আমেরিকায় ক্রেডিট ট্রান্সফার এবং আমার অভিজ্ঞতা

২৩ মে, ২০১৮। দুপুর ১২টায় এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে স্বপ্নের আমেরিকায় নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে পা রাখলাম। কে জানে, হয়তো আমার মতো আরও অনেকে তখন স্বপ্নিল চোখে স্বপ্নের সঙ্গে এর বাস্তবতা মিলিয়ে নিচ্ছিল।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় আর এসএসসি, এইচএসসির কিছু ট্রান্সক্রিপ্ট ও সনদ একটা কালো ব্যাগে ঝুলিয়ে অনেক অনিশ্চয়তা নিয়ে স্বপ্নের দেশে পা রাখলাম। চোখেমুখে উচ্ছ্বাস, ভ্রমণের ক্লান্তি আর নিজ দেশ ছাড়ার আক্ষেপ।
কিছুদিনের মধ্যেই টের পেলাম, ক্যারিয়ারের জন্য আমেরিকা যেমন অনেকের কাছে স্বপ্নপূরণ, ঠিক তেমনি এখানে শুরুর দিকে টিকে থাকা ততটাই কঠিন আর চ্যালেঞ্জিং।
এখানে আসার পর প্রথম কয়েক দিন অনেক কিছু নিয়েই আমাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। তবে এ লেখায় আমি শুধু আমেরিকান ইউনিভার্সিটি বা কলেজে ভর্তি নেওয়ার অভিজ্ঞতা শেয়ার করব।
আমেরিকান দূতাবাসে যখন ডাক পড়ে, তখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ইতিমধ্যে তিন সেমিস্টার শেষ। তাই এ খবর শুনে খুশি হব কী, উল্টো আরও দুশ্চিন্তা জেঁকে ধরল। নিজের ক্যারিয়ারের জন্য কোনটা ভালো হবে, এ নিয়ে পড়লাম দোটানায়। একদিকে স্বপ্নের আমেরিকা আর অন্যদিকে নিজের জীবনের এতগুলো বছর নষ্ট হবে ভেবে। সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল।
অনেক আগে থেকেই একটা মিথ শুনতাম, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি দেশের কোনো ক্রেডিট ট্রান্সফার করে না। তাই নতুন করে শুরু করাই ছিল স্বাভাবিক। ক্যাম্পাসের অনেক শিক্ষক, বড় ভাই, কর্মচারী—অনেককেই জিজ্ঞেস করে জানতে পারিনি কীভাবে ক্রেডিট ট্রান্সফার করতে হয়। আর যেহেতু আমি এসেছিলাম অভিবাসী হিসাবে, তাই যারা স্টুডেন্ট ভিসায় এসেছিল তাদের থেকে আমার প্রসেস ছিল ভিন্ন। আমেরিকায়ও আমার কেউ ছিল না, যে সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করবে। তাই কিছু না জেনেই ট্রান্সক্রিপ্ট, সার্টিফিকেট যা ছিল সব নিয়েই অনেক অনিশ্চয়তা নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলাম স্বপ্নের এই দেশে।
আসার কয়েক দিন পরই দৌড়াদৌড়ি শুরু করি ভর্তির জন্য। প্রথমেই গিয়েছিলাম লাগার্ডিয়া কমিউনিটি কলেজে। এখানকার কমিউনিটি কলেজগুলোতে দুই বছরের অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি দেওয়া হয়। পরে শিক্ষার্থীরা চাইলে পছন্দের চার বছরের কলেজ থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়ে নিতে পারে। কমিউনিটি কলেজগুলো চার বছরের কলেজ থেকে সুলভ। বুঝলাম, শুরুর দিকে অর্থের টানাটানি থাকলে কমিউনিটি কলেজ দিয়েই শুরু করা উত্তম।
যেহেতু আমি মে মাসে এসেছিলাম, তাই ফল সেশনে শুরু করা আমার জন্য কঠিন ছিল। প্রথম দিন অফিসে গিয়ে কথা বলি। যখন তারা জানতে পারল, আমি এর মধ্যে কয়েক সেমিস্টার শেষ করে ফেলছি। তখন তারা আমাকে ট্রান্সফার স্টুডেন্ট হিসাবে আবেদন করতে বলল। ট্রান্সফার আর ফ্রেশম্যান দুইভাবে আবেদন করা যায়। তারা আমাকে আমার ট্রান্সক্রিপ্ট আর সনদ মূল্যায়ন করে নিতে বলল। যেহেতু আমি ফল সেশনে শুরু করব না, তাই তখন আর এগুলো নিয়ে ঝামেলায় যাইনি। আরেকটা কথা বলে নেওয়া ভালো সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের (সিইউএনওয়াই) আন্ডারে নিউইয়র্ক শহরের অধিকাংশ কলেজগুলাতে আবেদন করতে হয়।
এবার বলি ফল সেশনে শুরু না করার আরেকটি কারণ। এখানে টিউশন ফি হলো দুরকম। ইন স্টেট ও আউট স্টেট। ইন স্টেট বা অঙ্গরাজ্যে যাদের বসতবাড়ি, তাদের জন্য ফি কম। বাইরের অঙ্গরাজ্য থেকে আসাদের জন্য টিউশন ফি বেশি দিতে হয়। ইন স্টেট টিউশনের জন্য এই অঙ্গরাজ্যে কমপক্ষে ১২ মাস বসত করার প্রমাণ থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে ১২ মাস পূর্ণ না হলে ও ভার্সিটি ইন স্টেট রেসিডেন্ট হিসেবে ধরে নেয়।
আমেরিকায় আসার এক মাস পরেই পাড়ি জমালাম নিউইয়র্কের প্রান্তিক শহর বাফেলোতে। এখানে এসে ইসিসি-এ (Erie Community College) ট্রান্সফার স্টুডেন্ট হিসাবে ভর্তি নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বিধিবাম। এরা আমেরিকা ছাড়া আর কোনো জায়গার ক্রেডিট ট্রান্সফার করে না। কিন্তু আমিও আমার লক্ষ্যে অটুট। যেই কলেজ ক্রেডিট ট্রান্সফার করবে সেখানেই ভর্তি নেব। তাই খোঁজ নিতে থাকলাম কোন কলেজগুলো ক্রেডিট ট্রান্সফার করে। ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে যা বুঝলাম, এখানে সব কলেজ ক্রেডিট ট্রান্সফার করে না। তাই কারও ক্রেডিট ট্রান্সফার করার ইচ্ছা থাকলে দেখতে হবে কোন কলেজগুলো ক্রেডিট ট্রান্সফার করে।
যত দূর আমার মনে হলো, এখানে কমিউনিটি কলেজগুলো দেশের ক্রেডিট ট্রান্সফার করে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার চার বছর মেয়াদি কলেজে চেষ্টা করব। কিন্তু চিন্তায় ছিলাম, এ জন্য কি SAT/IELTS/TOEFL কিছু লাগবে। আর যদি লাগে, এত স্বল্প সময়ে কীভাবে প্রস্তুতি নেব।
এসব চিন্তার মধ্যেই বাফেলো স্টেট কলেজে বায়োলজি মেজর—এর জন্য আবেদন করলাম। সব ট্রান্সক্রিপ্ট জমা দিলাম। তারা বলল, কলেজ থেকেই আমার ক্রেডিট মূল্যায়ন করিয়ে নেবে। কয়েক দিন পর জানতে পারলাম, ভর্তির জন্য TOEFL লাগবে। তাই কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই পরীক্ষা দিলাম। আরেকটা কথা বলে রাখি, এখানকার পারমানেন্ট রেসিডেন্ট বা গ্রিনকার্ডধারী আর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টের ভর্তির প্রক্রিয়াটি ভিন্ন।
TOEFL পরীক্ষার কয়েক দিন পরই অ্যাকসেপট্যান্স লেটার পেলাম। কিন্তু কত ক্রেডিট ট্রান্সফার হয়েছে, তা জানতে আরও অপেক্ষা করতে হলো। কয়েক দিন পর ই-মেইল পেলাম আমার দেশের ৩৯ দশমিক ৫ ক্রেডিটের মধ্যে ৩৪ ক্রেডিটই ট্রান্সফার হয়েছে। যেখানে আমার নিজের ভার্সিটি থেকে শুনে এসেছিলাম, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্রেডিট ট্রান্সফার হয় না। সেখানে আমার ৩৪ ক্রেডিট ট্রান্সফার হয়েছে বলে খুশি হলাম। নতুন করে জানলাম, দেশ থেকে যা শুনে এসেছি তা সর্বক্ষেত্রে ঠিক নয়।
আমার মতো অনেকেই আছেন, যাদের আগে থেকেই আমেরিকায় আসার পর এসব ব্যাপারে সহযোগিতা করার মতো কেউ নেই। তারা নিজেরাই আগে ঠিক করুন, এখানে আসার পর কী করবেন। তারপর এখানে কলেজে যান। অফিসে কথা বলুন। ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করুন। নিজেই নিজের সমাধান পেয়ে যাবেন। আর দেশ থেকে আসার পর অনেক আত্মীয়স্বজন ভাববে, আমেরিকায় এসেই আপনার পড়াশোনা শুরু করার সক্ষমতা নেই। তাই ওসবে কান না দিয়ে নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেন। আর এখানে আসার পর কোনো তথ্য পেতে কারও সমস্যা হবে না। কারণ এখানে কলেজগুলোর হেল্প ডেস্ক খুবই হেল্পফুল।
সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার পর দেখবেন, আমেরিকা আসলেই সুন্দর। তাই শুরুর ধাক্কা সামাল দেওয়ার মতো মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখবেন। সম্ভাবনার এ দেশে আমার মতো বহু আগন্তুক দ্রুতই জায়গা করে নিয়েছে। বলতে গেলে এদের দাপটের গল্পই শুনতে হয় এখন প্রতিদিন। শুনি আর ভাবি, একদিন আমিও...।