আমেরিকার বাঙালি মেম

পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কলির মতন আমার মনটা আসলেই সে রাতে জেগে উঠেছিল! তা না হলে এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে আমি কেন দেড় ঘণ্টা ওই কফির দোকানে বসেছিলাম? সে রাতে বেশ ঠান্ডা পড়েছিল। ভাবলাম এক কাপ কফি কিনি। স্টারবাকস নামের এক কফির দোকানে ঢুকলাম। আমি সাধারণত স্টারবাকসের কফি খাই না, কারণ আমি একজন দরিদ্র মানুষ। চার ডলারে এক কাপ কফি খাওয়া আমার মানায় না, আমার কাছে এটাকে এক ধরনের বাহুল্য বলে মনে হয়! তারপরও মাঝেমধ্যে এক কাপ দামি ভালো মানের কফির জন্য আমার মনটাও টানে!
বাংলাদেশে থাকতে একবার গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছি। আমাদের জমি দেখাশোনা করেন এমন এক বৃদ্ধ আমার কাছে সিগারেট চাইলেন। আমি তাকে একটা বেনসন সিগারেট দিলাম। তিনি সে সিগারেট হাতে নিয়ে পকেটে পুরে রাখলেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সিগারেট ধরালেন না কেন?’
বৃদ্ধ বললেন, ‘বাবা, আজকে দুপুরে আপনাদের বাড়িতে শিন্নি। শিন্নি খাওনের পর সিগারেটটা খামু। দামি জিনিস! এমনিতে খাওয়া ঠিক না।’
সেই বৃদ্ধের কথা শুনে আমি সেদিন অবাক হয়েছিলাম। তুচ্ছ তিন টাকা দামের এক শলা সিগারেটের জন্য কত আয়োজন!
কফি কিনতে দোকানে ঢুকেছি, কাউন্টারে টাকা দিয়ে বের হতে যাব, প্রকৃতি আমাকে আটকে দিল। তখন রাত প্রায় নয়’টা। বাইরে প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। সমস্যা হল, আমার সঙ্গে ছাতা নেই। বৃষ্টিতে ভিজে এক দৌড়ে গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়তে পারি, অল্প একটু জায়গা হাঁটতে হবে কিন্তু কেন জানি ইচ্ছে করল না! অদ্ভুত এক ধরনের আলস্য আমাকে ঘিরে ধরল! আমেরিকান বৃষ্টি বিরক্তিকর! তবে গত রাতের বৃষ্টি ছিল কিছুটা অন্য ধাঁচের! অনেকটা বাংলাদেশের বৃষ্টির মতো। আষাঢ় মাসের বৃষ্টি। যে বৃষ্টির মধ্যে এক ধরনের তাল আছে, আছে ছন্দ, আর আছে নস্টালজিয়া যাতে লুকিয়ে আছে আনন্দ, বেদনা, স্মৃতি, আকুলতা, বিষণ্নতা—আরও কত কিছু। শ্রাবণ মাসে জন্মের কারণেই হয়তোবা আমি বৃষ্টিপ্রেমী মানুষ।
আমার আমেরিকান স্ত্রী (বাংলাদেশি আমেরিকান) আমার বৃষ্টি প্রেম দেখে প্রায়ই অবাক হয়। আমাকে প্রশ্ন করে , ‘what is so special about stupid rain?’
আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিই না, বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসি! বৃষ্টি নিয়ে এই মেয়ের কোনো আনন্দস্মৃতি নেই ! তার সঙ্গে কথা বলা অনর্থক।
কফির দোকানের দেয়ালগুলো কাচের। আমি এক কোনায় বসলাম। ছোট ছোট চুমুকে ধোঁয়া ওঠা গরম কফি খাচ্ছি। আমার চোখ দোকানের বাইরে। ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। আমার পাশের চেয়ারে এক বিদেশিনী এসে বসলেন। বসার আগে ভদ্রতার খাতিরে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘মে আই সিট নেক্সট টু ইউ?’
আমি বললাম, ‘অফকোর্স, হ্যাভ এ সিট!’
তারপর আমি আমার ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমি আধুনিক যুগের ডিজিটাল আড্ডাবাজ মানুষ। হোয়াট্‌স অ্যাপে আমাদের একটি গ্রুপ আছে, সেখানে আমরা সবাই নার্সারি ওয়ানের ক্লাসমেট। রাত দিন চব্বিশ ঘণ্টা আড্ডা চলে। তার কারণ, একমাত্র আফ্রিকা ছাড়া আমরা সবাই মোটামুটি এই পৃথিবীর সব কটি মহাদেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছি।
বিদেশিনী কথা বলতে শুরু করলেন। আমি প্রথমে ভাবলাম ফোনে কথা বলছেন, পরে দেখি ফোনে না, আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন।
ভদ্রতার খাতিরে তাঁর দিকে তাকালাম। ৬৫/৭০ বছর বয়সী শ্বেতাঙ্গ মহিলা, এককালে অতি সুশ্রী ছিলেন বোঝা যায়। সে রূপের কিছুটা এখনো রয়ে গেছে। অসম্ভব সুন্দর নীল চোখ। তবে সে চোখের কোথায় যেন বিষাদের ছায়া লুকিয়ে আছে!
ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন , ‘দেখছ? কী চমৎকার বৃষ্টি হচ্ছে?’ আমি শ্রাগ করলাম। কিছু বললাম না। এসব বুড়িদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করা অর্থহীন এবং এরা যন্ত্রণাবিশেষ!
এবার বিদেশিনী আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার দেশ কোথায়?’
আমি মনে মনে বললাম, এই শুরু হল। এখন নানান প্রশ্ন করবে। যেমন দেশ কোথায়, কবে এখানে এসেছি, কী করি? কী যন্ত্রণা!
এ দেশে আসার পর এই প্রশ্ন আমাকে অন্তত লক্ষবার শুনতে হয়েছে। আমি একটু বিরক্ত হয়ে তাঁকে বললাম, ‘আই এম ফ্রম বাংলাদেশ।’
উনি অতি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘রিয়েলি?’ আমি অবাক হলাম! এত উচ্ছ্বাস (!) দেখানোর তো কিছু নেই। যে কফির দোকানে বসে আছি, তার কাউন্টারেই দুটি বাংলাদেশি মেয়ে কাজ করছে। সারা নিউইয়র্ক শহর বাংলাদেশিতে ভরা। বিদেশিনী বললেন, ‘You know I miss Bangladesh a lot!’ তাঁর মুখে এ কথা শুনে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। এর সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশ মিস করছেন কেন? সেটা জানতে ইচ্ছে করছে!
ভদ্রমহিলা কথা বলতে শুরু করলেন। তাও বাংলায়! মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আমাকে বললেন,‘আপনার নাম ?’
আমি নাম বললাম। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন, ‘আমি এপ্রিল সামার্স।’
আমি হাঁ করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বিগত সতেরো বছরের প্রবাস জীবনে আমি কোনো বিদেশির মুখে এত পরিষ্কার আর স্পষ্ট বাংলা কখনো শুনিনি। তার কথায় বিদেশি টান আছে এবং সেটা স্বাভাবিক। আমিও তো আমেরিকানদের মতন ইংরেজি বলি না। ইংরেজি আমার মাতৃভাষা না! টান থাকবেই!
এপ্রিল সামার্স বললেন, ‘আমার বাংলা শুনে আপনি নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন?’
আমি বললাম, ‘অবাক হওয়াটা কি অনুচিত?’
তিনি হেসে বললেন, ‘আমি বাংলাদেশে ছিলাম প্রায় ১০ বছর। আমেরিকান দূতাবাসে চাকরি করতাম। ১০ বছরে একবারও আমেরিকায় আসিনি। জানেন? যখনই আমার ভ্যাকেশন থাকত, আমি আমার ড্রাইভারকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। পুরো বাংলাদেশ আমি চষে বেড়িয়েছি। সুন্দরবন, কক্সবাজার, সিলেট, খুলনা—কিছুই বাদ দিইনি। আমি যখনই কোনো বাংলাদেশির সঙ্গে তাঁর দেশ নিয়ে কথা বলি, আমি খেয়াল করে দেখেছি A loving bling comes into their eyes!’
কথাগুলো তিনি ইংরেজিতে বললেন।
আমি তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, ‘Do you see that loving bling in my eyes?’
সামার্স হেসে বললেন, ‘অফকোর্স। আপনার চোখ এখনো চকচক করছে।’
আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন বাংলাদেশ আপনার এত ভালো লাগল আমাকে বলুন?
এপ্রিল সামার্স কথা বলতে শুরু করলেন।
‘বাংলাদেশি হিসেবে আপনারা খুব সরল আর বন্ধুবৎসল মানুষ। আমি পররাষ্ট্র দপ্তরে ৩৫ বছর চাকরি করেছি। অনেক দেশে থেকেছি, তবে বাংলাদেশিদের মতো সহজ–সরল আর বন্ধু বৎসল মানুষ আর কোথাও দেখিনি। গরিব দেশ আপনাদের, টাকা পয়সা তেমন নেই, নানা সমস্যায় জর্জরিত, দুটো রাজনৈতিক দল বাংলাদেশের মানুষকে জিম্মি করে রেখেছে! তারপরও আপনারা হাসতে জানেন! কেন এ কথাগুলো আপনাকে, বললাম সেটা বলি?’
নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সামার্স ভুরু কুঞ্চিত করে আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা, আপনার হাতে কি সময় আছে? নাকি আপনাকে উঠতে হবে? এই শহরের মানুষগুলো সব সময় ব্যস্ত!’
আমি বললাম, ‘আপনি বলুন। আমি ভোর পাঁচটা পর্যন্ত আপনাকে সময় দিতে পারব।’ এ কথা শুনে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। আমাকে বললেন, ‘আপনি রসিক মানুষ! শুনুন তাহলে, একবার আমি আর আমার গাড়ির চালক চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছি। রাস্তায় আমাদের গাড়ি খারাপ হয়ে গেল। কোনোভাবেই নড়ে না! ইঞ্জিন ভোঁ ভোঁ শব্দ করে কিন্তু গাড়ির কোনো নড়াচড়া নেই। আমি গাড়িচালক সুরুজ মিয়াকে বললাম, সুরুজ, কী হয়েছে? সে যা বলল তা শুনে আমার হাত–পা ঠান্ডা হয়ে গেল। সুরুজ বলল, ম্যাডাম এ-স্কেল (এক্সেল) খারাপ হয়েছে, করার কিছু নাই আপনে গডকে ডাকেন।
সুরুজ আমার গাড়ি চালায় প্রায় পাঁচ বছর। তার কথাবার্তায় সে প্রায়ই ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে যা আমার কাছ থেকে শিখেছে। আমি তাকে বললাম, এখন উপায় কী? সে বলল, আপনেরে বাসে তুইলা দিই? আপনে ঢাকা যানগা। আর আমি মেকানিক আনতে চৌমুহনী যাইতেছি। জানেন? আমি বাসে চড়তে প্রচণ্ড ভয় পাই। আপনাদের দেশের পেপার খুললেই শুধু বাস দুর্ঘটনার ছবি থাকে। আমি সুরুজকে বললাম, আমি গাড়িতে বসি তুমি মেকানিক নিয়ে এসো। সুরুজ বলল, ইমভুসিপুল (ইম্পসিবল), কি উল্টাপাল্টা টক করতেছেন? সুরুজ কিছুটা রেগে বলল, আপনেরে এভাবে রাইখা আমি কোথাও যামু না।
ততক্ষণে আমাদের গাড়িকে ঘিরে অনেক লোকজন জমে গেছে। তারা আমাদের কথাবার্তা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আমি দীর্ঘদিন বাংলাদেশে থেকে দেখেছি, বাংলাদেশিরা জটলা পাকাতে পছন্দ করে। একবার মহাখালীতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আনারস খাচ্ছি। আমাকে অন্তত ১০ জন লোক ঘিরে ফেলল। আমি তখন বাংলাদেশে নতুন। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে অবশ্য গা-সওয়া হয়ে গেছে। গাড়িতে বসে আছি। প্রচণ্ড গরম লাগছে। জটলার মাঝ থেকে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। তারপর আমাকে বললেন ম্যাডাম, আপনে আমার বাসায় আইসা বসেন। আমি এই গ্রামের একজন স্কুল মাস্টার। আপনার গাড়ি সারা হয়ে গেলে আমি নিজে আপনাকে নিয়ে আসব। লোকটির কথা বলার ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল যে আমি রাজি হয়ে গেলাম। তার বাড়ি কাছেই, হেঁটে যেতে আমাদের মাত্র ১০ মিনিট সময় লাগল। তার বাড়িতে পৌঁছানোর পর তাঁর স্ত্রী আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।’
মাস্টার সাহেব স্ত্রীকে বললেন, ‘বিদেশি মেহমানরে অন্দর ঘরে নিয়ে বসাও। চা পানি দেও। বেচারির গাড়ি নষ্ট হয়া গেছে। বিদেশি মানুষ, রাস্তাঘাটে এইভাবে একলা থাকাটা ঠিক না!’
এ কথা শুনে মাস্টার সাহেবের স্ত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। যেন আমি তার অতি পরিচিত কেউ? তা ছাড়া আমি চমৎকার বাংলা বলতে পারি, আমাদের ভাব আদান–প্রদানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বইন-গো’ আপনের কি খিদা লাগছে?’ আমি না বললাম। যদিও তখন আমার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে, কিন্তু বলতে লজ্জা লাগছিল। বাংলাদেশে থেকে থেকে আমার মধ্যেও কিছুটা বাংলাদেশি ভাব এসে পড়েছে। আমি খেয়াল করে দেখেছি, আপনাদের দেশীয় ভদ্রতা হচ্ছে কেউ আপনাকে কিছু খেতে বললে লোকজন প্রথমেই না বলে অথচ তার খাবার ইচ্ছে আছে। মাস্টার সাহেবের স্ত্রী আমার কথার ধার ধারলেন না। তিনি তাঁর ছোট ছেলেকে তাদের পোষা সবচেয়ে বড় মুরগিটি জবাই করতে বললেন। তারপর আমাকে বললেন, বইন আপনে সিনান করবেন?
আমি সিনানের মানে প্রথমে বুঝলাম না। মাস্টার সাহেব বুঝিয়ে বললেন, গোসল করবেন আপনি? আমাদের বাড়ির পেছনে চমৎকার ঘাঁটওলা পুস্কুনি আছে। প্রচণ্ড গরম পড়েছে, গোসল করলে শরীরে আরাম পাবেন। আমি আপনার জন্য ডাবের ব্যবস্থা করতেছি। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনি ডাব চেনেন তো? ডাব হইলো গিয়া গ্রিন কোকোনাট।
আমি হেসে বললাম, ‘আমি ডাব চিনি মাস্টার সাহেব। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। তাঁদের এ ব্যবহার দেখে আমার এত ভালো লাগল, আমি আপনাকে তা বলে বোঝাতে পারব না। আমি গোসল করতে রাজি হলাম। আমি তখন তাদের ভালোবাসার অত্যাচারে পুরোপুরি অতিষ্ঠ। কিন্তু আমার খুব ভালো লাগছিল। প্রতিটি মুহূর্ত আমি উপভোগ করছিলাম, আর মনে মনে দোয়া করছিলাম যেন গাড়িটি ঠিক না হয়, হা হা হা।’
তারপর ভদ্রমহিলা বললেন, ‘বিগত ১০ বছরে যাদের সঙ্গে বাংলাদেশে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে, তাঁরা সবাই পয়সাওয়ালা মানুষ। এ রকম নির্মোহ বাংলাদেশি কোনো পরিবারের সঙ্গে আগে এত ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ আমার কখনো হয়ে ওঠেনি। মাস্টার সাহেবের স্ত্রী তাদের লিভিং রুমের শোকেস খুলে একটি DOVE সাবান বের করে দিলেন যা তাদের বড় ছেলে মালয়েশিয়া থেকে পাঠিয়েছে। তিনি সে সাবান কখনো ব্যবহার করেননি। সাবান কেন লিভিং রুমের শোকেসে রাখা, তার কারণ আমি অনেক ভেবেও বের করতে পারলাম না। তিনি আমাকে নিয়ে বাড়ির পেছনে গেলেন। তাদের বাড়ির পুকুর দেখে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমি আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের মেয়ে। ছোটবেলা টমবয় টাইপের ছিলাম। এ রকম ছোট পণ্ডে অনেক সাঁতার কেটেছি। আমি পুকুরে নেমে পড়লাম, ইচ্ছেমত বেশ কিছুক্ষণ পানিতে সাঁতার কাটলাম।
গ্রামের আশপাশের বাড়ির মেয়েরা তখন ঘাটে এসে জড়ো হয়েছে। তারা এই বিদেশিনীর কাণ্ডকারখানা দেখছে উৎসুক চোখে। আমি সাবান মাখতে ঘাটে ফিরে এলাম। কিন্তু নিজের গায়ে নিজে সাবান লাগাতে পারলাম না। গ্রামের এক মহিলা প্রায় জোর করে আমার হাত থেকে সাবান নিয়ে আমার সারা গায়ে লাগিয়ে দিলেন।
আমার দীর্ঘ ৬৩ বছরের জীবনে এত আরামে আমি কখনো গোসল করিনি। গোসল সেরে ঘরে ফিরে এলাম। লিভিং রুমে মাস্টার সাহেবের সঙ্গে আলাপ হল। খাবার তখনো রান্না হয়নি। ওনার দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে মালয়েশিয়া থাকে, আর মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকে। কিছুক্ষণ আলাপের পর খেতে বসলাম। খাবারের আয়োজন ছিল সামান্য কিন্তু অতি উপাদেয়।
আমি সামার্সকে প্রশ্ন করলাম, ‘কী দিয়ে খেলেন মাস্টারের বাড়িতে?’ বললেন, ‘ঝাল চিকেন কারি, ডাল, আলু ভাজি আর ভাত। এত মজার চিকেন কারি আমি এর আগে কখনো খাইনি।’ হেসে চোখ বড় বড় করে বললেন, তবে ঝালের মাত্রা একটু বেশি ছিল। ভাত খাওয়ার পর মাস্টার সাহেবের স্ত্রী আমাকে পান এনে দিলেন, আমি পান খেলাম।’
আমি হতভম্ব হয়ে বিদেশিনীকে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনি পান খান?’
‘হ্যাঁ, অবাক হলেন মনে হচ্ছে? আমার গাড়িচালক সুরুজ আমাকে পান খাওয়া শিখিয়েছে, তবে আমি মিষ্টি পান খাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মাস্টারের বাড়ির পান খেয়ে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। তাঁর স্ত্রী ভয় পেয়ে গেলেন। পাখা দিয়ে আমার মাথায় বাতাস করতে লাগলেন, আরেকজন পানি আর তেল মিশিয়ে আমার পায়ের তলায় ঘষতে লাগল। বলা বাহুল্য, আমি খুব আরাম পাচ্ছিলাম। সে রাতে আমাদের গাড়ি ঠিক হয়ে যায়। আমরা ঢাকায় ফেরত আসি। ফেরার সময় মাস্টার সাহেবের স্ত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। আমি প্রচণ্ড মন খারাপ করে গাড়িতে উঠলাম। অপরিচিত একটি পরিবারের কাছ থেকে এমন ভালোবাসা আমি কখনো আশা করিনি। আমি সেদিন প্রতিজ্ঞা করলাম, পরিবারটির জন্য আমি কিছু করব।’
আমি সামার্সকে বললাম, ‘কী করলেন তাঁদের জন্য?’ তিনি বললেন, ‘সে গল্পে পরে আসছি। জানেন, বাংলাদেশি খাবার আমার খুব প্রিয়। তবে সবচেয়ে পছন্দের খাবার হচ্ছে ইলিশ মাছ আর মিষ্টি দই। ও বলতে ভুলে গেছি, বিয়ে বাড়ির কাচ্চি আর বোরহানিও আমার প্রিয়।’
আমি সামার্সকে বললাম, আপনি নিউইয়র্কে আছেন, যে খাবারগুলোর নাম বললেন তার সবকিছুই তো এখানে পাওয়া যায়। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি উটাহতে থাকি। আমার মেয়ে এখানে থাকে, তাকে দেখতে এসেছি। তা ছাড়া আমার সময়ও ফুরিয়ে এসেছে। আমার আয়ুষ্কাল ঘড়িতে বাঁধা।’
আমি হেসে বললাম, ‘আপনার আয়ুষ্কাল ঘড়িতে বাঁধা, এটা তো আপনার জানার কথা না। আমরা কেউই সেটা জানি না।’ আমার কথার জবাবে তিনি যা বললেন তা শুনে আমার মন প্রচণ্ড খারাপ হল। বাংলাদেশপ্রেমী এই মানুষটি ক্যানসারের রোগী। তাঁর ওভারিতে ক্যানসার। স্টেজ ফোরে ধরা পড়েছে। কেমোথেরাপির চিকিৎসা শেষ হয়েছে। লাভের লাভ কিছুই হয়নি, ক্যানসার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকেন। কোনো কোনো দিন শরীরটা ভালো থাকে। তখন মনে হয় শরীরে কোনো রোগ নেই! আজকের দিনটাও সেরকম।
এপ্রিল সামার্স আরও অনেক কিছু বললেন। তাঁর গাড়িচালক সুরুজ মিয়া আর বাবুর্চি ময়না মিয়ার সঙ্গে এখনো যোগাযোগ আছে, মাঝেমধ্যে আলাপ হয়। সুরুজের চার মেয়ের পর ছেলে হয়েছে। সেই খবর তিনি আমাকে খুব আনন্দের সঙ্গে দিলেন এবং সুরুজের পাঠানো ছবিও দেখালেন। ছবিতে সুরুজের ছেলে তাঁর ছবি চুষে খাচ্ছে।
এপ্রিলের বাবুর্চি ময়না মিয়ার মায়ের টিউমারের সফল অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। সেই ছবিও দেখালেন। ছবিতে এক বৃদ্ধা বাংলাদেশের কোনো এক হাসপাতালের ওয়ার্ডে ট্রাঙ্ক গোছাতে ব্যস্ত।
আমি এপ্রিলকে বাংলাদেশি রেস্তোরাঁগুলোর ঠিকানা দিলাম। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে তা লিখে রাখলেন। আমাকে উঠতে হবে। কীভাবে দুঘণ্টা কেটে গেছে টের পাইনি। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁর কথা শুনেছি। এপ্রিলের সঙ্গে এ জীবনে হয়তো আর দেখা হবে না। আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি, তাঁরা নিজের দেশকে বুকের ভেতর লালন করি। আমার জানা ছিল না, এই ভিনদেশিও আমার দেশকে গভীর ভালোবাসায় বুকে আগলে রেখেছেন।
আমি এপ্রিলকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওই পরিবারের জন্য কী করলেন তাতো বললেন না?’ তিনি বললেন, ‘আমার চাকরি জীবনের শেষ যে ভিজিট ভিসাটি ইস্যু করেছিলাম, সেটি ছিল মাস্টার সাহেবের ছেলের। সে এখন লস অ্যাঞ্জেলেসে আছে। বাংলাদেশি আমেরিকান এক মেয়ের সঙ্গে ভাব হয়েছে, হয়তোবা তাদের বিয়ে হবে। আমাকে সে মাঝে মধ্যে ফোন করে খোঁজখবর নেয়।’
এবার এপ্রিল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাকে এখন উঠতে হচ্ছে। আমার মেয়ে কিছুক্ষণ পর বাসায় ফিরবে। আমি তাঁকে বললাম, আপনি কোথায় থাকেন? যদি চান, আমি আপনাকে নামিয়ে দিতে পারি। আমার গাড়ি আছে।’
এই বিদেশিনী বললেন, ‘প্রয়োজন নেই। আমি এই ভবনের ছয় তলায় থাকি। আমিও উঠে পড়লাম। কাজে ফেরত যেতে হবে। আমি আর তিনি তখন দোকানের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি।’ অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। এপ্রিল আমার হাত ধরে বললেন, My friend good bye। আমি জানি এই নারীর সঙ্গে এ জীবনে আমার আর কখনো দেখা হবে না। আমি আবেগপ্রবণ মানুষ। আবেগের কাছে সে মুহূর্তে আমার হৃদয় হার মেনেছে, টের পাচ্ছি আমার চোখে অশ্রু জমতে শুরু করেছে, বৃষ্টিতে অনেকখানি ভিজে গেছি। আমি গাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। আমার মনের অবস্থা তখন ছিল এই গানের কথার মতো—
No one understands the heartache
No one feels the pain,
Cos no one ever sees the tears
When you’re crying in the rain.