যেহীন বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে

স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে যেহীন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে যেহীন আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

যেহীন আহমেদ চলে গেছেন অসময়ে। চুপি চুপি এসে হৃদয়ের সব ভালোবাসা দিয়ে অন্ধকারে জ্বালিয়ে গেলেন আলোর মশাল। আজকের সমাজের রাজনৈতিক, মানবিক, সাম্প্রদায়িক ও নৈতিক স্খলনের সংস্কারে তাঁর ভূমিকা ছিল নির্ভীক মুক্তি সংগ্রামীর মতো। তাঁর ছোট জীবনের বিশালতা প্রেরণা জোগাবে ঝিমিয়ে থাকা মানুষকে। ১৯৫০ সালে ১ বৈশাখ সিলেটে তাঁর জন্ম আর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গত ২৭ অক্টোবর সকালে ঢাকার একটি হাসপাতালে না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি।

সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম যেহীন আহমেদের। তাঁর দাদা ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে এক নির্ভীক কর্মী এবং ভবিষ্যতের সমাজসংস্কারে মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষার অনুসারী। শিক্ষানুরাগী বাবার উৎসাহে তাঁর বাবা নাজমুল হুসাইন চৌধুরী কলকাতায় পড়াশোনা করতে যান। ব্রিটিশ আমলেই ইন্সপেক্টর অফ কলেজ হয়ে তৎকালীন পূর্ববাংলায় এবং সিলেটে শিক্ষা বিস্তার ও নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম সাহিত্য সংসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তাঁর আলোকিত পরিবারে ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে, অসাম্প্রদায়িকতা, সাহিত্য, সংগীত, দর্শন চর্চা ছিল তৎকালীন সমাজে এক দুর্লভ ঘটনা, যার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর জীবনে। ছোটবেলা থেকে তিনি ছিলেন উদারহস্ত, উন্মুক্ত হৃদয়, সংস্কৃতিমনা, সর্বদা জ্ঞানের অন্বেষায় নিমগ্ন, মানবিক গুণ সমৃদ্ধ সমাজের অবক্ষয় দূর করার এক অক্লান্ত সৈনিক। শান্ত কিন্তু তেজি, ভদ্র কিন্তু চির উন্নত শির। প্রচারণা বিমুখ ছিলেন। জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে মানুষকে স্নেহ করতেন, তবে কোনো অন্যায় দেখলে ক্ষমা করেননি। চিরকুমার থেকে অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন তিনি। কিন্তু দেশে ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিখ্যাত ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাপ্য বন্ধুত্ব ও সম্মান ছিল অসাধারণ।

যেহীন আহমেদের জীবনে সবচেয়ে বড় অবদান ১৯৭৯ সালে তাঁর গড়ে তোলা বেসরকারি সাহায্য প্রতিষ্ঠান ফ্রেন্ডস ইন ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (এফআইভিডিবি)। আজ এটি সিলেটের সবচেয়ে বড় এনজিওই শুধু নয়, এর কর্মপ্রণালি গ্রামবান্ধব। কর্মীবৃন্দের সহমর্মিতা, মানবিক মূল্যবোধ এবং নতুন নতুন ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেশে-বিদেশে প্রশংসার যোগ্য। যেহীন আহমেদের প্রচেষ্টায় এফআইভিডিবি একটি ঘনিষ্ঠ পরিবারের মতো শাখা-প্রশাখায় বিস্তীর্ণ। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়তা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নতির মাধ্যমে দরিদ্র শিশু, নারী ও পুরুষের ক্ষমতায়ন। এই অর্জন দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য নতুন শিক্ষা পদ্ধতি, এলাকাভিত্তিক সামাজিক সংগঠন গড়ে নিজ দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অংশীদার হওয়া, অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান, সুস্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রণালীসহ কর্মসংস্থান ও খাদ্যে উৎপাদনে স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এভাবে সংগঠনটি দায়িত্ববোধ শিখিয়ে এবং অংশীদারত্ব প্রদানের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে শিক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর উন্নয়নে প্রকল্প গড়ে তুলছেন। পাশাপাশি তারা সরকারি-বেসরকারি সামাজিক ও মানবিক সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করছেন।

শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের উদ্ভাবিত ‘ফাংশনাল লিটারেসি’ কর্মসূচি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রশংসা পাচ্ছে। বর্তমানে দেশে ৩০০টি সংস্থা এটি ব্যবহার করছে এবং ২১ লাখ মানুষ এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। ভারতের বিহার ও উড়িষায় ১৯৯২ সাল থেকে এবং সম্প্রতি ইয়ামেনে তা পড়ানো হচ্ছে। ইদানীং শহরের বস্তিতেও এটি চালুর জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা উদ্যোগ নিয়েছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীরা আলোচনায় নিজের জীবন, পরিবেশ, সমাজ, পেশা, কর্মপদ্ধতি, স্থানীয় বিপর্যয়—তাবৎ দৈনন্দিন জীবনের ওপর আলোকপাত ও তার সমাধানের পথ উদ্ভাবনের চেষ্টা করেন। এর মধ্যে নারীদের যোগ্য অধিকার, পুষ্টি জ্ঞান, বর্জ্য ও স্যানিটেশন প্রণালি উন্নয়ন এবং অন্যান্য সময়োপযোগী বিষয়ের উন্নতির ওপর আলোচনা হয়।

এফআইভিডিবি এই নতুন পদ্ধতির নন-ফরমাল শিক্ষা পদ্ধতির জন্য বহুবার আন্তর্জাতিক সম্মান লাভ করেছে। এর মধ্যে জাতীয় শিক্ষা পুরস্কার ১৯৯৬, ১৯৯৭ ও ১৯৯৯, এশিয়ান কালচারাল ইউনেসকো অ্যাওয়ার্ড ১৯৯৫ এবং ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাডাল্ট এডুকেশন থেকে রবি কিড অ্যাওয়ার্ড।

বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য এফআইভিডিবি বহু ধরনের বই, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, শিক্ষার উপকরণ নিয়মিত প্রকাশনা করে আসছে। শিশুদের জন্য তারা নিজস্ব কয়েক শ বিদ্যালয়ে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করেন যা খেলা ও বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর উৎসাহ এবং উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ লাভে সহায়তা করে। স্বাস্থ্য প্রকল্পে তাদের মা ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নতি, পরিবার পরিকল্পনা, ম্যালেরিয়া দূরীকরণ, বিশুদ্ধ পানি ও বিজ্ঞান সম্মত বর্জ্য নিষ্কাশন উল্লেখ যোগ্য। গ্রামের মায়েদের প্রসবের সুবিধার্থে তারা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সঙ্গে তিন বছরের একটি মিডউইফেরি ট্রেনিং কোর্স শুরু করে যা কয়েক বছর ধরে চলছে। এতে বহু প্রশিক্ষিত ধাত্রী তৈরি হচ্ছে।

সমাজ উন্নয়নের সব প্রধানদের সঙ্গে যেহীন আহমেদের ছিল ঘনিষ্ঠতা। বিশেষ করে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের অনেক স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। গ্রামীণ ব্যাংকের ড. মুহাম্মদ ইউনুস, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, রাশেদা কে চৌধুরীসহ সবার সঙ্গে আন্তরিক ছিলেন তিনি। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী মানুষের কাছে পেয়েছেন অনেক সম্মান।

বন্ধু বৎসল এই মানুষটির সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল যা তিনি ভোলেননি কোনো দিন। নিজের অধীনস্থ কর্মচারী, চালক ও অন্যরা ছিলেন তাঁর কাছে ভ্রাতৃসম। সবাইকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন এবং তাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখে শামিল হতেন। কাজ এবং আত্মীয় বন্ধুদের নিয়ে ছিল তাঁর ব্যস্ত জীবন। তার অনুপস্থিতি ভালোবাসার মানুষের বুকের মধ্যে শুধু একটি বিশাল শূন্যতাই তৈরি করেনি, একটি অসাধারণ মানবকর্মীর তিরোধানে অপূরণীয় ক্ষতি হলো দুঃখী মানুষের জীবনসংগ্রামে।

আমরা প্রার্থনা করি, সৃষ্টিকর্তা যেহীনের সব সুন্দর কাজের জন্য তাঁকে পুরস্কৃত করুন এবং তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন প্রাণপ্রিয় সংগঠন টিকে থাকুক।

(লেখক: চিকিৎসক, ফিলাডেলফিয়া)