আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভীতি বনাম আশা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী মঙ্গলবারের নির্বাচনকে অবৈধ অভিবাসন প্রশ্নে তাঁর অনুসৃত নীতির ওপর একটি গণভোটে রূপান্তরিত করেছেন। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অভিবাসন প্রশ্নে ভর করেই তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস, একইভাবে মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবলিকান বিপর্যয় ঠেকানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে।

অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক পার্টি তাদের মূল বিষয় হিসেবে স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিয়ে প্রচারণায় আগাচ্ছে। সব জাতীয় জনমত জরিপ অনুসারে, এই মুহূর্তে মার্কিন নাগরিকদের জন্য প্রধান বিবেচনা স্বাস্থ্য পরিচর্যা। গত আট বছর রিপাবলিকান পার্টি ও এর নেতৃত্ব সব শক্তি নিয়োগ করা সত্ত্বেও ওবামাকেয়ার নামে পরিচিত স্বাস্থ্যবিমা কর্মসূচি বাতিল করতে পারেনি; বরং এই কর্মসূচি আগের চেয়ে অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আগে থেকে কোনো অসুখ বা স্বাস্থ্যসমস্যা থাকলেও বিমা অস্বীকার করা যাবে না বা এই কারণে বিমার মূল্য বাড়ানো যাবে না, ওবামাকেয়ারে অন্তর্ভুক্ত এই শর্ত উভয় দলের ভোটারদের কাছেই জনপ্রিয়।

ওবামাকেয়ার এখন এতটাই জনপ্রিয় যে অনেক রিপাবলিকান প্রার্থী, যাঁরা একাধিকবার এই বিমা বাতিল করার পক্ষে ভোট দিয়েছেন, তাঁরাও বলছেন নির্বাচিত হলে ওবামাকেয়ার রক্ষা করবেন।
উভয় রণকৌশল অংশত কাজে দিচ্ছে। ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টির জন্য নির্বাচনী প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দু হলো দেশের শ্বেতকায় প্রধান গ্রামীণ এলাকা। ‘ট্রাম্প রাজ্য’ হিসেবে পরিচিত এই সব অঞ্চলে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। এই সব অঞ্চলের ভোটারদের মনে সব ধরনের অভিবাসী বিষয়ে ভীতির সঞ্চার করতে ট্রাম্প একের পর সাবধানী বাণী উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কয়েক হাজার মানুষের কাফেলা—ট্রাম্পের ভাষায় ‘ক্যারাভান’-যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় প্রার্থনার লক্ষ্যে মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তের দিকে এগিয়ে আসছে।

ট্রাম্প দাবি করেছেন, এটি আমেরিকার বিরুদ্ধে এক ‘অভিযান’। কোনো প্রমাণ ছাড়াই তিনি বলেছেন, এদের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসীরা রয়েছে। এমন কথাও বলেছেন যে কাফেলার অন্তর্ভুক্ত স্বাস্থ্যবান যুবকেরা আমেরিকার নারীদের জন্য হুমকিস্বরূপ। এদের ঠেকাতে তিনি ইতিমধ্যে ৫ হাজার ২০০ সৈন্য মোতায়েন করেছেন। এই সংখ্যা বেড়ে ১৫ হাজার হতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন। প্রয়োজন হলে এই সব সৈন্য আশ্রয়প্রার্থীদের ওপর গুলি চালাতে দ্বিধা করবে না বলে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন।

উল্লেখযোগ্য এই কাফেলা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত থেকে প্রায় দুই হাজার মাইল দূরে এবং হেঁটে আসা মানুষের সংখ্যা ইতিমধ্যে কমে ৩ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে।

বুধবার এক নির্বাচনী সভায় ট্রাম্প বলেন, ‘অবৈধ অভিবাসীরা আমেরিকা দখল করে নিচ্ছে, বিশাল ক্যারাভান আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। এদের ঠেকাতে হলে মঙ্গলবার রিপাবলিকান প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিন।’
ওয়াশিংটন পোস্ট ট্রাম্পের এই নির্বাচনী রণকৌশল প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছে, ট্রাম্প ও রিপাবলিকান দলের লক্ষ্য আমেরিকানদের বলা, ভীত হও। বিদেশি আসছে, তাদের ঠেকাতে প্রস্তুত হও।

অভিবাসন প্রশ্নটি যাতে ভোটারদের কেন্দ্রীয় বিবেচনায় পরিণত হয়, সে জন্য ট্রাম্প নিত্য-নতুন অভিবাসনবিরোধী প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সর্বশেষ প্রস্তাব, মার্কিন শাসনতন্ত্রে স্বীকৃত জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অধিকার বাতিল। তিনি জানিয়েছেন, কলমের এক খোঁচায় তিনি এই শাসনতান্ত্রিক বিধান বাতিল করতে পারেন। তাঁর এই দাবি এতটাই অবাস্তব যে রিপাবলিকান স্পিকার পল রায়ান পর্যন্ত ট্রাম্পকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের ক্ষমতা তাঁর নেই, এর জন্য প্রয়োজন শাসনতান্ত্রিক সংশোধনী।

ট্রাম্পের অতি-উত্তপ্ত এবং বর্ণবাদী ও জাতিবিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ফলে দেশের ভেতরে সহিংসতা বাড়ছে, এ কথা অনেকেই বলছেন। গত সপ্তাহে পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গে এক ব্যক্তি ইহুদিদের প্রতি বিদ্বেষবসত একটি সিনাগগে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে ১১ ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনার পর ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, তিনি ‘গলার স্বর কিছুটা নিচু করার চেষ্টা করছেন’। কিন্তু ২৪-ঘণ্টাও লাগেনি সে কথা বদলে যেতে। এক দিন আগে তিনি নিজের ৫৫ মিলিয়ন টুইটার অনুসারীর কাছে একটি ভিডিও বিলি করেন। এতে খুনি হিসেবে শাস্তিপ্রাপ্ত একজন অবৈধ অভিবাসীর ছবি দেখিয়ে বলা হয়েছে, ডেমোক্র্যাটরা চান এ রকম মানুষকে আশ্রয় দিতে।

ভিডিওটি এতটাই বর্ণবাদী ও মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে নির্মিত যে একাধিক রিপাবলিকান নেতা পর্যন্ত এর প্রচারে নিন্দা করেছেন। ওহাইয়োর রিপাবলিকান গভর্নর জন কেইশিচ বলেছেন, এমন নির্লজ্জ বর্ণবাদী ভিডিও আগে কখনো তিনি দেখেননি। ‘এই ভয়াবহ বিজ্ঞাপনটির একটিই উদ্দেশ্য, আর তা হলো মানুষের মনে ভীতি জাগানো।’

ট্রাম্প ও রিপাবলিকান পার্টির এই পরিকল্পিত প্রচারণার বিপরীতে ডেমোক্রেটিক পার্টির খুব স্পষ্ট জবাব এখনো নজরে পড়েনি। অভিবাসন প্রশ্নটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, সে কারণে অভিবাসনের পক্ষে কোনো বক্তব্য দেওয়া থেকে তাঁরা বিরত রয়েছেন। এই প্রশ্ন এড়িয়ে তাঁরা স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিষয়টি নিজেদের প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন। তাঁরা বলছেন, ভীতির বদলে আমেরিকানদের মনে তাঁরা আশার বার্তা পৌঁছে দিতে চান। ডেমোক্রেটিক নেতা ন্যান্সি পেলসি বলেছেন, আমেরিকার মানুষের প্রধান সমস্যা স্বাস্থ্য পরিচর্যা। এ বিষয় থেকে তাদের দৃষ্টি এড়াতে রিপাবলিকানরা অভিবাসন প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন।

ডেমোক্র্যাটরা জানিয়েছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে গেলে তাদের সর্বাগ্রধিকার হবে ট্রাম্প প্রশাসনের কবল থেকে স্বাস্থ্যবিমা রক্ষা। সর্বশেষ জাতীয় জরিপ অনুসারে ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করে স্বাস্থ্যবিমা প্রশ্নে ডেমোক্র্যাটদের প্রতি তারা অধিক আস্থাবান। এই আস্থা তাঁদের জন্য নির্বাচনী বিজয়ে পরিণত হয় কি না, এখন সেটাই দেখার বিষয়।