যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে রহস্যময় ব্যক্তিত্ব

রবার্ট ম্যুলার
রবার্ট ম্যুলার

তিনি কদাচিৎ কোনো সাক্ষাৎকার দেন। জনসমক্ষেও তাঁকে তেমন দেখা যায় না। তবে তাঁকে নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। কারণ, তিনি ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে তদন্ত করছেন। একপক্ষের কাছে তিনি অসত্যের চাদর সরিয়ে সত্য উন্মোচনের দক্ষ কর্মী। আরেক পক্ষের অভিযোগ, তিনি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হটানোর ষড়যন্ত্রে যুক্ত। যাঁকে নিয়ে এত কিছু তাঁর নাম রবার্ট ম্যুলার। তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে রহস্যময় ব্যক্তিত্ব মনে করা হয়। কীভাবে তিনি এমন অবস্থানে পৌঁছালেন, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিবিসি অনলাইন।

রবার্ট ম্যুলার ১৯৪৪ সালে ম্যানহাটনের এক ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বড় হয়েছেন নিউজার্সির প্রিন্সটনে। নিউ হাম্পশায়ারের সেন্ট পল বোর্ডিং স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন। সে সময়ই তাঁর নৈতিক মূল্যবোধ অন্য সহপাঠীদের নজর কেড়েছিল। ওই স্কুলে ম্যুলারের সহপাঠী ম্যাক্সওয়েল কিং তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন ব্যতিক্রমী একজন মানুষ। ছোটবেলায় তিনি লক্ষ্যের প্রতি খুবই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। পছন্দ-অপছন্দের বিষয়েও ছিলেন সোজাসাপটা।’

স্কুল জীবনের উদাহরণ টেনে ম্যাক্সওয়েল বলেন, একবার স্কুলের পাশে দাঁড়িয়ে খাবার খাচ্ছিলেন তাঁরা কয়েক বন্ধু। এর মধ্যে একজন কাউকে নিয়ে বাজে রসিকতা করছিলেন। ম্যুলার সেখান থেকে চলে যান। সবার কাছে এই বার্তা দেন, তিনি বিষয়টি পছন্দ করলেন না। তিনি বলেন, ‘রবার্ট ম্যুলার স্কুলে ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। আমরা জানতাম তিনি বড় হয়ে সরকারি চাকরিতে গেলে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করবেন। আমাদের ধারণা সত্য হয়েছে। তিনি খুব ভালোভাবে তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন।’

রবার্ট ম্যুলার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তাঁকে ভিয়েতনামে পাঠানো হয়। ২০০২ সালে ম্যুলার এক বিরল সাক্ষাৎকারে এই সিদ্ধান্তের কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধে প্রিন্সটনে আমার এক বছরের বড় বন্ধুর মৃত্যু আমাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছে। আমার মতো আরও অনেকের মনে হয়েছিল, তাঁর মতো হওয়া উচিত আমাদের।’ যুদ্ধে সাহসিকতার কারণে তিনি পুরস্কৃত হয়েছিলেন।

ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে ফিরে রবার্ট ম্যুলার ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ায় আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি কৌঁসুলি হিসেবে সান ফ্রান্সেসকো, বোস্টনসহ বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। এ ছাড়া তিনি সন্ত্রাস, মুদ্রা পাচারসহ গুরুতর অপরাধের তদন্তের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯০ সালে তিনি বিচার বিভাগে যোগ দেন।

‘অ্যা হিস্ট্রি অব দ্য এফবিআই’ বইয়ের লেখক টিম উইনার বলেন, ‘রবার্ট ম্যুলার আইনজীবী হিসেবে কোনো আইনি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে প্রচুর টাকার মালিক হতে পারতেন। তিনি তা না করে খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ হিসেবে পরিচিত ওয়াশিংটন ডিসির অপরাধবিষয়ক আদালতে কৌঁসুলি হিসেবে যোগ দেন।’

২০০১ সালের আগস্টে রবার্ট ম্যুলার এফবিআইয়ের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। পরের মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি কাজে যোগ দেন। এর পরই ঘটে ৯/১১-তে টুইন টাওয়ারে ভয়াবহ হামলার ঘটনা। বিশ্ব রাজনীতির গতি-প্রকৃতি বদলে দেওয়া এই হামলায় প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারান। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বেশ কঠিন যেকোনো মানুষের জন্য। কিন্তু ম্যুলার সেই কঠিন সময় অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় দক্ষতার সঙ্গে পাড়ি দেন।

ম্যুলারের সঙ্গে কাজ করা এফবিআইয়ের সাবেক এজেন্ট আলী সুফিয়ানের কথায়ও এর সত্যতা মেলে। তিনি বলেন, ম্যুলার এফবিআইকে ঐতিহ্যবাহী আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর বদলে বুদ্ধিবৃত্তিক গোয়েন্দা-নির্ভর সংস্থায় পরিণত করেন।

রবার্ট ম্যুলারের এই দক্ষতার প্রশংসা করে প্রিন্সটনে ইতিহাসের অধ্যাপক জুলিয়ান জেলিজার বলেন, মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে জোর গুঞ্জন আছে। এই তদন্তের বিষয়ে জানতে গণমাধ্যম তৎপর। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তো নানা হুমকি-ধমকি দিয়েই যাচ্ছেন। এমন অবস্থায় কোনো তথ্য প্রকাশ না করে, কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নীরব থাকতে পারাটা অনেক বড় গুণ। সবার কথা উপেক্ষা করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজের কাজটি করে যাচ্ছেন তিনি। এটি সত্যিই বিরল। আর এত কিছুর সঙ্গে থেকেও নীরবে আর আড়ালে থাকার গুণ তাঁকে রহস্যময় ব্যক্তিত্ব পরিণত করেছে।