বিজয় দিবসের নানা ধরন

বিজয় দিবসের মার্চপাস্ট
বিজয় দিবসের মার্চপাস্ট

আমাদের মহান ভিক্টরি ডে বা বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে গৌরবময় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। দিনটি সাধারণভাবে বাঙালি জাতির জন্য পরম গর্বের। এ দিনে পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন একটা সার্বভৌম দেশের নাম চিরকালের জন্য জন্য এঁকে দিয়েছে বাংলার মানুষ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ বাঙালির প্রাণ ও মা–বোনের ইজ্জত বিসর্জনের বিনিময়ে বাঙালিদের এই মুক্তি আসে।
‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সেনাবাহিনীকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রজনতা এমনকি বাঙালি সৈনিকদের ওপর লেলিয়ে দেয়। হামলার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের সব ন্যায্য দাবি কঠোর হাতে দমন করা। তাদের অপরাধ ছিল, তারা সামরিক সরকারের কাছে দাবি করেছিল, ১৯৭০ সালের গণতান্ত্রিক প্রথায় নির্ধারিত নির্বাচনের ফলাফলটা মেনে নিতে এবং নির্বাচিত সদস্যদের দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করতে। নির্বাচনে জয়ী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানি হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁর পরাজয়টা মেনে নেননি। এই চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে ভুট্টো, তৎকালীন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান, পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও তাদের আমলারা মিলিতভাবে ধরপাকড় ও দমন–নিপীড়নের পরিকল্পনা করেন। পূর্ব পাকিস্তানিদের ন্যায্য দাবি বিবেচনা করার বদলে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে যখন আক্রমণ করা হলো, বুদ্ধিজীবী ও নিরীহ মানুষ হতাহত হলো, তখন উপায়ন্তর না দেখে বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বর্ডার চৌকিদার ও আমজনতা মিলে ২৭ মার্চ ‘মুক্তি বাহিনী’ বা ‘লিবারেশন আর্মি’ গঠনের ঘোষণা দেয়। সেই সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতিও নেওয়া হয়।
প্রতিবেশী বৃহৎ দেশ ভারত দুহাত বাড়িয়ে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে সর্বতোভাবে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়া গোটা পশ্চিমবঙ্গ এবং গোটা ভারতবর্ষের বাঙালি সমাজ, তা সে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই ছড়িয়ে থাকুক না কেন, তারা পুরোপুরি মনেপ্রাণে এই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। নিজেরা সশরীরে মুক্তিযুদ্ধে না নামলেও বাকি সবদিক দিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, সাংবাদিকতা, চিকিৎসা, সেবা শুশ্রূষার ব্যবস্থা, চাঁদা তুলে তহবিল গঠন, বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের জন্য গণমাধ্যমের কাছে ধরনা, বিশ্ব নেতাদের কাছে আবেদন, নিবেদন কিছুই বাদ ছিল না।
বহুযুগ পর এই প্রথম তারা হিন্দু না মুসলমান, এ কথা ভুলে এক বাঙালি জাতি হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছিল এক মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তা বাস্তবায়ন করার অঙ্গীকারে। এই প্রথম তারা উপলব্ধি করল, তারা বাস্তবিকই একে অপরের কতটা আপন। লোভ, লালসা ও স্বার্থে সেই আদর্শ আজ কিছুটা ধূসর হলেও দুই বাংলার মধ্যে যে পারস্পরিক কৌতূহল, শ্রদ্ধাবোধ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব সহযোগিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে, আগে তা অভাবনীয় ছিল। দিনে দিনে আরও কাছাকাছি এসে তারা নতুন নতুন দিকে পরস্পরের উন্নতির সহযোগী ও পরিপূরক হবে এই আশা এখন সবার মনে। অনেকের কাছে তা সুনিশ্চিত।
অন্যদিকে ভারতের এই আগ বাড়িয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাহায্যে এগিয়ে আসার ব্যাপারটা পাকিস্তানের আদৌ ভালো লাগেনি। তাদের মনে হয়েছে, শত্রু পাকিস্তানকে ভেঙে চুরমার করার জন্য ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলিয়ে নানা অছিলায় পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উসকে দিচ্ছে। তাই ভারতের মনোযোগ এদিক থেকে ঘুরিয়ে অন্যদিকে টেনে নেওয়ার জন্য কোনো প্ররোচনা ছাড়াই ‘অপারেশন চেঙ্গিস খান’ নাম দিয়ে পাকিস্তান ভারতের পশ্চিম সীমান্ত আক্রমণ করে বসে। এর ফলে ১৯৭১ সালেই ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। এই অজুহাতে ভারত খোলাখুলি পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিবাহিনীর সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দ্রুত পালটে যায়। দুর্বল, অনভিজ্ঞ, অস্ত্রহীন এই গেরিলাদের পাশে ও পেছনে সুশিক্ষিত, অভিজ্ঞ ও বিপুলসংখ্যক ভারতীয় সৈন্য ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা আকাশপথে ও স্থলপথে যোগ দেয়। ফলে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাকিস্তান বাহিনী। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণের দলিল সই করার এই অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন পাকিস্তান আর্মির ইস্টার্ন কমান্ডার লে. জে. এ এ কে নিয়াজী এবং ভারত ও বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান কমান্ডিং অফিসার লে. জে. জগজিৎ সিং আরোরা। আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্ত হওয়ার পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের নাম হয় প্রথমে ‘জয় বাংলা’ ও পরে ‘বাংলাদেশ’। আমরা বাঙালিরা এই দিনটাকে ‘বিজয় দিবস’ বলি আর ভারতের অবাঙালিরা একে বলে ‘বিজে দিয়াস’।
তাহলে বিজয় দিবস বলতে আমরা কি বুঝি? মূলত সাধারণ দিনগুলোর মধ্য থেকে এটি কোনো এক বিশেষ দিনের অসাধারণ একটি নাম। বিভিন্ন কারণ, বৈশিষ্ট্য বা তাৎপর্য অনুযায়ী অনেক দেশের অনেক জাতীয় ছুটির দিন আছে। সেই উপলক্ষ ও তাৎপর্য এক দেশ থেকে অন্য দেশে আলাদা হতে পারে। কিন্তু বিজয় দিবসের তাৎপর্য সব দেশে একই। জাতীয় এই ছুটির দিনে দল–মত নির্বিশেষে পুরো জাতি এক হয়ে জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে জয়ের স্মৃতিচারণ করে একদিকে যেমন গৌরবে তাদের বুক ফুলে ওঠে, উল্লাসে তারা ফেটে পড়ে, অন্যদিকে দেশের এই গৌরব এনে দিতে যারা প্রাণ দিয়েছে, তাদের স্মৃতিচারণ করে এবং যারা সেই গৌরবের যুদ্ধের পর এখনো বেঁচে আছে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
বিজয় দিবসের ইতিহাসটা কিন্তু বেশি দিনের নয়। সংক্ষেপে একটু ঘুরে ফিরে দেখা যাক। ১৯৪৫ সালের ২ মে তারিখে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল। পর্যুদস্ত জার্মান বাহিনী আত্মসমর্পণ চুক্তিতে সই করে ৪ ও ৫ মে। কিন্তু বাস্তবে সরকারিভাবে যুদ্ধ শেষ হয় ৮ মে মধ্য রাতে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে স্মরণীয় করে ধরে রাখার জন্য রুশরা মধ্যরাতের ঠিক পরের মুহূর্তকে বেছে নেয় অর্থাৎ ৯ মে’র শুরুকে। অতএব তারা সেই ৯ মে তারিখটাকে বিজয় দিবস নাম দিয়ে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে উদ্‌যাপন শুরু করে। নাৎসি জার্মানি যখন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণ করে, রুশ সৈন্যরা চতুর রণকৌশলে জার্মান সেনাবাহিনীকে বিপদের মধ্যে ফেলে পিছু হঠতে বাধ্য করে। ঠেলতে ঠেলতে তাদের বার্লিন পর্যন্ত তাড়া করে নিয়ে আসে। যুদ্ধ তখন রাশিয়ার মাটিতে না হয়ে আক্রমণকারী জার্মানদের নিজেদের মাটিতেই হয়। এই যুদ্ধে হিটলার বাহিনীর পরাজয় ঘটে।
কিন্তু ঠিক জয়ের উৎসবে নয়, বিজয় দিবস উদ্‌যাপনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো, যারা যুদ্ধে মারা গেছে তাদের সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা। দেশ রক্ষায় তাদের আত্মাহুতির জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। এই দিন যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের কবরে ফুল দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে এখনো যারা বেঁচে আছে, তারা সেদিন তাদের অর্জিত তকমা ও মেডেলগুলো ঝুলিয়ে মিলিটারি পোশাকে সজ্জিত হয়ে রাস্তায় রাস্তায় মিছিলে বের হয়। রাশিয়া যুদ্ধে নেমেছিল মূলত আক্রমণকারীদের কাছ থেকে নিজেদের মাতৃভূমি রক্ষার তাগিদে। সে জন্য তারা এই যুদ্ধটাকে ‘দেশপ্রেমের যুদ্ধ’ মনে করে। সে হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধটা তাদের কাছে দেশপ্রেমের যুদ্ধ।
বিজয় দিবসকে নানা দেশে একটু ঘুরিয়ে–ফিরিয়ে ডাকলেও এর মানে বা তাৎপর্য মোটামুটি একই। মজার ব্যাপার হলো এই বিজয় দিবস সারা বছর ধরে চলতে থাকে। এমনকি একই মাসে কয়েকটি দেশে বিজয় দিবস পালিত হয়। কয়েকটি নমুনা দেওয়া গেল:
৭ জানুয়ারি কম্বোডিয়া, ২৭ মার্চ অ্যাঙ্গোলা, ৭, ৮, ৯ ও ১৮ মে যথাক্রমে ভিয়েতনাম, ইউরোপ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও শ্রীলঙ্কা। ২৩ জুন এস্তোনিয়া, ২৬ ও ২৭ জুলাই যথাক্রমে ভারত ও উত্তর কোরিয়া, ১, ৫ ও ৩০ আগস্ট যথাক্রমে লাওস, ক্রোয়েশিয়া ও তুরস্ক। ৩, ৭, ৮ ও ৮ সেপ্টেম্বর যথাক্রমে তাইওয়ান, মোজাম্বিক, মাল্টা ও পাকিস্তান। ৪ নভেম্বর ইতালি, ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ।
এ ছাড়া পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে অন্য ঘটনাকে কেন্দ্র করেও বিজয় দিবস পালন করা হয়। ২৩ ডিসেম্বর মিশর বিজয় দিবস পালন করে তিন পরাশক্তির যৌথ আক্রমণ শেষ হওয়ার দিন হিসাবে। ১৯৪৫ সালে জার্মানির আত্মসমর্পণকে কেন্দ্র করে রাশিয়া যেমন ৯ মে বিজয় অনুষ্ঠান করে, তেমন ফ্রান্সও এই উপলক্ষে ৮ মে বিজয় দিবস পালন করে। আমেরিকার হাওয়াই ও রোড আইল্যান্ড অঙ্গরাজ্যে আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সোমবারকে বিজয় দিবস, বিশেষ করে ‘ভিক্টরি ওভার জাপান ডে’ হিসেবে পালন করে। এক সময় দিনটিকে জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে পালন করা হতো, পরে একে জাতীয় ছুটির দিনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। কারণ ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট নাগাসাকির ওপর অ্যাটম বোমা ফেলে বিশ্বযুদ্ধকে যেভাবে শেষ করা হয়েছে—তার স্মৃতিচারণ মোটেও উল্লাস করার মতো ব্যাপার নয়। অবশ্য রোড আইল্যান্ড দিনটিকে জাতীয় না হলেও স্টেট হলিডে হিসেবে পালন করে। তারা এটা স্মরণে রাখতে চায়, তাদের অঙ্গরাজ্যই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সৈন্য পাঠিয়েছিল এবং পার্ল হারবারের জাপানি হামলায় তাদের সৈন্যরা সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারায় । (শিকাগো)