ভোট আছে, ভোটার নেই!

‘আমি সত্যিই দুঃখিত এই অযাচিত ঘটনার জন্য’—একথা বলতে বলতে ফ্রেড সিম্পসন অফিসের দরজা পর্যন্ত হেলেনা–এডওয়ার্ড দম্পতিকে এগিয়ে দিলেন। মনো সিটির ডেপুটি ক্লার্ক ফ্রেডের কাস্টমার সার্ভিসে খুবই মুগ্ধ এই দম্পতি। ফ্রেড যেমন আন্তরিক তেমনি অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এই দম্পতি মনে করেন, সিটির প্রতিটি অফিসে এরকম লোক থাকলে মানুষের দুর্ভোগ অতি সহজেই মিটে যেত।
হেলেনা-এডওয়ার্ড দম্পতি এখন সিনিয়র সিটিজেন। অনেক বছর আগেই অবসরে গেছেন। বাড়ির ঋণ পরিশোধিত হলো গেল বছর। পেনশন আর বয়স্ক ভাতা দিয়ে তাদের ভালোভাবেই চলে যায়। ইউটিলিটি আর খাবার খরচ বহন করেও মাস শেষে কিছু সঞ্চয় থাকে যা দিয়ে প্রতিবছর হয় ইউরোপ অথবা ক্যারিবীয় দ্বীপের কোনো দেশে বেড়িয়ে আসেন। তাদের ছেলে মেয়ে দুজন নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। মেয়ের ঘরে এক ছেলে ও এক মেয়ে। দুই আর চার বছর বয়স ওদের। ছেলের ঘরে একটি মেয়ে। ছয় বছর চলছে। খুবই ব্যস্ত। দ্বিতীয় বাচ্চা নেওয়ার ফুসরত নেই। আসলে কোনো আগ্রহ নেই।
বিয়ের পর থেকে মনো সিটির এই বাড়িতেই এই দম্পতির বসবাস। মনো আসলে একটি মফস্বল শহর। বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে আছে কৃষি জমি। কয়েক শ একর জমি এক একজন কৃষক চাষ করে বিধায় সচরাচর গ্রামের মতো এখানকার গ্রামের বাড়িগুলো একটার পর একটা লাগোয়া না হয়ে অনেক দূরে দূরে অবস্থিত। মনে হবে এক একটা বাড়িই একটা গ্রাম। টরন্টো সিটি থেকে ৮৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এটি, গাড়ি চালিয়ে যেতে ঘণ্টা খানিক লাগে। মফস্বল শহর হলেও নাগরিক সব সুবিধা বিদ্যমান। মাত্র ৭ হাজার ৫০০ লোকের বসবাস হওয়ায় এলাকার একে অন্যকে খুব ভালোভাবে চিনে। এডওয়ার্ডের খুব ভালো লাগে যখন সপ্তাহান্তে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাদের প্রিয় পানশালায়।
সামনে সিটি নির্বাচন। কিন্তু এ নিয়ে মানুষের কোনো বিকার নেই। আনন্দ-উৎসব, হম্বি-তম্বি, টান টান উত্তেজনা এসব কিছুরই দেখা মেলে না। কোনো মিছিল সমাবেশ নেই। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কিছু পোস্টার দেখা যায়, এই যা। তাও আবার হাতে গোনা কয়েকটা। আরও দুইভাবে প্রার্থীরা জনগণের কাছে আসে। টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নিয়ে আর প্রার্থী নিজে ঘরে ঘরে এসে ভোট চেয়ে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানকার ভোটাররা এমন অসচেতন যে, কে কে প্রতিদ্বন্দ্বী তাও জানেন না। তাই প্রার্থীকে ঘরে ঘরে নক করে বলতে হয়, আমি এই এলাকার বর্তমান কাউন্সিলর/এমপি আমাকে ভোট দিয়ে আবার জয়ী কইরো। অথবা আমি নতুন প্রার্থী, তোমার ভোট চাই।
হেলেনা-এডওয়ার্ডের ঘরে প্রতিবারের মতো এবারও ভোটার কার্ড এসেছে ডাকযোগে। ভোটার কার্ডে নামের পাশাপাশি একটি গোপন পিন নম্বরও দেওয়া আছে। অনলাইনে অগ্রিম ভোট দেওয়ার জন্য এই গোপন পিন কোডটি লাগে। একটি তথ্যের উল্লেখ এখানে নেই, যেটি ছাড়া অনলাইনে ভোট দেওয়া সম্ভব নয়। আর সেই তথ্যটি সচেতনভাবেই ভোটার কার্ডে দেওয়া হয়নি। সেটি ভোটার মাত্রই জানবে। সেই তথ্যটি হচ্ছে ভোটারের জন্ম তারিখ। তাই কোনোভাবে ভুল ঠিকানায় ভোটার কার্ড চলে গেলেও জাল ভোট দেওয়া সম্ভব হবে না।
ভোটের টিকিট পেয়ে খুব একটা উচ্ছ্বসিত হননি বৃদ্ধ দম্পতি। জীবনে অনেকবার ভোট দিয়েছেন আর নেতাদের কাছ থেকে তেমন চাওয়া-পাওয়া নেই। জীবনের এই শেষ মুহূর্তে কি-ই বা আর চাওয়ার আছে? বাকি দিনগুলো ভালোভাবে কেটে গেলেই হয়। হেলেন সেই ছোটকাল থেকেই রিপাবলিকান ঘরানার আর এডওয়ার্ড ডেমোক্রেটিক সাপোর্টার। এ নিয়ে মাঝে মাঝেই দুজনের মধ্যে বেশ আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণ চলে। কিন্তু দিন শেষে যার যার অবস্থানে অটুট থেকে যায়।
বৃদ্ধ দম্পতি তাঁদের দুটি কার্ডের পাশাপাশি তৃতীয় আরেকটি ভোটার কার্ডের খাম দেখতে পেলেন। অবাক হলেন তারা। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছাড়া এই পরিবারে তৃতীয় সদস্যের স্থান নেই অনেক বছর ধরে। ছেলে–মেয়েতো সেই অনেক আগেই এই বাড়ি ছেড়ে নিজ নিজ সংসার পেতেছে। মাঝেমধ্যে ছুটি কাটাতে এই বাড়িতে পা পড়ে ওদের। ‘তাহলে কি সিটি আমাদের অন্তিম কাল বুঝে গিয়ে উত্তরাধিকার গছিয়ে দিল নাকি?’- আক্ষেপের সুরে এডওয়ার্ড বললেন।
এসব ভাবতে ভাবতে তৃতীয় খামটি খুলে তাদের চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। সে কি? কোকির নামে ভোটার কার্ড? কোকির নামটা দেখেই বুকের ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠল এই দম্পতির। একসময় কোকি ছিল তাদের ভালো সহচর। সব সময় সঙ্গে সঙ্গে থাকত, খুব অনুগত ছিল, কথার এদিক-ওদিক কখনো করেনি। হঠাৎ একদিন কি কাঁপুনি দিয়ে জ্বরে পড়ল, জরুরি হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ মধ্যেই তার চোখ বুজে গেল। চিকিৎসকদের অনেক চেষ্টায়ও ওই বন্ধ চোখ আর খোলা সম্ভব হয়নি। অসম্ভব মায়া লাগিয়ে পৃথিবী ছেড়ে পরপারে চলে গেছে। চার বছর হয়ে গেল সে মারা গেছে। আর এখন তার নামে চিঠি। তাও আবার ভোটার কার্ড।
মৃত কারও নামে ভোটার কার্ড ইস্যু হতে পারে বৃদ্ধ দম্পতির জানা ছিল না। সিটির লোকগুলো যে কি করে? ঠিকঠাক কাজে মনোযোগ থাকলে এ রকম ভুল হয় কি করে? এর আগে তো কোনো দিন এরকম ভুলভাল করেনি সিটি। তাই বৃদ্ধ দম্পতি শরণাপন্ন হলেন সিটি অফিসে। আর এ নিয়েই সিটির ডেপুটি ক্লার্ক ফ্রেড সিম্পসনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ফ্রেডের অফিস থেকে বেরিয়ে বৃদ্ধা আক্ষেপ করে বলেন, জীবদ্দশায় যে কখনো চিঠিপত্রের মুখ দেখেনি মৃত্যুর পর সে কিনা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছে। জীবদ্দশায় সে সুযোগ পাবে কি করে? জন্তু–জানোয়ারেরা কি কখনো চিঠি বা ভোটার কার্ড পায়?