গত রোববার বিকেলে বাংলাদেশ বিমানের ময়ূরপঙ্খী নামের একটি উড়োজাহাজ ১৪২ জন যাত্রীসহ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার পথে এক ছিনতাইচেষ্টাকারীর কবলে পড়েছিল বলে যে অভিযোগ করা হচ্ছে, সেই ঘটনা নিয়ে জনমনে নানা ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উড়োজাহাজটি চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ওই বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জের সামনে সংবাদ ব্রিফিংয়ে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান বলেন, অস্ত্রধারী ব্যক্তিটি কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়েছেন। তাঁর কাছে একটি পিস্তল ছিল। তাঁর বয়স ২৫ থেকে ২৬ বছর।
কিন্তু বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সোমবার চট্টগ্রামের পতেঙ্গা মডেল থানায় এ বিষয়ে যে মামলা দায়ের করেছে, তার এজাহারে পিস্তল বা কোনো অস্ত্র উদ্ধারের কথা উল্লেখ করা হয়নি। বলা হয়েছে, ‘দুষ্কৃতকারীর হাতে বোমা ও অস্ত্রসদৃশ বস্তু দেখা গেছে। সে দুটি পটকাজাতীয় বস্তুর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।’ এই মামলা দায়ের করার আগের দিন রোববার রাতে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ওই যুবকের কাছে পাওয়া বস্তুটি খেলনা পিস্তল। তাঁর কাছে কোনো বিস্ফোরকও ছিল না। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি বলেছেন, উড়োজাহাজের ভেতরে ওই যুবকের সঙ্গে প্যারা কমান্ডোদের গোলাগুলি হয়েছিল, তাতে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন, পরে মারা গেছেন। কিন্তু বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম নাইম হাসান বলেছেন, উড়োজাহাজের ভেতরে গুলি হলে এয়ারক্র্যাফটে ছিদ্র হওয়ার কথা, গুলির চিহ্ন থাকার কথা। সে ধরনের কোনো চিহ্ন বা প্রমাণ তাঁরা পাননি।
এ রকম পরস্পরবিরোধী কথাবার্তায় পুরো বিষয়টি বেশ রহস্যময় হয়ে উঠেছে। যেসব প্রশ্ন ঘুরেফিরে উচ্চারিত হচ্ছে, সেগুলো এ রকম: পলাশ আহমদ নামের যুবকটির কাছে কি সত্যিই পিস্তল ও বিস্ফোরক ছিল? যদি থেকে থাকে, তাহলে সেসব নিয়ে তিনি বিমানবন্দরের কয়েক ধাপের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে উড়োজাহাজে উঠে বসেছিলেন কীভাবে? বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থার ভেতরের কারও সহযোগিতা ছাড়া কি এটা করা সম্ভব? আর যদি তাঁর কাছে কোনো অস্ত্র ও বিস্ফোরক না–ই থাকত, তাহলে তাঁর ওপর কমান্ডো অভিযান পরিচালনার প্রয়োজন পড়েছিল কেন? সব যাত্রী নেমে যাওয়ার পরে উড়োজাহাজটির ভেতরে ওই যুবক যখন একা ছিলেন, তখন তাঁর ওপর কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করার কী যুক্তি ছিল? নাকি তাঁকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দিতে আরও সময় দেওয়া যেত?
এসব প্রশ্নের উত্তর প্রয়োজন। রোববারের ঘটনাটি তদন্তের জন্য যথারীতি একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে যে প্রতিবেদন পেশ করবে, তা থেকে অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলবে, এমন একটি আশ্বাস বিমানসচিবের বরাতে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ ধরনের চাঞ্চল্যকর ও রহস্যময় ঘটনাগুলো সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য বিশদ বক্তব্য জনসমক্ষে প্রকাশের দৃষ্টান্ত বেশ বিরল। অধিকাংশ ঘটনাই রহস্যাবৃত থেকে যায়। এর ফলে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি দুর্বল হয়ে পড়েছে।
রোববারের ঘটনাটির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি পক্ষের দায়িত্বশীলতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিশেষত দেশের প্রধান বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থার প্রশ্ন, যার সঙ্গে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের জাতীয় ভাবমূর্তি জড়িত। তা ছাড়া এ ধরনের কৌতূহলোদ্দীপক ও চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনা সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জনসাধারণের জানার অধিকার আছে। তাই ঘটনাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, সে বিষয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য সরকারি ভাষ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা একান্ত প্রয়োজন।