পরি ও একজন মালতিদি

নারিকেল গাছের চিরল পাতায় দ্বাদশীর চাঁদ দোল খেতেই একটা শীতল বাতাস বয়ে গেল। শীর্ণ নবগঙ্গায় এক অদ্ভুত ঢেউ উঠল। বাতাসে কামিনী ফুলের সৌরভ। ঘুমিয়ে পড়া শহর আজ একটু বেশিই সুনসান। হঠাৎ কোথাও তানপুরার সুর বেজে উঠল। আকাশের একটি দিগ্ভ্রান্ত তারা ওপাশে ছুটে যেতেই সারা আকাশ আলো করে নেমে এল একটি পরি। শ্বেত চন্দনের মতো তার কোমল পা মাটিতে পড়তেই সেখানে কতগুলো কাঁঠাল চাঁপা ঝরে পড়ল। পরিটার পাখা থেকে সোনার মতো আলো মমিন সাহেবের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। বাতাসে তখন চন্দনের সুবাস। বাতাসে আলতো পা ফেলে পরিটা এগিয়ে গেল নবগঙ্গার দিকে। নবগঙ্গায় ঢেউ বাড়ছে। নদীর জলে পা দেওয়ার আগে পরিটা একবার ফিরে চাইল মমিন সাহেবের দিকে। পরির ডানায় সোনার আলো। ছু্ঁয়ে দিল মমিন সাহেবকে।
মোহগ্রস্থের মতো সে ছুটে গেল পরিটার দিকে। জলের বুকে নুপুরের ঝংকার তুলে পরিটা তখন মধ্য নদীতে। মমিন সাহেব তখনো উদভ্রান্তের মতো দিক কাল ভুলে ছুটছে পরির পেছনে। নদীর কিনারে এসে ঝপ করে জলে পড়তেই ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গেল মমিন সাহেব। কোথা থেকে একটা ঘূর্ণি এসে তলিয়ে দিল তাঁকে। জলের নিচে বাতাসের অভাবে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তাঁর। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে ভেসে উঠতে। বুকভরে বাতাস নিতে।
গোঁ গোঁ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল কল্পনার। পাশে ঘেমে নেয়ে ওঠা স্বামীর ছটফটানি দেখে জোরে একটা ঠেলা দিয়ে ঘুম ভাঙাতে চেষ্টা করল।
‘কী হয়েছে?’
উত্তরে কিছু না বলে সদ্য ঘুমভাঙা ষাটোর্ধ্ব মমিন সাহেব নিরুত্তর তাকিয়ে থাকেন। বড় বড় শ্বাস টানেন। বুকের ভেতর সত্যিই বাতাসের অভাব হয়েছিল তার। নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগে।
‘প্রায় রাতেই এমনভাবে গোঙাতে থাকো। কী হয়? শ্বাস নিতে কষ্ট হয়?’
চোখে একটা নিরুত্তর চাহনি নিয়ে মমিন সাহেব তাকান মধ্য চল্লিশের কল্পনার দিকে। জানালা দিয়ে আসা রাস্তাবাতির হালকা আলোতেও কল্পনার মুখটা পরিষ্কার দেখতে পেলেন মমিন সাহেব। খুব উদ্বেগ সেখানে।
‘ঠাণ্ডা লেগেছে। বুকে কফ। ঘুমের মধ্যে তাই নিশ্বাসে কমবেশি হয়। তেমন কিছু না।’ কথা শেষে খুসখুস করে একটু কেশে নেন মমিন সাহেব।
বাড়ির সামনের দিকে দেবদারুর ডালে, নারিকেল গাছের মাথায় অন্ধকার তখনো ঘাপটি মেরে আছে। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মমিন সাহেব সেই অন্ধকারের দিকে চোখ পাতেন। আলোর খোঁজ করেন। সোনার রঙের আলো। পরির ডানার আলো। অন্ধকার সরিয়ে দেওয়া আলো।
আলো এল, দিনের আলো। মমিন সাহেবের মনে বিরক্তি। দিনের আলোতে পরি আসে না।
পরি সবার কাছে আসে না। ছোটবেলায় তার মায়ের কাছে পরি আসত। মায়ের গায়ের রঙ ছিল দুধ সাদা। কোমর ছাপানো চুল আর ঈষৎ বাদামি রঙের চোখে যৌবনে মাকে ইরানি মেয়েদের মতো লাগত। অসম্ভব সুন্দরী ছিলেন বলেই হয়তো মায়ের কাছে পরি আসত। যখন পরি আসত তখন মাকে তাঁর ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখা হতো। কেউ সেখানে যেত না। খুব চুপচাপ হয়ে যেতেন মা। কাউকে চিনতে পারতেন না। মায়ের শরীর দিয়ে তখন কামিনী ফুলের ঘ্রাণ বের হতো। একদিন মমিন সাহেব চুপিচুপি মায়ের ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে সেই ঘ্রাণ পেয়েছিলেন।
মমিন সাহেবের পুরোনো বাড়িতে কামিনী ফুলের এক বিশাল ঝাড় ছিল। মমিন সাহেবের এই তেতলা বাড়ির চেহারা আগের বসতবাড়ির মতো নয়। সে সময় তা ছিল একান্নবর্তী। বাবা-চাচাদের নিয়ে ২৩ জনের এক বিশাল পরিবার। তাঁর মা ছিলেন এ বাড়ির তিন নম্বর বউ। মমিন সাহেবের বড় আব্বা মানে বাবার সবচেয়ে বড় ভাই ছিলেন খুব পরহেজগার মানুষ। মেহেদি লাগানো লাল দাড়ি আর জোব্বায় তাঁর চেহারায় একটা আলাদা নূর ছিল। উনি নিজে পছন্দ করে এ বাড়ির সবচেয়ে আলাভোলা ভাইয়ের বউ করে আনেন মমিন সাহেবের সুন্দরী মাকে। বছর এগারোর মা তখনো প্রায় শিশু। তবে আর পাঁচটা মেয়ের মতো তার পুতুল খেলার শখ ছিল না। তার শখ ছিল গাছ লাগানো। গাছের সঙ্গে ছিল তার অদ্ভুত সখ্য। গাছের সঙ্গে বিড়বিড়িয়ে চলতো তার গল্প। সে গাছের কাছে গেলেই কেবল কলি ফুল হয়ে উঠত। বা তার হাতের পানি পেলেই গাছ ফলবতী হতো। গাছের সঙ্গে সখ্য বাড়াতেই একদিন ভোরে মা একটি কামিনী ফুলের গাছ পুঁতে দেয় বড় আব্বার ঘরের কোনায়। পুব দিকের জানালার ধারে।
তখনো এ গ্রামে কোনো বাড়িতে কামিনী গাছের দেখা মেলেনি। মা সেদিনই প্রথম পরির দেখা পেয়েছিলেন। ভোরের আলো ফোটার আগেই মা অজু করতে পুকুরপাড় গিয়েছিলেন। অন্ধকার তখনো আড়ম্বর করেই দিনকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। পুকুরের একপাশে শিরিষগাছের নিচে কতগুলো গন্ধরাজের ঝাড় ছিল। সেই ঝাড়ের ভেতর কতগুলো জোনাক পোকা আলোর মহড়ায় ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ করেই একটি জোনাক পোকা পরি হয়ে উঠল। বাতাসের বুকে আলতো পা ফেলে মায়ের পাশে এসে থামে। মা ভয় পাননি। পরির বুক থেকে আসা অজানা ফুলের ঘ্রাণে আকুল হয়েছিলেন। পরির ডানা থেকে ঝুরঝুর করে কতগুলো সাদা ফুল ঝরে পড়েছিল। মাতাল করা সুবাসে মা আকুল হয়ে এই ফুলের গাছ চায় পরির কাছে। পরি ডানা থেকে এক টুকরো আলো নিয়ে মায়ের হাতে দেয়। সেই আলো হয়ে ওঠে কামিনী গাছ। সেই গাছের সঙ্গেই এই বাড়িতে বেড়ে ওঠে মা। বড় আব্বার ঘরের পুবদিকের জানালায় এরপর কখনো আঁধার আসেনি। পরির কাছ থেকে পাওয়া আলোয় মা ঝলমল করে কামিনী ফুলের সুবাস গায়ে মাখত সেখানে। আর বড় আব্বা সে আলোর নূর সুরমা করে চোখে মাখত।
মমিন সাহেবের এখন অবসরজীবন। মনের সঙ্গে শরীরও এখন অবসরে যেতে চায়। কাশি আর হাঁপানির টানে নিজের ওপর বীতশ্রদ্ধ তিনি। পাঁজর ব্যথা করা কাশি যখন তার শ্বাস–প্রশ্বাসে আগল দেয় তখন ঘোলাটে চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। নিজের রুগ্নতায় ঘৃণা আসে তার খুব। নিঃসন্তান হওয়ার কারণে বছর পনেরোর ছোট কল্পনার মধ্যে কিন্তু কোনো রুগ্‌ণতা নেই। নেই ক্লান্তি। এখনো যখন বিকেলবেলা জবাকুসুম তেলে পাট করে চুল বেঁধে ইস্ত্রি করা মাড় দেওয়া শাড়ি পড়ে এক কাপ চা নিয়ে মমিন সাহেবের কাছে এসে দাঁড়ায় তখন শরীর আর মনে যে বিদ্যুৎ খেলে যায় তা সামাল দেওয়া বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে মমিন সাহেবের পক্ষে।
সারা বিকেল এই বারান্দায় বসে কী করো? একটু কোথাও বেরোলেও তো পারো। কী ভাব এখানে বসে?’
কল্পনার হাত থেকে চা নিয়ে আবার চুপচাপ সামনের দেবদারু গাছের দিকে মুখ ফিরিয়ে আনেন মমিন সাহেব। কল্পনা জানে না মমিন সাহেব পরির অপেক্ষায় বসে থাকেন এখানে। একটু পরেই থকথকে অন্ধকার জমবে গাছগুলোর মাথায়। আকাশে একটা–দুটো তারা ফুটে উঠবে। আর তখনই আলোর ঘাগরা পড়ে পরি নেমে আসবে।
‘তুমি খুব চুপচাপ হয়ে গেছ। বেশ কিছুদিন আমার সঙ্গে সেভাবে কথাও বলো না। শরীর কি খুব খারাপ?’
শরীরের কথা মনে করিয়ে দিতেই পাঁজর ভাঙা কাশিটা জাগান দেয়। কাশতে গিয়ে চা চলকে পড়ে। কল্পনা কাপটা হাত থেকে নিয়ে নেয়। কাশতে কাশতে পাঁজরে আবার বাতাসের টান পড়ে। বিরক্ত হন মমিন সাহেব। ইশারায় ইনহেলার চান।
‘তুমি ঘরে গিয়ে বসো।’
প্রবল বিরক্তিতে মাথা ঝাঁকান মমিন সাহেব। কল্পনা ইনহেলার আনতে ভেতরে যায়। বুকটা চেপে ধরে মমিন সাহেব হাঁপাতে থাকেন।
দিনের আলো দপ করে নিভে যায়। দেবদারু গাছের মাথায় একটা তারা ফুটে ওঠে। তির তির করে বাতাস বয়ে যায়। একটা হীরামন পাখি উড়ে এসে বসে মমিন সাহেবের বারান্দার রেলিঙে। চন্দনের সুবাস চারপাশে। আকাশে এখন অসংখ্য তারা। নারিকেল গাছের পাতায় শুধু গুমোট অন্ধকার জমাট বাঁধা। একটা তারা ঝরে পড়ল সেই অন্ধকার পাতায়। সোনার আলোয় ভরে গেল জায়গাটা। বাতাসে কাঁঠাল চাঁপা ফুলের সুবাস। নুপুরের ঝমঝম শব্দে এগিয়ে এল পরি। হীরামন পাখির পাশে বসল। মমিন সাহেবের সব রুগ্‌ণতা হারিয়ে গেল। তাঁর পাঁজরে বাতাসের হুটোপুটি। কাঁঠাল চাঁপার সুবাসে আকুল মমিন সাহেব আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল পরির দিকে।
‘হাঁপানির টান কমে গেল?’
ইনহেলার বাড়িয়ে দেয় কল্পনা। কল্পনার চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। অন্ধকার মমিন সাহেবকে ঘিরেও। নিরুত্তর চাহনির সঙ্গে কিছুটা বিরক্তি মেশানো মমিন সাহেবের।
এখন ইনহেলারের দরকার নেই মমিন সাহেবের। এই অন্ধকারও ভালো লাগছে না তার।
বড় আব্বাও অন্ধকার পছন্দ করতেন না। তাই সন্ধ্যা নামতেই সারা বাড়ি আলো দিয়ে ভরে দিতে হতো মাকে। তেলের কুপির আলোয় মাকে তখন একটা পরি মনে হতো মমিন সাহেবের। মাকে যেভাবে মনে পড়ে সেভাবে বাবাকে মনে পড়ে না মমিন সাহেবের। বছরের অধিকাংশ সময় বাবা বাড়িতেই থাকত না। বিভিন্ন দরগাহ বা মাজারে পড়ে থাকত। বাকি যে সময়টুকু বাড়ি থাকত তাকে সেভাবে থাকা বলা চলে না। বাড়ির পাশের বটগাছের তলায় অধিকাংশ সময় বসে কি যেন ভাবতেন বাবা। কারো সঙ্গেই সেভাবে কথা বলতেন না। সংসারে থেকেও বড় বিবাগি ছিলেন মানুষটি। মায়ের সঙ্গে বাবার কোনো লম্বা কথোপকথনের দৃশ্য মনে আসে না মমিন সাহেবের। দু’জনেই অদ্ভুত রকমের নির্লিপ্ত ছিল। শুধু প্রতিবার মাজার থেকে আনা দুটি করে তাবিজ মা আর মমিন সাহেবের বাহুতে যত্ন করে বেঁধে দেওয়ার সময় মা পলকহীনভাবে বাবাকে দেখতেন। কোনো শয়তানের যেন নজর না পড়ে এ জন্য দোয়া পড়ে যখন মা আর ছেলের মাথায় ফুঁ দিয়ে দিতেন বাবা তখন মায়ের চোখে অজানা কারণে পানি দেখা যেত।
বাবা বলতেন কথা। প্রাণ খুলে কথা। আর তা শুধু দু’বাড়ি পরের মালতিদির বাবা যতীন কাকার সঙ্গে। ছেলেবেলার বন্ধু ছিলেন তাঁরা। যতীন কাকা বাবার হাত দিয়ে সব দরগাহে মানত পাঠাতেন। আর বাবা বারিতে এলে নারিকেলের সন্দেশ নিয়ে বটতলায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। সেই সন্দেশের লোভে মমিন সাহেবও যতীন কাকার বাড়ি যেত ঘনঘন। মালতিদি উঠোনে আলো ছড়িয়ে কাঁসার বাটিতে মুড়ি, নারিকেলের সন্দেশ আর বাতাসা নিয়ে বসতো। মমিন সাহেবকে দেখলেই সে বাটি লুকিয়ে ফেলত মালতিদি। সুযোগ পেলেই চিল হয়ে ছোঁ মেরে সন্দেশ নিয়ে পালিয়ে যাবেন মমিন সাহেব, সেই ভয়ে। তবে একসময় সে সন্দেশের লোভ হারিয়ে গেল মমিন সাহেবের। সেখানে জেগে উঠল আরেক লোভ। মালতিদিকে দেখার লোভ। চন্দনের মতো শুধু গায়ের রঙই ছিল না মালতিদির, তার সুবাসও ছিল চন্দনের মতো। কাঁঠাল চাঁপা গাছের নিচে বসে একমনে কাপড়ে ফুল তুলত মালতিদি। তখন বাতাসে চন্দনের সুবাস ছড়িয়ে পড়ত। দু’বাড়ি দূর হতেও সে সুবাসে আকুল হতেন মমিন সাহেব। কোনো পরবে মালতিদির আলতা মাখা লাল পায়ে নূপুর যখন ঝমঝম করে উঠত তখন সেই নূপুর ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিতে ইচ্ছে হতো মমিন সাহেবের।
‘কি হয়েছে তোমার, বলো আমাকে। কাল রাতে গোঙাতে গোঙাতে কিছু বলছিলে।’
সচকিত মমিন সাহেব নির্লিপ্ততার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
‘কী বলেছিলাম?’
কল্পনার মৃদু্ আওয়াজে বলে,
‘পরি’
মমিন সাহেবের মাথা ঝুঁকে পড়ে। কোনো উত্তর নেই তাঁর।
‘স্বপ্নে পরি আসে?’
‘শুধু স্বপ্নে না, সব সময় আসে।’ নির্লিপ্ত মমিন সাহেব বলেন।
‘তোমার মনের ভুল। এ যুগে এসব কেউ বিশ্বাস করে?’
‘কাউকে বিশ্বাস করতে হবে না। পরি আমার কাছে আসে, আলো ছড়ায়। আমার সব রোগশোক পালিয়ে যায়।’
মানুষটার কী হলো ভাবতে বসে কল্পনা। সারা দিন অসুস্থ শরীরে ঘরে বসে বসে কি লোকটার মাথায় সমস্যা হলো?
কল্পনাকে আরও চিন্তায় ফেলে দিয়ে মমিন সাহেব বলে ওঠেন,
‘পরি নয়, মালতি পরি! পরি দেখতে মালতিদির মতো হয়।’
‘কোনো মালতিদি? পাগলি মালতি?’
নিরুত্তর একটি চাহনি দিয়ে কথোপকথনে বিরাম চিহ্ন আঁকেন মমিন সাহেব।
সে বছর দেশে খুব খাবারের অভাব। বড় দুর্যোগের পর সব দেশেই এমন হয়। তবুও যতটুকু সম্ভব ঘটা করেই মমিন সাহেবের বিয়ের আয়োজন করেন প্রায় ফুরিয়ে আসা বড় আব্বা। তখন বড় আব্বাই মা আর মমিন সাহেবের একমাত্র অভিভাবক। বাবা তত দিনে হারিয়ে গেছেন। দুর্যোগে মা–বাবা হারিয়ে গেছেন। দেশে এক বড় পরিবর্তন হয়ে গেছে। সব স্কুলে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ গাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। তার বদলে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হয় সবুজ-লাল পতাকা উড়িয়ে। স্কুলের অ্যাসেম্বলিতে সুর মিলিয়ে এই গান গাইতে দেখেই এক ছাত্রীকে ভালো লেগে যায় স্কুলে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক মমিন সাহেবের। দশম শ্রেণির সেই ছাত্রীকে খুব তাড়াতাড়িই বড় আব্বা মমিন সাহেবের বউ করে নিয়ে আসেন এই বাড়িতে। পোলাও, রেজালার দাওয়াত ছিল সেদিন গ্রামের প্রায় সকলের। বটতলায় ছেঁড়া কাপড়ে মানুষের এঁটো বাসনে খাবার খুঁজতে থাকা মালতিদিকে সেদিনই শেষ দেখেছিলেন মমিন সাহেব।
মানুষটার সত্যিই মাথার সমস্যা হয়েছে। পরি দেখতে পাগলির মতো কীভাবে হয়? মমিন সাহেবকে একমনে কিছু ভাবতে দেখে চুপ করে থাকতে চায় কল্পনা। কিন্তু মনের মধ্যে খুব উসখুস করতে থাকে তার।
‘মালতিদি একদম পরির মতো দেখতে ছিল। তুমি সে সময় দেখনি মালতিদিকে।’ ভাবনা থেকে ফিরে বলেন মমিন সাহেব।
‘থাক, ওসব পাগল নিয়ে ভেবে তোমার শরীর খারাপ করার দরকার নেই।’ কল্পনার কথায় প্রবল চিন্তার রেশ।
শরীরের রুগ্নতায় এখন বিরক্তি অনেক কম হয় মমিন সাহেবের। পরি এসে তাঁর সব মলিনতা সারিয়ে দিয়েছে। শরীরের এই দুর্যোগের সঙ্গে দেশের দুর্যোগের এক অদ্ভুত মিল আছে। সেই দুর্যোগের বছরেই মমিন সাহেবের প্রথম হাঁপানির টান ওঠে।
মালতিদি সেদিন খুব ভয়ে ছিল। আর ভয়ে ছিলেন যতীন কাকা। গ্রামের পর গ্রাম যুবতী মেয়েদের নিয়ে ভয়ে ছিল। একদিন সন্ধ্যার পর যতীন কাকা মালতিদিকে নিয়ে মমিন সাহেবের বাড়িতে আসেন।
‘মমিন বাপ, আমার মেয়েটাকে কয়দিনের জন্য আশ্রয় দাও। আশপাশের সব গ্রামের মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। তোমাদের বাড়ির মেয়েদের দিকে হাত বাড়াতে পারবে না, আমি জানি।’
যে চন্দনের সুবাসের জন্য দু’বাড়ি দূর থেকে মমিন সাহেব আকুল থাকত তা নিজের বাড়ি পেয়ে কীভাবে প্রত্যাখ্যান করেন মমিন সাহেব। বাড়িময় তখন চন্দনের সুবাস। থরথর মালতিদি উৎকণ্ঠায় সারা দিন মায়ের ঘরে সিঁধিয়ে থাকত। কারণে–অকারণে সে ঘরে মমিন সাহেবের যাতায়াত বেড়ে গিয়েছিল। একদিন সে সুবাসেই প্রথম টের পান মমিন সাহেব তার নিশ্বাসে টান পড়ছে। বুকের ভেতর বাতাসের অভাব বোধ হয় তার। চন্দনের সুবাস ফেলে তিনি বুক ধরে হাঁপাতে থাকেন। চন্দনের সুবাস লুকিয়ে রাখা দায়। একদিন সন্ধ্যায় খাকী পোশাকের কয়েকজন একটি জিপে করে সেই সুবাস নজরানা হিসেবে নিয়ে গেল মমিন সাহেবের কাছ থেকে। সেদিন রাতেই যতীন কাকার বাড়ি লুট হলো আর দু’দিন পর নবগঙ্গায় ভেসে উঠলেন যতীন কাকা।
কল্পনা ঘরের আলো নিভিয়ে বেশ আগেই অন্য ঘরে চলে গেছে। তন্দ্রাচ্ছন্ন মমিন সাহেবের ঘর আজ ভরে গেল চন্দনের সুবাসে। পুবদিকের জানালা দিয়ে একটা তারা আকাশ থেকে খসে মমিন সাহেবের বিছানায় পড়ল। বিছানা ভরে গেল কাঁঠাল চাঁপা ফুলে। মালতিদির মতো দেখতে পরি আজ মমিন সাহেবের খুব কাছে, একদম মুখোমুখি। পরির ডানা থেকে আজ সোনার রঙের আলোর সঙ্গে এক অদ্ভুত উত্তাপ বেরিয়ে আসছে। আপ্লুত মমিন সাহেব হাত বাড়িয়ে ধরতে যায় পরিকে। ডানার উত্তাপ লাগে মমিন সাহেবের চোখমুখে। সে আঁচে বিশ্রী সেই কাশিটা জাগান দিল তার। কাশির দমকে কিছু আঠালো কফ আর লালা গড়িয়ে পড়ল মমিন সাহেবের ঠোঁট বেয়ে। তার বুকের ভেতরে বাতাসের বদলে তাপ প্রবেশ করতে লাগল। সবকিছু পুড়িয়ে দিতে লাগল মমিন সাহেবের। কষ্টে চিৎকার করতে চাইলেন তিনি। সেই বিছানা সেই ঘর ছেড়ে পালাতে চাইলেন তিনি। পরি থেকে দূরে চলে যেতে চাইলেন তিনি। পারলেন না। মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন মেঝেতে।
‘কী হয়েছে, এমন করছ কেন? এখানে এলে কীভাবে?’
হাঁপাতে থাকা কফে, লালায় মাখামাখি মমিন সাহেবকে মেঝে থেকে টেনে তোলে কল্পনা।
‘পরি....পরি’ হাঁপানির টান বেড়েছে খুব মমিন সাহেবের।
‘পরি নেই, কিচ্ছু নেই। সব তোমার মনের ভুল।’
মমিন সাহেবকে ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে চেয়ারে বসিয়ে দেয় কল্পনা। কাঁধ ঝুঁকিয়ে হাঁপাতে থাকা মমিন সাহেবকে দেখতে এখন অবিকল তাঁর বড় আব্বার মতো লাগছে!
মাটিতে লুটিয়ে পড়া বিছানার চাদর ঠিক করতে যায় কল্পনা।
এলোমেলো চাদর তুলে ঝারা দেয় সে। দুইটি কাঁঠাল চাঁপা ফুল গড়িয়ে পড়ে। কপাল কুঁচকে যায় কল্পনার।