মার্কিন শেয়ারবাজারে নাটকীয় ধস নামার আশঙ্কা

জেনারেল ম্যাটিস
জেনারেল ম্যাটিস

মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল ম্যাটিস পদত্যাগ করেছেন। এদিকে বাজেট–প্রশ্নে অচলাবস্থা দূর না হলে আজ শুক্রবারের পর থেকে মার্কিন সরকারের একাংশের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। এই দুই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন শেয়ারবাজারে নাটকীয় ধস নেমেছে।

জেনারেল ম্যাটিসের পদত্যাগের আশু কারণ সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার–প্রশ্নে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর মতান্তর। দুই দিন আগে টুইটারে এক বার্তায় ট্রাম্প জানান, সিরিয়ায় আইএসের পরাজয় হয়েছে, অতএব সেখান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। পরের দিন জানা গেল, আফগানিস্তান থেকেও ৭ হাজার মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ট্রাম্প।

জেনারেল ম্যাটিস উভয় সিদ্ধান্তের ব্যাপারেই দ্বিমত পোষণ করেন। জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে এক মুখোমুখি বচসার পর ম্যাটিস পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। ট্রাম্প নিজেই এক টুইটে ম্যাটিসের অবসরগ্রহণের কথা জানান, কিন্তু পদত্যাগের বিষয়টি চেপে যান। দিনের শেষে পেন্টাগন থেকে ম্যাটিসের পদত্যাগপত্র প্রকাশ করা হয়। ম্যাটিস, যাকে ট্রাম্প অতিরিক্ত শ্রদ্ধা দেখিয়ে ‘আমার জেনারেল’ নামে ডাকতেন, সেই পত্রে ট্রাম্পকে শুকনো ধন্যবাদটি পর্যন্ত দেননি।

জেনারেল ম্যাটিস তাঁর পদত্যাগপত্রে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর মতভেদের কথা উল্লেখ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিজের স্বার্থেই উচিত তার মিত্রদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখা। আইএসসহ অন্য যেসব শত্রুর কারণে এই দেশ হুমকির মুখে, তাদের ব্যাপারেও স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। ন্যাটোসহ সব আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার ব্যাপারে ট্রাম্প যে বিরাগ প্রকাশ করে আসছেন, তার প্রতি ইঙ্গিত করে ম্যাটিস লেখেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে এমন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি অব্যাহত সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। আর সেই লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত তার জোটভুক্ত মিত্রদের সঙ্গে সংহতি বজায় রাখা।

ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর মতভেদের কথা সরাসরি উল্লেখ করে ম্যাটিস লেখেন, প্রেসিডেন্টের ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে মিল আছে এমন একজন প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়াই বাঞ্ছনীয়।

ম্যাটিসের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের নিজ দলের সদস্যদের বিস্মিত ও উদ্বিগ্ন করেছে। চিফ অব স্টাফ জেনারেল কেলি, যিনি এ বছরের শেষাশেষি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিচ্ছেন এবং জেনারেল ম্যাটিস—এই দুজনকে ভাবা হতো ট্রাম্পের মন্ত্রিসভার ‘বয়স্ক সদস্য’। রিপাবলিকান নেতৃত্ব এই ভেবে আশ্বস্ত ছিলেন যে, এই দুই জেনারেল ট্রাম্পের খামখেয়ালিপনায় লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হবেন। এখন তাঁরা দুজনই ট্রাম্পের মন্ত্রিসভা থেকে সরে যাচ্ছেন।

ম্যাটিসের পদত্যাগের কথা জানতে পেরে রিপাবলিকান সিনেটর বেন স্যাসে বলেছেন, আজ একটি বেদনার দিন। ম্যাটিসের বক্তব্য সমর্থন করে সিনেটে রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেল বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বহু পরিশ্রমে যে জোটব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, যেকোনো মূল্যে তা রক্ষা করা উচিত। আমাদের উচিত কে আমাদের বন্ধু, কে আমাদের শত্রু তা চিনে নেওয়া। ডেমোক্রেটিক নেতা ন্যান্সি পেলোসি বলেন, ম্যাটিসের পদত্যাগের খবরে তিনি ভীত, এটি দেশের জন্য একটি দুঃসংবাদ।

তবে ম্যাটিসের পদত্যাগ নয়, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য প্রকৃত দুঃসংবাদ হবে যদি শুক্রবারের মধ্যে বাজেট বরাদ্দ–প্রশ্নে চলতি অচলাবস্থা দূর না হয়। এই সময়ের মধ্যে যদি বাজেট বরাদ্দ–প্রশ্নে কোনো সমঝোতা না হয়, তাহলে ফেডারেল সরকারের একাংশের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। ট্রাম্প মেক্সিকো সীমান্তে ২ হাজার মাইল লম্বা ‘দেয়াল’ নির্মাণের জন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার দাবি করেছেন। বলেছেন, এই অর্থ বরাদ্দ না করা হলে তিনি বাজেট–সংক্রান্ত কোনো আইনে স্বাক্ষর করবেন না। সে জন্য যদি সরকার অচল হয়ে পড়ে, তাতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। অন্যদিকে বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা সাফ সাফ জানিয়েছে, তারা ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ বরাদ্দ সমর্থন করবে না।

ক্রিসমাসের ছুটির আগে সরকারের কাজকর্ম বন্ধ হলে তাঁরা সমালোচিত হবেন, এই বিবেচনায় অনেক রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্পকে নমনীয় হতে অনুরোধ করেছিলেন। দুই দিন আগে ট্রাম্প নিজেও নিজের মত বদলে জানান, অর্থ বরাদ্দ না পেলে সরকারের অন্যান্য খাতে ব্যয় সংকোচের মাধ্যমে তিনি ‘দেয়ালের’ জন্য অর্থ জোগাড় করবেন। কিন্তু তাঁর দলের কট্টরপন্থীরা ট্রাম্পের এই অবস্থা পরিবর্তনে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। এমনকি ট্রাম্পের মেগাফোন হিসেবে পরিচিত ফক্স নিউজ টিভির ভাষ্যকারেরা পর্যন্ত তাঁকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করেন। নিজের অনুগত সমর্থকদের খুশি করতে ট্রাম্প আবার নিজের অবস্থা বদল করে জানান, না, পাঁচ বিলিয়ন না পেলে তিনি সরকারের চাকা বন্ধ করে দেবেন।

ট্রাম্পের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে বুধবার সিনেটে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারি কাজকর্ম চালু রাখার মতো অর্থ বরাদ্দ করে একটি সাময়িক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প বেঁকে বসলে প্রতিনিধি পরিষদে শুধু রিপাবলিকান সদস্যদের সমর্থনে একটি বিকল্প প্রস্তাব গৃহীত হয়, যাতে ট্রাম্পের ‘দেয়ালের’ জন্য ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু সিনেটে এই প্রস্তাব পাসের জন্য যে ন্যূনতম ৬০টি ভোটের প্রয়োজন, রিপাবলিকানদের তা নেই। ডেমোক্র্যাটরা জানিয়ে দিয়েছে, তাদের কেউ এই বিকল্প প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেবে না।

অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত না হলে শুক্রবারের পর থেকে ফেডারেল সরকারের এক–চতুর্থাংশের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। প্রায় ১ লাখ সরকারি কর্মচারীকে বিনা বেতনে ঘরে বসে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হবে।

ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে ক্রমবর্ধমান সংকটের ফলে দেশের শেয়ারবাজারে প্রবল অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার দেশের প্রতিটি শেয়ারবাজারের সূচক ছিল নিম্নমুখী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্রুত অবস্থা না বদলালে ফের মন্দাবস্থা দেখা দিতে পারে।

পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল, সে কথা উল্লেখ করে সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেটা বলেছেন, সব গন্ডগোল একা ট্রাম্পের সৃষ্টি। তালগোল পাকিয়ে তিনি নিজের প্রতি সব মনোযোগ আদায় করে নিচ্ছেন বটে, কিন্তু এর ফলে দেশের মানুষের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয়েছে।