মুক্ত করো সুপ্ত বিবেক

বড়দিনের ছুটি চলছে। ভেবেছিলাম নিয়ম মাফিক ভোর ৫টায় উঠব না। কিন্তু গাড়ি সরাতে হবে সকাল ৮টার মধ্যে। না সরালে ঝাড়ুদারেরা বিপাকে পড়বেন। তাদের বিপাকে ফেলার অর্থ ৪৫ ডলারের টিকিট খাওয়া। এদিকে ভোর থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সকাল ৭টায় উঠে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি সরাতে গেলাম। কিন্তু কে জানত, বিরক্তিতে ভরা একটা সকাল অবশেষে আমার জন্য এমন সুন্দর দিনের সূচনা করবে?
গাড়ি সরাতে গিয়ে পড়লাম বিপাকে। ৩৫ মিনিট চেষ্টা করেও উপযুক্ত পার্কিং পাচ্ছিলাম না। বাধ্য হয়ে তখন বাড়ির পাশেই নর্দার্ন বুলেভার্ডে অবস্থিত ডানকিন ডোনাটে ঢুকলাম কফি নিতে। পার্কিং স্পটে গাড়ি রেখে কফি শপে যেই ঢুকতে যাব, দেখলাম একজন গৃহহীন মানুষ দোকানের বাইরে দরজার পাশে মাটিতে বসে আছেন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজে তার শরীরের অনেকটাই স্যাঁতসেঁতে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে তিনজন স্প্যানিশ পুরুষ সিগারেট টানছিলেন। আমাকে দেখেই তারা অদ্ভুত রকমের একটা শব্দ করলেন। তারপর তিনজনই হেসে উঠলেন। কোন ভিনদেশি হলে হয়তো শব্দটার জন্য তাদের যৌন হয়রানির মামলায় ফেলে দিতেন। আমি সে রকম কিছুই করার দরকার বোধ করলাম না। কফি নিতে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। তখনো তারা আমাকে দেখছিলেন।
কফি নিয়ে যেই বের হলাম, ওই তিনজন আবারও সেই মৌখিক বিদঘুটে শব্দটা করলেন। এবার আমার দিকে তাকিয়েই করলেন। স্প্যানিশ ভাষায় কিছু বলেন, যা আমার বোধগম্য হল না। ব্যাচেলর করা অবস্থায় দুটি স্প্যানিশ ক্লাস নিয়েছিলাম। জিপিএ–৪ থাকলেও সেবার এই বিষয়ে টেনেটুনে বি-প্লাস নিয়ে পাস করায় গড়পড়তা নম্বর নেমে আসে ৩ দশমিক ৭১–এ। যাই হোক, লোকগুলোর আচরণে আমি এবারও কিছুই বললাম না। এরই মধ্যে গৃহহীন লোকটি আমার কাছে হাত পেতে একটা ডলার চাইলেন। আমি দাঁড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘Why do you need a dollar my love? ‘তিনি বললেন, ‘I am cold. I want to buy a coffee.’
উত্ত্যক্তকারী লোকগুলো তখনো আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।
ডানকিনে ১ ডলারে কোনো কফি হয় না। ছোট আকারের কফি কিনতে লাগে ১ ডলার ৫৯ পয়সা, সাথে ভ্যাট। মাঝারি আকারের কফি ১ দশমিক ৮৯ ডলার, সাথে ভ্যাট। বড় আকারের নিলে ২ ডলার ০৯ ডলার, সাথে ভ্যাট। আমি ব্যাগ খুলে লোকটির হাতে ২ ডলার ৫০ পয়সা দিলাম। বললাম, ‘Go, get a coffee and enjoy!’ লোকটি তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালেন। আমাকে প্রয়োজনের থেকেও বেশি দোয়া করতে করতে কফি কিনতে দোকানের ভেতরে ঢুকে গেলেন।
ওই তিন ব্যক্তির মুখে ততক্ষণে হাসির বদলে বিস্ময় ভর করেছে। তারা আমাকে দেখছেন।
আমি গাড়িতে চলে এলাম। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। কৌতূহল হলো লোকগুলোর ব্যবহারে পরিবর্তন দেখে। মনোবিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েশন করার এই একটা সুবিধা। চট করে মানুষের মনের ভেতরটা আংশিক হলেও পরখ করে নেওয়া যায়। ইতিমধ্যে গৃহহীন ব্যক্তি কফি নিয়ে ফিরে এসেছেন আগের জায়গায়।
এরপর যা দেখলাম, আমি অভিভূত না হয়ে পারলাম না। এতক্ষণ যে মানুষগুলোর গৃহহীন মানুষটির দিকে কোন ভ্রুক্ষেপই ছিল না, সেই তাদেরই একজন ১ ডলারের একটি নোট গৃহহীন লোকটির হাতে ধরিয়ে দিলেন। অন্যজন তার বর্জিত টিস্যু পেপার ও খাবার তুলে গার্বেজ ক্যানে ফেললেন।
বিস্মিত হলাম না। তবে এবার ছিল আমার অভিভূত হওয়ার পালা। আমি ভাবতে লাগলাম, মানুষের কত রূপ! যেই মানুষগুলো শুরুতে আমাকে নিয়ে বিভ্রতকর কিছু করার চেষ্টা করছিলেন, সেই মানুষগুলোই হঠাৎ কেমন ভিন্ন রূপ নিয়ে আমার সামনে এলেন। তবে কি তাদের ভেতরে নৈতিকতা, মানবতা ও বিবেচনাবোধ এত দিন সুপ্ত ছিল? তবে কি আমার একটি অতি সাধারণ পদক্ষেপ তাদের ভেতরকার সুপ্ত বিবেক সত্তাকে জাগিয়ে দিল? ভাবছিলাম আর অজানা এক আনন্দে মনটা ভরে উঠতে লাগলে। এবার লোকগুলো আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। তবে সে হাসি ছিল ভিন্ন। সে হাসিতে এতটুকু কপটতা বা ব্যাঙ্গরস ছিল না। আমিও হাত নেড়ে তাদের স্বাগতম জানালাম।
অজ্ঞানবশত আমরা প্রায়শই যে ভুলগুলো করে থাকি, তা হলো অন্যকে বিচার করতে আমরা নিজের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করি। কঠিন অবস্থায় ‘ইন রেসপন্স’ বা উত্তরে বাস্তবিক না হয়ে আবেগী হয়ে উঠি। যেমন ধরুন, আপনার সহপাঠী আপনাকে কোন এক কারণে সহ্য করতে পারছে না বা সুযোগ পেলেই আপনাকে আঘাত করছে। আপনি তার আচরণে কষ্ট পাচ্ছেন। আপনি ভেবে নিচ্ছেন, আপনার সহপাঠী হিংসুটে ও মন্দ মানুষ। এখানে আপনি সহপাঠীকে বিচার করছেন সম্পূর্ণ নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে।
আবার ধরুন, আপনি আপনার সহপাঠীর বিপরীতমুখী আচরণে একদিন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। সুযোগ পেয়ে তাকে ভালো–মন্দ দুটো কথা শুনিয়ে দিলেন। ‘ইন রেসপন্স’–এ আপনি এখানে আবেগী ভূমিকা রাখছেন, বাস্তবিক নয়।
আপনি বাস্তবিক এই জন্য নন যে, আপনি আপনার সহপাঠীর বিপরীত আচরণের কারণগুলো খুঁজে দেখছেন না এবং আপনি তার বিপরীত আচরণের উত্তরে একই রকম আচরণ তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। আপনি জানার চেষ্টা করছেন না, আপনার সহপাঠী কেন আপনাকে আঘাত করে আপনার মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। আপনি বোঝার চেষ্টা করছেন না, তার ব্যক্তি জীবনে কি এমন হচ্ছে বা ঘটছে যা তাকে এতটা অসচেতন ও বিচারহীন করে তুলছে।
কেউ মন্দ নয়। প্রতিটা মানুষ তার অবস্থানে যুক্তিপূর্ণ। ডানকিনের সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোর কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিতের পেছনে পটভূমি কি, তা আমরা জানি না। হতে পারে, ওদের পরিবার নেই বা কখনো ছিল না। হতে পারে ওরা অবহেলিত-পরিত্যক্ত। ওরা গুরুত্ব চায়, মনযোগ চায়। হতে পারে এমন করে ওরাও নির্যাতিত। কারণ যাই হোক, প্রভাব সবার ওপর বর্তাবে এটাই ‘Cause and Effect’ নিয়ম। আর সেই ক্রমাগত ধারাবাহিক নিয়মটির ব্যতিক্রম ঘটিয়ে নিজেদের বিবেচনা শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে, অন্যের ভেতরের সুপ্ত চৈতন্য উদয়কে জাগিয়ে তোলা সহজ হয়ে যায়।
চার শ বছরের দাসত্বকে নির্মূল করতে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র কোন অস্ত্র বা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেননি। পাল্টা আঘাতও তিনি করেননি। তিনি ব্যবহার করেছেন সাম্য ও ঐক্যের ভাষণ, বার্তা। প্রতিবাদ মানেই পাল্টা আঘাত নয়। প্রতিবাদের হাতিয়ার মানেই প্রতিশোধ নয়। প্রতিবাদ হতে হবে বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তায় শৈলী। তবেই আমরা পারব সমাজ থেকে ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব অপ্রীতিকর ও অনৈতিক অপরাধের অবসান ঘটাতে। আর যদি তাতে যোগ হয় চৈতন্যবোধ, তবে তো কথাই নেই।