একটি আধুনিক প্রেমের গল্প

>মিথিলা গাজীর বয়স যখন ১১ বছর, তখন তার সঙ্গে জেরেমি পেরেজের পরিচয় হয়। পরে ওদের বন্ধুত্ব গড়ায় প্রেমে। ২৩ বছর বয়সী মিথিলা দুই বছর আগে বিয়ে করেছেন জেরেমিকে। জেরেমি যে শুধু ওর ভালোবাসার মানুষ তা নয়, ওর স্বপ্ন পূরণেরও মানুষ! মিথিলার সঙ্গে এখন প্রবাসী বাঙালিদের নাটকের দলে অভিনয় করছেন তিনি।
Valentines-Day-photo-feature-IMG_7921
Valentines-Day-photo-feature-IMG_7921

প্রেম ব্যাপারটা বড় গোলমেলে, বড় ‘কমপ্লিকেটেড’ বা জটিল। মহাজ্ঞানীজন আমাদের পই পই করে বারণ করেছেন, সাবধান, প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে ভুবনে। যেকোনো মুহূর্তে পা হড়কে পড়তে পার। সে কথা জেনেও আমরা স্বেচ্ছায় সে বিষ পান করতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু ঠিক কি খুঁজি আমরা প্রেমে? মানুষের মন না তার শরীর? নাকি এই দুইয়ের বাইরে অন্য কিছু মহত্তর?
কবিরা চিরকালই প্রেমের ব্যাপারে আমাদের ব্যারোমিটার। প্রায় ৫০০ বছর আগে এক বাঙালি কবি প্রেমের জ্বালা ব্যাপারটা বুঝিয়ে ছিলেন এভাবে
আঁখি ঝুরে পুলকেতে প্রাণ কাঁদে নিতি/খাইতে সোয়াথ নাই নিন্দ গেল দূরে।
একুশ শতকে এসে নিউইয়র্কের এক বাঙালি কবি সেই কথাটাই বলেছেন, তবে কিছুটা রাখঢাক ছাড়া—
অমলা শীতের রাইত-কেম্‌নে আমি একলা ঘুমাই/কার বুকো হাত রাখি–কার পা-ও পাও/কার ভালা লাগে কও একলা বাইতে নাও।
আমি নিজে এক তরুণ বন্ধুর বিয়ের ওকালতি করতে গিয়ে ‘বুকে জ্বালা–টক টক ভাব’ প্রেমের এই ব্যাপারটা বেশ ভালোভাবে টের পেয়েছিলাম। তখনো আমার নিজের বিয়ে হয়নি, জ্বালা-টালা থেকে তখন পর্যন্ত স্বস্তিতে আছি। এক ইংরেজি মাসিক পত্রিকায় কাজ করি, সেখানে আমার এক সহকর্মী, বলতে পারেন ছোট ভাই, একদিন হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, তাঁর সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন বাঁচার একটা পথ খুঁজে দিতে হবে।

আমরা তো অবাক। কী এমন ঘটল যে ছেলের জান যাওয়ার জোগাড়। জানাল, যে মেয়েটাকে ও ভালোবাসে, তার ডাকাবুকো বাবা টের পেয়ে জোর করে তার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই না, যার সঙ্গে বিয়ে সে ছেলে বিদেশে থাকে, বিয়ে করেই সাত দিনের মধ্যে বউ নিয়ে বিদেশে চলে যাবে। এখন আমার কী হবে, দাদা? হাত ধরে প্রায় কেঁদে ফেলে সে।
পত্রিকার হাই কমান্ড মিটিংয়ে বসল, কী করা যায়। আমাদের চোখের সামনে একটি ফুলের মতো জীবন অকালে ঝরে যাবে, তাতো হতে দেওয়া যায় না। সেটা এরশাদ আমল, পত্রিকার সম্পাদক ও আমাদের নেতা ছিলেন এক সাবেক সেনা কর্মকর্তা। টেবিলে চাটি দিয়ে বললেন, কুচ পরোয়া নেই। আমরা মেয়েকে উঠিয়ে এনে বিয়ে দেব, দেখি কে ঠেকায়! তিনি আমাদের প্রেমিক প্রবরকে বুদ্ধি দিলেন, কাল দুপুরের দিকে তুমি ভুলিয়ে–ভালিয়ে মেয়েকে মগবাজারের কাজী বাড়ি নিয়ে এস। হাসানের বাড়ি মালিবাগে। সে কাজী অফিসে আগে থেকে গিয়ে সব ব্যবস্থা করে আসবে। আমি তিনটার মধ্যেই পৌঁছে যাব।

মেয়ের বাবা টের পাওয়ার আগেই বিয়ের কাজটা সারতে হবে। আর হ্যাঁ, যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার তাঁর মনে পড়েছে—এভাবে বললেন, শোন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের বিয়েটা ‘কনসামেট’ করতে হবে।
‘কনসামেট’ কথার মানে কি তখনো আমার অজানা।
পরদিন সকালে নাশতা খাচ্ছি, হঠাৎ দেখি আমার সেই ছোট ভাই রিকশায় বাচ্চা মতো এক মেয়ে নিয়ে এসে হাজির। বড় জোর ষোলো-সতেরো বছর বয়স, উত্তেজনায় চোখমুখ একদম কাঁপছে। আমাদের প্রেমিক প্রবরের কিন্তু বিন্দুমাত্র উদ্বেগ নেই, রীতিমতো লাফাচ্ছে, দেখে মন হয় কেটলিতে চায়ের পানি ফুটছে। আমি বললাম, কী ব্যাপার, এত আগে কেন? ছেলেটি জানাল, কলেজে যাওয়ার নাম করে সকালে মেয়েটি বেরিয়েছে, সেখান থেকেই পগারপার। পথে এক সোনার দোকানে থেমে একটা এনগেজমেন্ট রিং কিনেছে, মেয়েটি লজ্জায় রাঙা হয়ে তাও দেখাল। আর্মি অফিসার ভাই তো আসবে দুপুরে, কাজির অফিসে। এতক্ষণ কোথায় থাকবে, কি করবে, ঠিক ঠাহর করতে না পেরে আমার বাসায় এসে উঠেছে।

অগত্যা আমার নিজের ঘরটা ছেড়ে দিতে হলো। বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকি, নিজে ব্যাচেলর, নয়-ছয় করে নানা কথা বলে ওদের থাকার ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু সেই যে সকাল এগারোটায় তারা ঢুকেছে, আর বেরোবার নাম নেই। বার দু-এক দরজার কড়া নেড়ে এলাম, সাড়াশব্দ নেই। মা একবার চা-নাশতা দিয়ে কাজের ছেলেটাকে পাঠালেন। ছোট বোনটা মুখে কিছু বলল না, কিন্তু আমার সামনে দিয়ে বার দু-এক হেঁটে যাওয়ার সময় মুখ টিপে হাসল। আমি তো ভয়ে ঘামছি। অবশেষে দুপুর আড়াইটার দিকে খুব সন্তর্পণে প্রথমে ছেলেটি, পরে মেয়েটি ঘর থেকে বেরোল। আমি প্রায় হামলে পড়লাম, কি হলো, তোমরা সেই যে ঢুকেছ, আর বেরোবার নাম নেই। কিছু খাবে-টাবে না? যেতে হবে তো।
ছেলেটি হাতজোড়া পেছনে আড়মোড়া ভেঙে, মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে, যেন খুব মহৎ একটা কথা বলছে, এভাবে বলল, বিয়ের আগেই কনসামেট করে এলাম।