বছরের ব্যবধানে দুবার সংবাদ শিরোনাম আলী

এক বছরের ব্যবধানে দুইবার সংবাদ শিরোনাম হলেন আমেরিকার নিউইয়র্ক নগরে কর্মরত বাংলাদেশি আমেরিকান সাইদ আলী। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিম দেশ থেকে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারির পর ২০১৭ সালের মে মাসে একবার সংবাদে এসেছিলেন আলী। ইস্তাম্বুল থেকে আসার পথে জেএফকে বিমানবন্দরে তখন তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হয়। সাবেক মার্কিন সেনা সদস্য সাইদ আলী কাস্টমস অ্যান্ড ইমিগ্রেশন বিভাগের দীর্ঘ তল্লাশি ও জেরার মুখে পড়েন।
জেএফকে-এর ঘটনা নিয়ে ২০১৭ সালের ১৫ মে নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আলী বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, আমার ব্যক্তিগত অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।’ তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, যারা জেএফকে দিয়ে আসবে, তাদের মধ্যে যাদের নামের শেষে ‘আলী’ থাকবে তারাই কি জঙ্গি সন্দেহের তালিকায় থাকবে। বাদামি চামড়ার যারাই বাইরে থেকে আসবে, তাদের কি জঙ্গি সন্দেহ করা হবে?
মাত্র এক বছরের মাথায় বাদামি চামড়ার এই সাইদ আলী বীরত্বের সম্মান পেয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমসসহ আমেরিকার সব সংবাদমাধ্যমে তার বীরত্ব আর পেশাদারির সংবাদ প্রশংসার সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে এসেছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশি অভিবাসী পরিবারের সন্তান সাইদ আলী।
বৈচিত্র্যের নগরী আমেরিকার নিউইয়র্ক। নিত্য জেগে থাকা এই নগরে প্রতিদিন হাসি-কান্নার নানা গল্প যুক্ত হয়। এ নগরে কিছু হলে মুহূর্তে ছড়িয়ে পরে সারা বিশ্বে। ঘটনার নগর নিউইয়র্কে এই বড়দিনের প্রাক্কালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাইদ আলীর কর্ম নিয়ে শুধু আমেরিকায় নয়, সর্বত্র উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশিরা।
২৩ ডিসেম্বর রাতে ইস্ট ব্রডওয়ের সাবওয়েতে (পাতাল রেল) দায়িত্বরত ছিলেন সাইদ আলী ৷ পাঁচ গৃহহীন মাতাল তাঁর ওপর হামলা করে ৷ মাতাল এসব গৃহহীনের সর্বোচ্চ পেশাদারত্ব দেখিয়ে সামাল দেন সাইদ আলী। মাতালদের ওপর হাতের লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার করে পিছিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করতে থাকেন আলী ৷ বলেন, ‘আমি তোমাদের আঘাত করতে চাই না৷’
এর মধ্যে মাতাল একজন তেড়ে আসে আলীর দিকে। পুলিশের দিকে হামলার জন্য তেড়ে আসায় দ্রুতই গুলি ছুড়তে পারতেন তিনি। আমেরিকায় প্রতিদিন এমন ঘটনা ঘটে। শুধু পুলিশের নির্দেশ অমান্য করলেই গুলি করার ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে কখনো হালকা অপরাধ বা নিয়ম ভঙ্গের সঙ্গে জড়িত লোকজনের প্রাণ যায়। ঘটনার সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন আলী। সহকর্মীদের বার্তা পাঠিয়ে একাই সামাল দেন তিনি। এক এক লাথিতে ছিটকে পড়ে আইন অমান্য করা মাতাল ভবঘুরের দল। প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত কোন এক যাত্রী দৃশ্যটি ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে তা ভাইরাল হয়ে যায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবাই সাইদ আলীর এই বীরোচিত ভূমিকার প্রশংসা করেন। নিজের এই হঠাৎ নায়ক হয়ে ওঠার খবর শুরুতে জানতেই পারেননি মাত্র তিন বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে আমেরিকায় আসা আলী। এক সহকর্মী বিষয়টি তার নজরে আনলে বিস্মিত হন তিনি।
আলীর জন্ম বাংলাদেশে। মাত্র তিন বছর বয়সে বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে আমেরিকায় আসেন আলী। বড় হয়েছেন ব্রুকলিনে ৷ ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাসদস্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন ৷ মাত্র ছয় বছর আগে যোগ দেন নিউইয়র্কের পুলিশ বাহিনীতে।
সংবাদমাধ্যমের সামনে আলী বললেন, ‘জীবন ভীষণ মূল্যবান, যেকোনো মূল্যে সেটি রক্ষায় কাজ করা উচিত ৷ সামরিক ও পুলিশ বাহিনীতে আমার যে প্রশিক্ষণ রয়েছে, সেটিই আমাকে পরিস্থিতি নানাভাবে সামলে নিতে পথ দেখিয়েছে ৷ আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিতীয়বার ভাবিয়েছে৷’
সহকর্মীদের নিয়েও সংবাদমাধ্যমে কথা বলেন আলী। জানালেন, প্রতিদিন নিউইয়র্কে এমন ঘটনা সামাল দিচ্ছেন তাঁর সহকর্মীরা। ভিডিও দেখে সাবেক কমিশনার বিল ব্রাটন টুইটারে এক বার্তায় আলীকে শুভেচ্ছা জানান৷ তিনি বলেন, আলীর এই ঘটনা নিউইয়র্কবাসী ও এখানকার রাজনীতিকদের মনে রাখা উচিত৷
ইতিমধ্যে হামলাকারী তিন মাতালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ ভিডিও ভাইরাল হওয়া প্রসঙ্গে আলী বলেন, তিনি জানতেন না, এটি ভিডিও হচ্ছে, সে সময় তিনি দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত ছিলেন৷ ঘটনার পরদিন সকালে বিভিন্নজনের ফোনে বিষয়টি জানতে পারেন৷ আলীকে নিয়ে এতটাই আলোড়ন হয় যে, গত ২৬ ডিসেম্বর তাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন করে বিশ্বখ্যাত পত্রিকা দ্য নিউইয়র্ক টাইমস। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিও দিয়ে নিউজ কাভারেজ দেয় বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল।
বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তা আলীর সাহসিকতার প্রশংসা করে টুইট করেন নিউইয়র্ক নগরের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও। ব্রুকলিনের কাউন্সিলম্যান চেইম এম ডাচ সাহসিকতার জন্য আলীকে দিয়েছেন বিশেষ সনদ। এনওয়াইপিডির ট্রানজিট ব্যুরোর সহকারী চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার ভিনসেন্ট কোগান তাঁর প্রশংসা করে দেওয়া বিবৃতিতে বলেন, অফিসার আলী মহৎ কাজ করেছেন।
নিউইয়র্ক পুলিশে কর্মরত বাংলাদেশি পুলিশ কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশি আমেরিকান পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন (বাপা) সাইদ আলীর সাহসিকতার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে। এনওয়াইপিডির ডিটেকটিভ জামিল সারোয়ার জনি বলেন, ‘তাঁর জন্য আমরা সত্যিই গর্বিত। বাংলাদেশিরা নিউইয়র্ক পুলিশে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে।’
নিউইয়র্কে পুলিশের প্যাট্রলম্যান বেনোভেল্যান্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট প্যাট লিঞ্চ বলেন, অফিসার সাইদ আলী চরম পেশাদারি দেখিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। ঘটনা ভিন্ন খাতে যেতে পারত। রক্ত ঝরতে পারত। প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারত।