কমিউনিটি সভা এবং বক্তারা

নিউইয়র্কে সপ্তাহে বাংলাদেশিদের কয়েক ডজন অনুষ্ঠান হয়। আগে যেতাম পেশাগত কারণে। এখন খুব একটা যাওয়া হয় না। কখনো কখনো নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে যাই। এই যাওয়ার স্মৃতি সুখকর নয়। এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান শেষ হয় পাঁচ-ছয় ঘণ্টায়। তিন ডজন শ্রোতার মধ্যে আড়াই ডজন বক্তা। প্রধান অতিথির বক্তব্যের সময় হল খালি হয়ে যায়। এর মধ্যে মঞ্চে বসার সৌভাগ্য হয়, শাস্তি ভোগ করতে হয় পুরোপুরি। কারণ, তখন পালানো যায় না। কেন জানি বিবেকে বাঁধে। দর্শক সারিতে থাকার সুবিধা আছে। যখন-তখন নিষ্ক্রান্ত হওয়া যায়। আর হয়ও তাই। অনেক বক্তা আছেন, বক্তব্য দিয়েই চলে যান। এতক্ষণ বসা ছিলেন তাঁর নাম ডাকার অপেক্ষায়। তাঁর বক্তব্য শেষ, অনুষ্ঠানও তাঁর জন্য শেষ। উদ্যোক্তাদের জিজ্ঞেস করি, এটা করেন কেন? তিন ডজনের মধ্যে আড়াই ডজন বক্তা! উত্তর খুব সহজ, বক্তার তালিকায় নাম না থাকলে অনুষ্ঠানে আসেন না। পৃষ্ঠপোষকতাও পাওয়া যায় না।
খুব কম অনুষ্ঠানই আছে, কিছু শেখা বা জানা যায়। এই একই কাহিনি, চর্বিত চর্বন। এর পরে আছে সংগঠনের ভাঙা-গড়া, মামলা-মোকদ্দমা, কোর্ট- কাচারি। হাজার হাজার ডলার খরচ। ঘরে অশান্তি, মাঠেও। এসব করে কি লাভ? কি প্রাপ্তি?

মনে রাখার মতো সুন্দর এক উত্তর দিয়েছিলেন রাব্বি মোহাম্মদ খোকন। বাংলাদেশ সোসাইটির এক সময়ের সাধারণ সম্পাদক। বলছিলেন, ‘এটাই আমাদের বিনোদন। আমরা নৈশ ক্লাবে যাই না, নেশা করি না, পান করি না। সংগঠন, সংগঠন করে আমরা সময় কাটাই। ভাঙা-গড়ার খেলায় মেতে থাকি । অবসর সময়ের এ এক ভালো বিনোদন।’
নিউইয়র্কের এই সংস্কৃতির পাশাপাশি মধুর স্মৃতিও আছে। অনেককে সে কথা বলেও থাকি। অবশ্য ঘটনা নিউইয়র্কের বাইরের, বোস্টনের। এক দশক আগে। আয়োজকদের একজনের নাম মনে আছে, ড. নুরুজ্জামান। বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে এক সেমিনার। ছোট হল, শ্রোতায় পরিপূর্ণ। মঞ্চে তিনজন প্যানেল বক্তা। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেন, ইংরেজি কাগজ হলিডের যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি মইনুদ্দিন নাসের ও আমি। সঞ্চালক জানিয়ে দিলেন, প্রত্যেকের সময় আধা ঘণ্টা করে। পনেরো মিনিট, বাকি পনেরো মিনিট প্রশ্নোত্তর। অক্ষরে অক্ষরে তাই হলো। পুরো অনুষ্ঠান শেষ হলো দেড় ঘণ্টায়। পরে শুনলাম , শ্রোতার আসনে আরও এক ডজনের বেশি পিএইচডিধারী ছিলেন। প্রশ্নোত্তরে তারাও অংশ নেন।

নিউইয়র্কে এই চলমান সংস্কৃতির অবসান হোক—কেউ চাইলেও কীভাবে হবে এই সংস্কৃতির অবসান, তা জানা নেই। এমনকি সামান্যতম প্রতিবাদ কোথাও উচ্চারিত হয় না। অবশ্য নিউইয়র্কের বাইরে কিন্তু এমন সংস্কৃতি কমই চোখে পড়ে।

একটি ঘটনার কথা মনে আছে। দেড় দশক আগে। নিউজার্সির প্যাটারসনে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইন্দোনেশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত জিয়াউস সামস চৌধুরী । তিনি সিলেটে কিংবদন্তি এম সি কলেজের প্রিন্সিপাল সলমান চৌধুরীর বড় ছেলে। সলমান চৌধুরী খুব কড়া লোক ছিলেন। শুনেছি, ষাটের দশকে তাঁর অনুমতি ছাড়া গভর্নর মোনায়েম খান কলেজ অঙ্গনে ঢুকতে পারেননি। প্যাটারসনের সে অনুষ্ঠানে বাংলা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে আমি ছিলাম বিশেষ অতিথি। অনুষ্ঠান শুরু হলো কিছুটা বিলম্বে।
বক্তার দীর্ঘ তালিকা। ৩০ জন তো হবেই। ৩/৪ জন বক্তার পরই নড়ে-চড়ে বসলেন প্রধান অতিথি। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হচ্ছে এসব! বললাম, প্রবাসে সভা সমাবেশের এটাই তো রীতি। পরের বক্তার নাম ঘোষণা করতেই তিনি ডাকলেন উদ্যোক্তাদের! গর্জন করে উঠলেন, ‘স্টপ ইট’। আমাদের দাওয়াত দিয়ে এসব কি তামাশা? আচমকা ধমক খেয়ে উদ্যোক্তারা বক্তৃতা পর্ব ওখানেই থামিয়ে দিলেন। পরবর্তী নাম ডাকলেন আমার অর্থাৎ বিশেষ অতিথির। এরপর প্রধান অতিথি। আধা ঘণ্টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হলো। মনে মনে অভিবাদন জানালাম জিয়াউস শামস চৌধুরীকে।

পরে জিয়াউস শামসের পারিবারিক সূত্রে জেনেছি, জীবনযাপনেও তিনি নিয়মশৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা পছন্দ করেন, অনুসরণও করেন। এমনকি দোয়া মাহফিলে হুজুরের দীর্ঘ মোনাজাতের সময়ও তিনি মনে করিয়ে দেন, সংক্ষিপ্ত করতে হবে।
মনে মনে কামনা করলাম, আমাদের এই কমিউনিটির সভা-সমাবেশ-সামাজিক অনুষ্ঠান সংক্ষিপ্ত করতে ত্রাতা হিসেবে অন্তত দু-একজন জিয়াউস শামস চৌধুরী খুবই দরকার।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।