যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জন্ম দেওয়াই লক্ষ্য

সন্তানসম্ভবা অনেক নারী নিজ দেশের দারিদ্র্য ও সহিংসতা থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি জমান। তাঁদের স্বপ্ন অনাগত সন্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক করা। ছবি: এএফপি
সন্তানসম্ভবা অনেক নারী নিজ দেশের দারিদ্র্য ও সহিংসতা থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি জমান। তাঁদের স্বপ্ন অনাগত সন্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক করা। ছবি: এএফপি

দুই মাস আগে মারিসল হার্নান্দেজের জীবনে ঘটে গেছে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি। তাঁর চোখের সামনে ঘরের দরজায় দুর্বৃত্তরা হত্যা করে তাঁর স্বামীকে। গ্যাংস্টারদের পক্ষে কাজ না করার অপরাধে হত্যা করা হয় তাঁকে। দুই সন্তান ও আরেকটি অনাগত সন্তানের মা মারিসলের জীবনে স্বামীই ছিলেন একমাত্র ভরসা।

এরপর ২৩ বছরের মারিসলকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত নিতে হয়। দুই সন্তানকে তাঁর নানির কাছে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে পাড়ি জমান তিনি। গর্ভের সন্তানকে যুক্তরাষ্ট্রে ভূমিষ্ঠ করাতে পারলে নাগরিকত্ব পাবে শিশুটি। তাহলে হয়তো তাদের এই ভয়ংকর অসহায় জীবনের কিছুটা হলেও গতি হবে।

বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে মারিসলের ঘটনা উঠে আসে। হন্ডুরাস থেকে একা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা দেন মারিসল। অবশ্য তিনি একা নন, সন্তানসম্ভবা অনেক নারী নিজ দেশের দারিদ্র্য ও সহিংসতা থেকে পালিয়ে এখন মেক্সিকো সীমান্তে অবস্থান করছেন। তাঁদের সবার স্বপ্ন অনাগত সন্তানকে ‘আমেরিকান নাগরিক’ করা।

সন্তান একটি ভালো পরিবেশে বেড়ে উঠবে, শিক্ষার সুযোগ, ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারবে, কম্পিউটারের কাজ জানবে—এমন স্বপ্নই দেখেন এই শরণার্থীরা। অবশ্য তাঁদের এই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হুমকিতে। আমেরিকাকে বাঁচাতে হলে শরণার্থীদের থামাতে হবে—এমনটাই মনে করেন ট্রাম্প। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার চলতি নিয়ম বাতিলের পরিকল্পনা করেছেন তিনি। ট্রাম্প বলেন, ‘আমেরিকার নাগরিক নন, এমন যে–কেউ এসে সন্তান জন্ম দিলেই সেই সন্তান আমেরিকার নাগরিকত্ব দাবি করতে পারে। এই নিয়ম অত্যন্ত হাস্যকর, এটি বন্ধ হওয়া উচিত।’

আমেরিকার এই নীতি দেড় শ বছরের পুরোনো। এতে বলা হয়েছে, আমেরিকার মাটিতে জন্মগ্রহণ করলেই দেশটির নাগরিকত্ব পাবে। যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে ১৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে এই নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করা আছে।

মেক্সিকো সীমান্তে বসে এখনো ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা মারিসল আশা করছেন, তাঁর অনাগত সন্তান যুক্তরাষ্ট্রে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সে দেশের নাগরিকত্ব পাবে।

আসলে মারিসলের জীবনের গল্পটা হৃদয়বিদারক। তবে শরণার্থীদের জন্য এমন গল্প নতুন নয়। মেক্সিকো হয়ে প্রায় সাত হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু যুক্তরাষ্ট্রর ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে হেঁটে আসছেন। তাঁদের লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় প্রার্থনা। তাঁদের অনেকেরই অতীতে রয়েছে এমন কোনো না কোনো ঘটনা।

দুই মাস আগে একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করতেন মারিসল। সংসারে খুব বেশি সচ্ছলতা ছিল—এমনটা বলা যায় না। তবে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে একটা পরিবার ছিল। নতুন অতিথির আগমন নিয়ে একটা স্বপ্নও ছিল তাঁদের। হঠাৎ সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়। চাঁদাবাজদের সঙ্গে কাজ না করায় প্রাণ দিতে হয় মারিসলের স্বামীকে। এরপর মারিসলকেও দেওয়া হতে থাকে প্রাণনাশের হুমকি। দুই সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার মতো অবস্থাও ছিল না তাঁর। এমন অবস্থায় অগত্যা একদিন দুই সন্তানকে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে পাড়ি জমান মারিসল। অনাগত সন্তান ওই দেশের নাগরিকত্ব পেলে হয়তো ফিরবে অবস্থা।

দুই সপ্তাহ ধরে খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়েছেন মারিসল। প্রতিদিন প্রায় ১০ ঘণ্টা করে হাটতে হচ্ছে তাঁকে। রাস্তা অনেক দূর। পৌঁছাতে পারবেন কি না সন্দেহ আছে তাঁর। একেক সময় সব বাদ দিয়ে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে হয় মারিসলের। বুঝতে পারেন, এভাবে সম্ভব নয়।

নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার চলতি নিয়ম বাতিলের পরিকল্পনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার চলতি নিয়ম বাতিলের পরিকল্পনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

মারিসলের জন্য এই রাস্তা যেন বেড়ে যায় গত শুক্রবার। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সমস্যা সমাধানের জন্য মেক্সিকোকে চাপে রেখেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এই চাপের মুখে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের সাময়িক কাজের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে মেক্সিকো।

মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট পেনা নিটো বলেন, অভিবাসনপ্রত্যাশীরা মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলের চিয়াপাস ও ওয়াক্সাকা—এই রাজ্য দুটিকে বসবাসের জন্য বেছে নিতে পারবেন। এ ছাড়া শরণার্থীদের সাময়িক আইডি কার্ড, চিকিৎসাসেবা ও তাঁদের শিশুদের শিক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে। তবে মারিসল মনে করেন, চিয়াপাস ও ওয়াক্সাকায় থাকা আর হন্ডুরাসের থাকা একই। তাঁর মতো অনেক নারীই আছেন, তাঁরা চান সন্তান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হোক। তাঁদের একজন বলেন, ‘ঈশ্বর জানেন যে এটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়। কেবল পরিবারের ভালোর জন্য এমনটা চাই আমরা।’

বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তাঁর আইন বিশেষজ্ঞরা তাঁকে নিশ্চিত করেছেন, তেমন কোনো সংশোধনীর প্রয়োজন নেই। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমেই জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার চলতি নিয়ম বাতিল করতে পারবেন তিনি। তবে প্রেসিডেন্ট তাঁর একক ক্ষমতাবলে এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন কি না, এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন মহলে চলছে তর্ক-বিতর্ক।

এই সংশোধনীর প্রথম বাক্যতেই বলা আছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী সব ব্যক্তিই দেশটির নাগরিক হবে। সে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যেখানেই বসবাস করুক, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়।’

আইন বিশেষজ্ঞদের বেশির ভাগই মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার বাতিল করতে পারেন না। ভার্জিনিয়া আইন স্কুলের অধ্যাপক এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ কৃষ্ণ প্রকাশ বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন কিছু করছেন, যা অনেক মানুষকে আঘাত করবে। তবে শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালতে যাবে এবং আদালতই সিদ্ধান্ত দেবেন বলে মনে করেন তিনি।

অভিবাসন নিয়ে কট্টরপন্থীরা বলছেন, এই ব্যবস্থা অবৈধ অভিবাসনের জন্য ‘চুম্বক’ হিসেবে কাজ করে থাকে এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সীমান্ত অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্র আসতে উৎসাহিত করছে। ট্রাম্প বলেছেন, জন্ম নেওয়া শিশুটি ৮৫ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সব সুবিধা ভোগ করবে, এটা বন্ধ হতে হবে।

২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ আমেরিকান জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের সুযোগ রাখার পক্ষে রয়েছেন। এই সুযোগ বাতিলের পক্ষে আছেন ৩৭ শতাংশ আমেরিকান।