৬০ বছরের তরুণী!

প্রতিবছর বিশ্বের ১৫০টি দেশে প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখ বারবি পুতুল বিক্রি হয়। ছবি: এএফপি
প্রতিবছর বিশ্বের ১৫০টি দেশে প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখ বারবি পুতুল বিক্রি হয়। ছবি: এএফপি

এ বছরই ষাট বছর হয়ে যাচ্ছে মেয়েটির। দিনক্ষণের বিচারে বয়স বেড়েছে বটে, কিন্তু শরীর ঠিক তেমনই আছে। কোমল মুখেও নেই বয়সের ছাপ। কোনো সময় সে স্বর্ণকেশী, কখনোবা কালোকেশী। রাজকুমারী হোক বা প্রেসিডেন্ট, কালো বা সাদা যে বরণই হোক, চিরদিনই শিশুকন্যাদের প্রিয় সে। বলছি সবার প্রিয় মিষ্টি মেয়ে বারবির কথা। বহু বছর ধরে চরিত্রটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও শিশু-কিশোরীর সব সময়ের প্রিয় বারবি।

খেলনা প্রস্তুতকারক কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পাঁচ যুগ ধরে ব্যবসা করে যাচ্ছে বারবি। প্রতিবছর বিশ্বের ১৫০টি দেশে প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখ বারবি পুতুল বিক্রি হয়। বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বারবির গল্প।

আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড বারবির বিপণন পরিচালক নাথান বেনার্ড বলেন, ৬০ বছর ধরে সাফল্যের সঙ্গে চলা বিশাল ব্যাপার। বিশ্বব্যাপী কোকাকোলা, ম্যাকডোনাল্ডসের মতোই পরিচিত বারবি ব্র্যান্ড।

বারবির প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পুতুল নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ম্যাটেল। ১৯৫৯ সালের ৯ মার্চ প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা রুথ হ্যান্ডলার নিউইয়র্কে ‘আমেরিকান টয় ফেয়ারে’ হাজির করেন বিশ্বের প্রথম বারবি ডলকে। সেটি ছিল সোনালি চুলের ১১ ইঞ্চি লম্বা পুতুল। সে-ই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম তরুণী পুতুল।

বেনার্ড শোনান বারবির জন্মের গল্প। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের পুতুলগুলো ছিল শিশু চরিত্রের। বারবির নির্মাতা রুথ খেয়াল করলেন, তাঁর ছোট মেয়ে বারবারা আর এ ধরনের পুতুল পছন্দ করছে না। একটু একটু করে বড় হচ্ছিল বারবারা, সেই সঙ্গে সাধারণ বেবিডলগুলো তার সঙ্গ হারাচ্ছিল। তখনই রুথ তরুণী পুতুল তৈরির চিন্তা করেন। তৈরি করেন বারবি। রুথের ছোট্ট মেয়ে বারবারার নামের সঙ্গে মিল রেখে এর নাম রাখা হয়। বারবি হচ্ছে বারবারার একটি ছোট সংস্করণ।

বেনার্ড বলেন, প্রথম পুতুলটি যেন রাতারাতি শেখাতে শুরু করে যে মেয়েদের নিজস্ব পছন্দ আছে। তারা জীবনে যা ইচ্ছে তা–ই হতে পারে। ১৯৫৯ সালের প্রেক্ষাপটে এটি খুবই ভিন্ন ধারণা ছিল। বারবি খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা পায়। প্রথম বছরই তিন লাখ বারবি বিক্রি হয়।

তবে একদম শুরুতে এতটা নারীবাদী চরিত্র ছিল না বারবি। কয়েক বছর ধরে সমালোচনায় যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

বারবির ডিজাইনার কার্লাইল নুয়েরা বলেন, ১৯৫৯ সালে প্রথমে বারবির গঠন অতিরঞ্জিত করে তোলা হয় নান্দনিক সময় ও সহজলভ্য কাপড়ের মধ্যে মিল করে।

প্রথমে স্বর্ণকেশী হিসেবেই দোকানে আনা হয় বারবিকে। পরে অবাস্তব শারীরিক গঠন—এমন অনেক অভিযোগের ভিত্তিতে ম্যাটেল অনেক পরিবর্তন আনে বারবির। একাধিক শরীরের ধরন, কয়েক ডজন চামড়ার রং প্রবর্তন করে।

তবে বারবির বিরুদ্ধে সব সমালোচনা অযৌক্তিক ছিল বলে মনে করেন ‘ফরএভার বারবির’ লেখক এম জি লর্ড। তিনি বলেন, বারবি হচ্ছে সেটাই, যা একটি শিশু হতে চায়। শিশু বারবি পুতুল কে কীভাবে দেখতে চায়, তা বেশির ভাগ সময়ই নির্ভার করে শিশুটির মা নারীবাদ নিয়ে কীভাবে ভাবছেন। এখানে সমস্যাটা সাড়ে ১১ ইঞ্চির পুতুলটার নয়। সমস্যা হলো বড় সংস্কৃতি ও নারীবাদের সঠিক ধারণা।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে এসেছে বারবি। ১৯৬৫ সালে নভোচারী চরিত্র আসে বারবি। তখনো নীল আর্মস্ট্রং চন্দ্র বিজয় করেননি। ১৯৬৮ সালে তৈরি হয় প্রথম কালো বারবি। ২০১৭ সালে হিজাব পরা বারবি তৈরি করে ম্যাটেল। সম্প্রতি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে শারীরিক প্রতিবন্ধী বারবি তৈরিরও। বাস্তব অনুপ্রেরণা দানকারী নারী চরিত্রের আদলেও তৈরি হয়েছে বারবি। এখন স্বর্ণকেশী বর্ণবাদী ধারণায় পড়ে নেই বারবি। বারবির গ্লোবাল ম্যানেজার লিসা ম্যাক নাইট বলেন, বর্তমানে যে বারবিগুলো বিক্রি হয়, সেগুলো একেবারে মিশ্র গঠনের। না স্বর্ণকেশী, না নীল চোখের।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বিক্রি হয়েছে বারবি। বারবি ড্রিম হাউস ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ১০ খেলনার মধ্যে ছিল।

বারবি কি আসলে কেবল একটি পুতুল? একটি খেলনার সাফল্যের গল্প। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে আসা বারবি শিশু-কিশোরীদের কাছে ফ্যাশন আইকনও। তার নানা রকম পোশাক ও সাজ তাকে অন্যদের কাছে অনুকরণীয় করে তুলেছে। এমনটা মনে করেন বিশ্লেষকেরাও। তাঁরা বলছেন, বারবির ব্যাপক সামাজিক মিডিয়া উপস্থিতি আছে। লাখ লাখ অনুসারীর ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে বারবি। সে নানাভাবে শিশু–কিশোরীদের স্বপ্ন দেখায়।

ট্রেড ম্যাগাজিন টয় বুকের সম্পাদকীয় পরিচালক জ্যাকি ব্রেয়ার বলেন, প্রতিটি পেশার চরিত্রে আসতে পারে বারবি। বিশেষ করে বর্তমান পরিবেশে। নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপ্তি বিশাল আর এটিই বারবির সাফল্যের অন্যতম কারণ।

৯ মার্চ বারবির জন্মদিন। বয়স তার ৬০ হলেও এই হাসিখুশি মেয়েটি সব সময় স্বপ্নকে তাড়া করতে শেখাচ্ছে।