পাড়ি

অনেক অনেক দিন আগের কথা। না ঠিক আরবের লোকেরা যখন ‘গুহায় বাস করিত’ তত দিন আগের নয়, তার অনেক পরের গল্প এটা। এই দেশে প্রথম যখন আসি সেই সময়কার।
কোটি কোটি অভিবাসীর নতুন বিশ্বে ঢোকার দরজা নিউইয়র্ক শহর। সেই একই পথের যাত্রী হয়ে আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগের ক্ষরতপ্ত গ্রীষ্মের এক দিনে জে এফ কে বিমানবন্দর ছুঁয়ে একুশ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রথমবারের মতো আমেরিকায় প্রবেশ করে। প্যান অ্যাম এয়ারলাইনসের সুবিশাল জাম্বো জেটের সওয়ারি আরও সাড়ে তিন শ যাত্রীর সঙ্গে আমিও সেদিনের সেই পরিসংখ্যানে যুক্ত হই। প্লেনের দরজার ওপারে জেটব্রিজ, সেটার শেষে অসংখ্য করিডরের বিস্তার। করিডর শব্দটা অবশ্য এ ক্ষেত্রে খুবই অপ্রতুল। এই করিডরগুলো কমপক্ষে চল্লিশ ফুট চওড়া, আর লম্বায় দুই- আড়াই শ ফুট হবে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থের হিসেব-নিকেশ করতে করতে হেঁটেই চলেছি। মোজাইক করা ঝকঝকে মেঝে, মাথার ওপরে সিলিং থেকে ঝুলছে হরেক রকমের সতর্কবার্তা, আর নানা কিসিমের নির্দেশনামা। চোখ বুলাচ্ছি সবগুলোতেই। মনযোগ দিয়ে অনুসরণ করছি পাশ থেকে দেখা যাওয়া একটি মানুষের অবয়ব। ছবির মানুষটির মাথায় কালো ক্যাপ, হাতে ধরা ছোট একটি বই, কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে হলুদ রঙে আঁকা, নিচে ইংরেজিতে লেখা ‘পাসপোর্ট কন্ট্রোল’, তার নিচে তিরচিহ্ন দিয়ে দিকনির্দেশ।

হাঁটছি আর হাঁটছি, পথ যে ফুরায় না। এই ‘কান্তার মরু’ পাড়ি দেওয়ার কষ্ট লাঘবের জন্য অবশ্য কিছু দূর পরপর রয়েছে চলমান পথ। এয়ারপোর্টে এই বস্তুটির দেখা আজকাল প্রায় সব জায়গাতেই দেখা যায়। তবে সেই সময়ে লন্ডন ও নিউইয়র্ক ছাড়া তেমন কোথাও দেখা যেত না। ‘চলমান পথ’ আমেরিকান ইংরেজিতে, ‘পিপল মুভার’; বিষয়টি হচ্ছে মেঝেতে বসানো একটি চওড়া ধাতব বেল্ট, দাঁতালো পুলির মাথায় লটকে লটকে নিঃশব্দ অলস গতিতে ধেয়ে চলেছে সম্মুখ পানে। ওপরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লে যাত্রীদের পৌঁছে দেয় আরেক মাথায়। হাঁটা আর চড়ার খেলা খেলতে খেলতে একসময় পথ ফুরায়, ঢুকে পড়ি বিশাল এক ঘরে। এই ঘরের ব্যাপ্তি করিডরের সঙ্গে মানানসই, একপ্রান্তে দাঁড়ালে অন্যপ্রান্তের হদিস প্রায় পাওয়াই যায় না। মেঝের ওপরে ফুট তিনেক উচ্চতার, আর ইঞ্চি দুই ব্যাসের সারি-সারি পোস্ট। ওগুলোর মাথা থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি কালো ফিতে। তার একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে গোলকধাঁধার মতো কিছু পথ। পথের সংখ্যা অনেক; গন্তব্যস্থল কিন্তু সীমিত। এই পথগুলোর কয়েকটি নির্দিষ্ট করা আছে উত্তর আমেরিকার নাগরিক ও এই দেশগুলোর স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য। বাকিগুলো পৃথিবীর অন্য সব দেশের নাগরিকদের জন্য। আমি অন্যদের দলে। কালো ফিতের প্যাঁচানো পথ পাড়ি দিয়ে যখন ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে দাঁড়ালাম, আমার বুক তখন দুরু দুরু কাঁপছে। ভয়ংকর সব কাহিনি শুনে এসেছি এই আমেরিকান ইমিগ্রেশন সম্পর্কে। না জানি আমার কপালে কি লেখা! না, সত্যতা যাচাই করার সুযোগ হলো না। আই টুয়েন্টিতে স্কুলের নাম দেখে (মনে হয়) ভক্তিপূর্ণ একটা চাহনি দিয়ে একটাই প্রশ্ন করল, ‘তুমি বোস্টনে সরাসরি না গিয়ে এখানে এলে কেন?’ কি উত্তর দিয়েছিলাম মনে নেই। শুধু মনে আছে ইমিগ্রেশন অফিসার আর একটাও প্রশ্ন না করে পাসপোর্টে ছাপ্পা মেরে হাতের কলম দিয়ে কি জানি লিখল। তারপর একগাল হেসে (সত্যি কি না জানি না, এখন তাই মনে হচ্ছে) বলল, ‘ওয়েলকাম টু আমেরিকা। এনজয় ইওর স্টে।’

ইমিগ্রেশনের কাজ সারার পর বেল্ট থেকে স্যুটকেস তুলে নিয়ে পৌঁছলাম কাস্টমস হলে। সেখানেও পথ দ্বিখণ্ডিত। লাল, আর সবুজ। সবুজ পথ ধরে এগোলাম। দরজার কাছে দাঁড়ানো কাস্টমস অফিসার নিস্পৃহ দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার তাকাল কি না তাকাল; বুঝতে পারলাম না। কাচের দরজা দুপাশে সরে গিয়ে পথ করে দিল। ওপাশে পৌঁছে অসংখ্য মানুষের উদ্‌গ্রীব চাহনিতে বুঝলাম, এরা অপেক্ষা করছে তাদের স্বজনের জন্য; আর আমি, শেষ দরজাটি টপকে পৌঁছে গেছি আমেরিকায়।
শরীরে একটা শিহরণ উঠল; একই সঙ্গে ঘিরে ধরল কেমন এক অজানা আতঙ্ক। কিসের আতঙ্ক বলতে পারি না। তবে ব্যাপারটা নতুন করে এখন ভাবলে মনে হয় সেটি ছিল কোনো এক বিচ্ছেদের আতঙ্ক।

কথা ছিল নিউইয়র্কে বসবাসরত আমার ছোট মামা, আর খালাতো ভাই দুজনই আমাকে রিসিভ করতে বিমানবন্দরে থাকবেন। দরজা পেরোতে পেরোতে ইতিউতি চাইছি। না আশপাশে কোথাও তাদের দেখা যাচ্ছে না। ভালোই ভয় পেলাম। ভয় তাড়াতে ভাবলাম, তাদের তো রাস্তায় জ্যামে পড়ে দেরি হতে পারে। কাঁচুমাচু চেহারা বানিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, আর চারপাশে চোখ বোলাচ্ছি। মামা বেশি লম্বা নয় (বরং একটু খাটোই বলা যায়), কিন্তু খালাতো ভাই পুরো ছ ফুট তিন ইঞ্চি। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে, শত-শত মাথা ছাপিয়ে এই বুঝি তার মুখটি ঝলমলিয়ে উঠল। নাহ্! আধা ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরও দুজনের কারও দেখা পাওয়া গেল না। এবার আমার একটু একটু কান্না পেতে লাগল (সত্যি!)। সেলফোন তখনো সায়েন্স ফিকশনের লেখকের কল্পনায়ও আসেনি। ফোন করলে শুধু বাসাতেই করা যায়। আর অপেক্ষা করতে পারলাম না। পায়ে-পায়ে পে-ফোনের কাছে যেতে মুখ শুকিয়ে গেল। দশ সেন্ট লাগে ফোন করতে। সেই খুচরো পয়সা কোথায় পাই? বোধ হয় বারবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে শূন্য হাত বের করাটি অনেকের চোখে পড়ছিল। মা-মা চেহারার এক মাঝ বয়েসি ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন। ‘কোন সমস্যা?’একটু ইতস্তত করে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললাম। ব্যাগের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একমুঠো ভাংতি পয়সা বের করে আমার দিকে এগিয়ে ধরলেন। ‘তোমার যা দরকার এখান থেকে নিতে পার।’ আমেরিকার পয়সার সঙ্গে আমার তখনো চেনাজানা হতে বাকি। বুঝতে পেরে ভদ্রমহিলা নিজেই বেছে দুটো ডাইম (তখন জানতাম না, পরে জেনেছি, আমেরিকায় দশ পয়সার মুদ্রাকে ডাইম বলে) আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি সেটা নিয়ে ফোন করতে চলে গেলাম।
যা ভেবেছিলাম তাই, ওপাশে ফোন তুলে ভাবি বললেন, ‘তোমার ভাই আর মামা তো সেই দুপুর থেকেই তোমার অপেক্ষায় এয়ারপোর্টে বসে আছেন।’ আমি ফোন রাখতে যাব, উনি বললেন, ‘তুমি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে না হয় একটি ট্যাক্সি নিয়ে চলে আস।’

ফোন নামিয়ে রাখার পর মনে হয় মুখ আরও শুকনো দেখাচ্ছিল। সেই দয়ালু মহিলা আবার এগিয়ে এলেন। ভাবির মতো তিনিও বললেন, ‘ট্যাক্সি ধরে চলে যাও, ঠিকানা আছে?’ ‘আছে!’ সাহস করে বলতে পারলাম না এই ট্যাক্সি জিনিসটা কী করে ধরতে হয়, তা তো জানি না। ‘তা হলে আর দাঁড়িয়ে কেন, সামনের দরজা দিয়ে বের হলেই দেখবে ট্যাক্সি; ওদের গিয়ে ঠিকানা দেখালেই একদম বাড়ির দরজায় পৌঁছে দেবে।’ মহিলা এত সাহায্য করতে চাইছেন, তবু কেন জানি তাকে আমার অসহ্য লাগছিল। তাকে এড়ানোর জন্য আমি হাঁটতে হাঁটতে দরজার দিকে এগোলাম। পেছন থেকে মহিলা চিৎকার করে বলল, ট্যাক্সিওয়ালাকে বুঝতে দিয়ো না তুমি এই দেশে নতুন। সেটা বুঝতে পারলে তোমাকে খালি খামোখা বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরপাক খাইয়ে মিটারে অনেক চার্জ তুলে নেবে। ব্যাপারটা কি সেটা মোটেও বুঝতে না পেরেও মহিলার কথায় মাথা ঝাঁকিয়ে সম্পূর্ণ সম্মতি জানালাম। তারপর, দরজা পেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।

এতক্ষণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের ভেতর ঠান্ডায় প্রায় কাঁপছিলাম। ধরে নিয়েছিলাম আমেরিকা উত্তর গোলার্ধের দেশ, এমন ঠান্ডা হওয়াই তো স্বাভাবিক। দরজার বাইরে বেরোতেই আগস্ট মাসের তপ্ত হাওয়া আমার সারা শরীরে আছড়ে পড়ল। একটু চমকে গেলাম, বিলাত (আমার কাছে তখন ইউরোপ-আমেরিকা সবই বিলাত) বিভুঁইয়ে তো গরম লাগার কথা না। টেনশনে সেটা নিয়ে বেশিক্ষণ মাথা ঘামাতে পারলাম না। খালাতো ভাইয়ের বাসা জ্যামাইকায়, জে এফ কে থেকে শুনেছি খুব কাছে। হেঁটে চলে যেতে পারব নিশ্চয়! ট্যাক্সির সারির ওপর দিয়ে তাকালাম। যা দেখলাম, তাতে শরীর এই গরমেও হিম হয়ে গেল। বুঝলাম প্রায় পাঁচতলা সমান উঁচু একটি বারান্দার মতো জায়গায় আমি দাঁড়িয়ে আছি। অনেক নিচে সড়ক দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পথ কোথায়? আর যাই বা কোথায় কোন সড়কে? একটা সড়ক নিচে, তার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে আরেকটি, সেটার পাশ দিয়ে কোনাকুনি এসে যোগ দিয়েছে আরেকটি সড়ক, তার ওপর দিয়ে চলে গেছে আরেকটি। কী কাণ্ড, কয় তলা রাস্তারে বাবা! এক, দুই করে পাঁচ পর্যন্ত গুনে মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। দরকার নেই বাবা, এয়ারপোর্টেই বসে থাকি।

গুটিসুটি হয়ে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আবার মহিলার মুখোমুখি। ‘কি হলো?’ এবার বলেই ফেললাম, ‘ ট্যাক্সি নিয়ে যাওয়ার মতো সাহসী আমি নই!’ ‘হুমম!’ থুতনিতে আঙুল ঠুকতে ঠুকতে হঠাৎ তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘ তুমি পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ওদের নাম অ্যানাউন্স করতে পার! এস আমার সঙ্গে এস।‘ হেল্প ডেস্ক বলে একটা কাউন্টারে এসে দাঁড়াতেই, মহিলা ওদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল। ওরা আমার কাছ থেকে নাম নিয়ে মামা, আর ভাইকে অনেকবার ডাকাডাকি করল। ওদের ওই বিদঘুটে উচ্চারণে বাঙালি নামগুলো আমার নিজের কাছেই অচেনা লাগছিল। কাজ হল না। এবার আমার মাথায় বুদ্ধি এল; সাহস করে বলে ফেললাম, ‘আমি নিজে কি আমার ভাষায় ডাকটি দিতে পারি, ওরা মনে হয় ইংরেজি বুঝতে পারছে না।’ এবার কাজ হলো, বাংলা ভাষার আহ্বান শুনে দূরে অন্য গেটে অপেক্ষমাণ মামা ও খালাতো ভাই সাড়া না দিয়ে থাকতে পারলেন না। দূর থেকে ওদের আসতে দেখে আমি ছুটে গেলাম। দয়ালু মহিলাকে ধন্যবাদ দেওয়ার কথাটিও ভুলে গেলাম। রোনাল্ড রিগ্যানের রাজত্বে আমার সদর্প পদার্পণের এই হলো গল্প। তারপর কী হলো, সেটা বলব, অন্য আরেকদিন।