উদীচীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও হেমন্ত উৎসব

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও হেমন্ত উৎসবের নানা সময়ের পরিবেশনা
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও হেমন্ত উৎসবের নানা সময়ের পরিবেশনা

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দ্বিবার্ষিক-বার্ষিক সম্মেলন ও হেমন্ত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০ ও ২১ অক্টোবর জ্যাকসন হাইটসের আইএস টু থার্টি স্কুলে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
এবারের আয়োজনে ছিল সংগঠনটির জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ বছর বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সুবর্ণজয়ন্তী ৫০ বছর উদ্‌যাপন করেছে। এ ছাড়া উদীচী যুক্তরাষ্ট্রের ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষে ছিল হেমন্ত উৎসবের আয়োজন।
উদীচীর সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন নিয়ে সংগঠনটির সদস্য সুব্রত বিশ্বাস বলেন, ‘সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্তের প্রদর্শিত পথে ১৯৬৮ সাল থেকে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী গণসংগীত, নাটক, আবৃত্তি, নৃত্যসহ সব সাংস্কৃতিক মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আসছে।’
সাধারণ সম্পাদক জীবন বিশ্বাস বলেন, ‘উদীচী একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন যার রক্তাক্ত অভিজ্ঞতায় আছে প্রতিক্রিয়াশীল দানবের ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চের হত্যাকাণ্ড ও ২০০৫ সালে নেত্রকোনা হত্যাকাণ্ড। তবুও উদীচীর অগ্রগামী যাত্রাকে রুখে দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পরেও আজ দেশে ও বিদেশে ৩১৫টি শাখায় উদীচীর নিয়মিত কর্মকাণ্ড চলছে।’
২০ অক্টোবর শনিবার উদীচীর হেমন্ত উৎসব শুরু হয় শিশু-কিশোরদের চিত্রাঙ্কন ও বাংলা লিখন প্রতিযোগিতা দিয়ে। বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ’। এরপর ছিল জ্যাকসন হাইটসের পথে শোভাযাত্রা। দুপুরে শুরু হয় উদীচী যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল অধিবেশন। এরপরের আয়োজন ছিল মুক্তিযুদ্ধের গান ও মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। কবিতা ও নাটকের কর্মশালার পরিচালনায় ছিলেন ফারুক ফয়সল ও ফজলুল করিম।
ওই দিন বিকেলে আয়োজনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বেলাল বেগ। সন্ধ্যায় আলোচনা অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল ‘সাম্প্রদায়িকতা ও সংস্কৃতির সংকট’। সুব্রত বিশ্বাসের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন খোরশেদ আলম, ফজলুর রহমান, আজিজুল মানিক। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি আজিজুল মালিকের সঞ্চালনায় এরপর উদীচী যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কমিটির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
এরপর উদীচী যুক্তরাষ্ট্রের ২০ বছরের পথচলা নিয়ে বক্তব্য রাখেন জীবন বিশ্বাস, সুব্রত বিশ্বাস ও মো. আবদুল্লাহ। উদীচী যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পীদের গণসংগীত, নৃত্যানুষ্ঠান ও তবলা লহরা পরিবেশিত হয়। প্রথম দিনের শেষ আকর্ষণ ছিল মুত্তালিব বিশ্বাসের গ্রন্থনা ও পরিচালনায় উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর পরিবেশনায় ‘ঐতিহ্যবাহী বাংলা গান’ এর প্রথম পর্ব। যেখানে পরিবেশিত হয় লোকজ সংগীত।
২১ অক্টোবর দ্বিতীয় দিন শুরু হয় বিভিন্ন বিষয়ে শিশু-কিশোরদের বই পাঠের প্রতিযোগিতা। বিকেলে ছিল সংগীতজ্ঞ মুত্তালিব বিশ্বাসের পরিচালনা একটি কর্মশালা। দেড় ঘণ্টার ওই কর্মশালায় তিনি শেখান, কেন ও কীভাবে গান গাওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘গান গাওয়ার আগে জানতে হবে কেন আমি গান গাইব, কী গান আমি গাইব ও কীভাবে গাইব? গলা সাধা ও সারগাম জানলেই গানকে ধরা যাবে না। একই স্বরের কোমল ও উচু সরে গাওয়া দুটিই চলে। কিন্তু সব গানের সঙ্গে সব তারে গাওয়া যায় না। একটি গানের অভিঘাত, থ্রোয়িং, কোন শব্দের ওপর চাপ দিতে হবে এটা জানতে হবে। ভালোভাবে স্কেল জানতে হবে। স্বর প্রক্ষেপণ জানতে হবে। একটা গান গাওয়ার ওপর তার অর্থ নির্ভর করে। অর্থ না বুঝে শুধু গাওয়ার জন্য গান করার কোনো মানে নেই।’
উদীচীর ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সংগীত পরিষদ, বিপা, সুরছন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, আওয়ামী লীগ ও বাসদের সদস্য এবং নেতা-কর্মীরা।
এবার প্রথমবারের মতো উদীচী যুক্তরাষ্ট্র শাখা সত্যেন সেন পুরস্কার প্রবর্তন করে। পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় ওয়ালেদ চৌধুরীর হাতে। এর সঞ্চালনায় ছিলেন কৌশিক আহমেদ। সন্ধ্যায় ছিল জীবন বিশ্বাসের সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচনা। আলোচনায় অংশ নেন নিনি ওয়াহেদ, আজিজুল মালিক, সুব্রত বিশ্বাস, জিয়াউদ্দীন আহমেদ, কৌশিক আহমেদ ও সুব্রত বিশ্বাস।
বক্তারা বলেন, সত্যেন সেন ও রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন ভবিষ্যদ্রষ্টা। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া রাজনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়। সেই ভাবনা থেকেই উদীচীর যাত্রা শুরু। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অভ্যুদয় একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এসেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরই অন্য রূপ।
দুই দিনব্যাপী উদীচীর অনুষ্ঠানের সর্বশেষ আকর্ষণ ছিল কিংবদন্তি শিল্পী সুবীর নন্দীর কালজয়ী সব গান। তিনি একে একে গেয়ে শোনান ‘পাখি রে তুই দূরে থাকলে’; ‘দিন যায় কথা থাকে’; ‘পাহাড়ের কান্না দেখে’; ‘আমার এ দুটি চোখ তো পাথর নয় তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’; ‘শুধু একদিন ভালোবাসা তাও যদি পাই’; ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’।
সংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ সত্যেন সেনের নেতৃত্বে ঢাকায় ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে উদীচী যুক্তরাষ্ট্রের সূচনা। প্রাথমিকভাবে বিদেশের প্রতিকূল পরিবেশে সীমিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ২০০৩ সাল থেকে বৃহত্তর পরিসরে উদীচী স্কুল অব পারফর্মিং আর্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উদীচী নিয়মিত কার্যক্রম শুরু করে।