্টদের সব সময় আপডেট রাখার চেষ্টা করবেন। মনে রাখবেন.....
...পৃথিবী প্রতিদিনই বদলে যাচ্ছে । কিন্তু তিনি তো আর জানেন না, এই গ্রামে সপ্তাহে একদিন সংবাদপত্র আসে (হাট বারে)। এখান থেকে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা এত সহজ নয় ।
পরিদর্শক সাহেবকে বিদায় জানানোর সময় তাঁকে কিছু মূল্যবান উপহার দেওয়া হলো। উপহার ছিল একাত্তরের দলিলের কয়েকটা খণ্ড; সবগুলো দেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা এই স্কুলের নেই। এই কয়েক খণ্ডের টাকার অর্ধেক এখনো বাকির খাতায়।
হেড মাস্টার সাহেবসহ সব গণ্যমান্য ব্যক্তি চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় দুপুরের খানা খেতে গেলেন। চেয়ারম্যান সাহেব দিল-দরিয়া মানুষ, যা-ই করেন একেবারে হৃদয়-মন উজাড় করে করেন। আজকের খাবারের আয়োজনও ছিল মনে রাখার মতো। ঘরের বড় খাসি জবাই দেওয়া হয়েছে, রাজহাঁস, পুকুরে পাকা রুই কোনোটা বাদ নেই। ঘরে পাতা দই আর নানান রকমের পিঠা। উপস্থিত অতিথিরা বুঝতে পারছেন না কোনটি দিয়ে শুরু করবেন। শিক্ষা পরিদর্শক এই এলাহি কাণ্ড-কারখানা দেখে অবাক হয়ে গেছেন। মুখে বারবার বলছিলেন, ‘এসবের কোনো প্রয়োজন ছিল না।’ কিন্তু মনে মনে যে বেজায় খুশি হয়েছেন,সেটা তাঁর চেহারা দেখলে, যে কেউ বলে দিতে পারবে। শতরঞ্জি বিছিয়ে খাবার পরিবেশন করা হলো। সবাই রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রাজকীয় ভোজ শেষে একে একে সবাই বিদায় নিলেন। সবাই চলে যাওয়া পর আজগর সাহেব শিক্ষা পরিদর্শকের সঙ্গে আরও কিছু সময় কাটালেন। পরিদর্শক সাহেব ১০০% নিশ্চয়তা দিলেন, এবারই নুরপুর উচ্চ বিদ্যালয় সরকারি হয়ে যাবে। তিনি ঢাকায় ফিরে এই বিষয়ে সমস্ত ব্যবস্থা চূড়ান্ত করে ফেলবেন। খুব শিগগিরই সুখবর আসছে, এমন আশ্বাস নিয়ে আজগর সাহেব বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি ফিরেই ছেলে মেয়ে স্ত্রী সবাইকে সুখবরটা দিলেন। বললেন, আমাদের কষ্টের দিন শেষ, আর মাত্র কয়টাদিন। স্কুল সরকারি হয়ে যাচ্ছে ।
সবাই স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন, রাবেয়া খাতুন মনে মনে ভাবলেন, এবার তাহলে দুর্দশা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। ধারকর্জ আর টানাটানি একেবারে সহ্য হচ্ছিল না। মেয়ে বড় হয়েছে বিয়ে দিতে হবে, বিএ পাস করলেই বিয়ের কথা তুলবেন। স্কুল সরকারি হলে আজগর সাহেবের বেতন প্রায় তিনগুণ বেড়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা নিয়মিত বেতনটা পাবেন, বোনাস পাবেন। একটা মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে তার আর কষ্ট হবে না। মাসশেষে শুকনো মুখে বাড়ি ফিরতে হবে না।
সাহস করে বলতে পারবেন, ‘গিন্নি আজ কী রান্না করলে? অথবা আজকে কিন্তু বৃষ্টির দিন, খিচুড়ি আর ইলিশ ছাড়া জমবে না।’
কয়েক মাস পর মেয়ের এইচএসসি পরীক্ষা, প্রায় কাছাকাছি সময়ে ছেলেদেরও এসএসসি পরীক্ষা। ফরম ফিলাপ করতে হবে, টাকা-পয়সা প্রয়োজন । এখন আল্লাহ আল্লাহ করে স্কুলটা সরাসরি হয়ে গেলে আপাতত সব সমস্যার সমাধান। পরদিন স্কুলে গিয়ে সব শিক্ষক আর ছাত্র-ছাত্রীদের একসঙ্গে করে বললেন, আর বেশি দিন নেই, আমাদের স্কুলে সরকারি হয়ে যাচ্ছে। এখন থেকে আমরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাব। স্কুলে নতুন বিল্ডিং উঠবে। ভালো ভালো শিক্ষকেরা আসবেন। গ্রামের লোকের বহু দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে । শুনে সবাই আনন্দে করতালি দিল। ফিসফিসিয়ে সবাই বলাবলি করতে লাগল, এই স্কুল অনেক আগেই সরকারি করা উচিত ছিল, তবুও ভালো দেরিতে হলেও হচ্ছে ।
মাস খানেক পরে হঠাৎ একদিন চেয়ারম্যান সাহেব আজগর সাহেবকে ডেকে পাঠালেন এই বলে, ‘ঢাকা থেকে সরাসরি চিঠি এসেছে।’ জরুরি কথা বলা দরকার। আজগর সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ছুটলেন। উনি একশত ভাগ নিশ্চিত স্কুল সরকারি হয়ে গেছে। এই চিঠিটা সেই দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। চেয়ারম্যান সাহেব বৈঠক খানায় অপেক্ষায় ছিলেন। হেড মাস্টার সাহেবকে দেখে বললেন আসেন মাস্টার সাহেব মিষ্টিমুখ করেন, আমাদের বাপ-দাদার দেওয়া ‘রমজান আলী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়’ সরকারি হয়ে গেছে। আমার অনেক দিনের স্বপ্ন আজ সত্যি হলো। আপনি মিষ্টি খান, বলে জোর করে একটা মিষ্টি আজগর সাহেবের মুখে পুরে দিলেন। মাস্টার সাহেব কোনো মতে মিষ্টিটা গিলে ফেললেন। যদিও কষ্ট হচ্ছিল, তবুও চেয়ারম্যান সাহেবের সামনে বেয়াদবি করা ঠিক হবে না। উনি মিনমিনে গলায় বললেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেব, পরিদর্শক সাহেব তো এসেছিলেন, আমাদের স্কুলটা সরকারিকরণ করার জন্য। আর সে রকম কথাও তিনি বলে গিয়েছিলেন।’
কথাটা শোনামাত্র চেয়ারম্যান সাহেবের চেহারা কঠিন হয়ে গেল। তিনি বেশ রাগের গলায় বললেন, ‘কেন আমার স্কুল সরকারি হওয়ায় আপনার ভালো লাগছে না?’ ‘আপনাদের স্কুল সরকারি হওয়ার কী যোগ্যতা আছে? ভাঙাচোরা একটা স্কুল ঘর, সব চাষাভুষার ছেলেমেয়েরা পড়ছে। খালি গাধার মতো খাটলে আর ভালো রেজাল্ট করলেই সব হয় না। খরচপাতি করতে হয় বুঝলেন?’
আজগর সাহেব চেয়ারম্যান সাহেবের কথায় আহত হলেন। কোনো কথা না বলে সোজা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন। রাবেয়া খাতুন স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে ঠিকই বুঝতে পারলেন, কিছু একটা হয়েছে। বিকেলে শোয়ার ঘরে, রাবেয়া খাতুন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমাকে খুলে বলোতো, কী হয়েছে? সেই দুপুর থেকে দেখছি চুপচাপ হয়ে আছ। মুখেও কিছু দিচ্ছ না।’ আজগর সাহেব তাঁর স্ত্রীকে সমস্ত ঘটনা বললেন। সামনে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা, ফরম ফিলাপ করতে হবে, মেয়ের হোস্টেলের খরচ বাকি। কোনো রকম সংসার চালানই যেখানে কষ্টকর, সেখানে এতসব খরচের টাকা কোথা থেকে জোগাড় করবেন, তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। বাবা-মায়ের এসব কথা আজগর সাহেবের মেয়ে শম্পা আড়াল থেকে শুনে ফেলেছিল । সে সারাটা দিন এটা নিয়ে ভাবল, তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিল। রাতে খাবার পর আজগর সাহেব উঠোনের মোড়াতে বসে থাকলেন অনেক রাত অবধি । শম্পা আস্তে করে বাবার পাশে এসে দাঁড়াল। বাবার কাঁধে রাখল হাতটা। আজগর সাহেব আনমনা ছিলেন, স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলেন। তাকিয়ে দেখেন, অতি আদরের একমাত্র কন্যা বাবার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। উনি ইশারা দিয়ে পাশে বসতে বললেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর ঘুম আসছে নারে মা?’ রাত তো কম হয়নি। তোর মা কি ঘুমাচ্ছে? শম্পা বলল, ‘মা ভাইদের ছোটবেলার গল্প শোনাচ্ছে, এতক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।’
শম্পা তার বাবার হাতটা হাতে নিয়ে আহ্লাদী গলায় বলল, ‘বাবা তোমাকে একটা জরুরি কথা বলতে চাই, মাকে বলবার সাহস পাচ্ছি না। বলব?’
আজগর সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমনকি কথারে মা, কারও সঙ্গে প্রেম-ট্রেম হয়নি তো আবার?‘ আজগর সাহেবের কথায় বাবা-মেয়ে দুজনেই হেসে উঠলেন। শম্পা মাথা নেড়ে বলল, এসব কিছু না, অন্য বিষয়। আজগর সাহেব মেয়ের চেহারা দেখে বুঝলেন সে বেশ সিরিয়াস। তিনি তখন মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ‘বলো মা, কী সমস্যা, কেন এত সুন্দর মুখখানা অন্ধকার করে রেখেছ?’
শম্পা বলল, ‘বাবা এবার আমি পরীক্ষা দিচ্ছি না, আমার প্রস্তুতি ভালো না। নির্ঘাত ফেল করব। তুমি আমার ফরম ফিলাপের টাকার জন্য করো কাছে হাত পাতবে না। ভাইয়েরা যাতে পরীক্ষা দিতে পারে সেই ব্যবস্থা কর। আমি নিজেও দুই তিনটা টিউশনি করব। তোমার পাশে দাঁড়াব। তুমি এখনই মাকে কিচ্ছু বলবে না। আমি এক সময় বুঝিয়ে বলব।’ কথা শেষ করে শম্পা বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘরে চলে গেল। যাওয়া সময় বারান্দায় রাখা হারিকেনের আলোটা কমিয়ে দিয়ে গেল। ঘরে কেরোসিনের মজুত খুব কম। আর বলে গেল, বাবা এখন কিন্তু উত্তরের বাতাস শুরু হয়ে গেছে। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব, তুমি ঘরে এসো। শেষে আবার অসুখ বিসুখ বাধাবে। এতক্ষণ আজগর সাহেব একটা কথাও বললেন না।
মেয়ের চলে যাওয়ার পর আকাশের দিকে তাকালেন। হেমন্তের ঝকঝকে নীল আকাশ! অপরূপ জোছনা! উঠোনে লাগানো দোলনচাঁপার মিষ্টি গন্ধ চারপাশটা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অপার্থিব একটা পরিবেশে! এত চমৎকার দৃশ্য দেখার পরেও আজগর সাহেবের দুচোখ ভেঙে কান্না এল। তিনি হু হু করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর মেধাবী মেয়েটার লেখাপড়া কী তাহলে আর হলো না?