সময় পেলে বেড়িয়ে আসুন

‘ভ্রমণ’ শব্দটি পুরোনো ফরাসি শব্দ ‘ট্রেভেইল’ মানে ‘কাজ’ থেকে উৎপত্তি। কিন্তু ভ্রমণ শব্দটির মানে মানুষ ভেদে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। মানুষ নানা কারণে ভ্রমণ করে। কেউ ভ্রমণ করে চাকরির জন্য, কেউ বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতির জন্য ভ্রমণ করে, আবার কেউবা ভ্রমণ করে শরীর ও মনের প্রফুল্লতার জন্য। কিন্তু আমার কাছে ভ্রমণ অর্থ হচ্ছে স্বাধীনতা, যা খুশি তা করার স্বাধীনতা। দৈনন্দিন জীবনে শত ব্যস্ততার মধ্যে এই স্বাধীনতা ভোগ করার কথা একেবারেই চিন্তা করা যায় না। তাহলে কেন আমরা প্রতিনিয়ত ভ্রমণ করি না? আমরা কি তাহলে স্বাধীনতার পরিপন্থী? ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। যুক্তরাজ্যের মানুষ সারা জীবনে গড়ে ১০টি দেশ ভ্রমণ করে, জার্মানরা গড়ে ৮টি দেশ ভ্রমণ করে, ফরাসিরা গড়ে ৫টি দেশ ভ্রমণ করে আর মার্কিনরা গড়ে ৩টি দেশ ভ্রমণ করে।

ভ্রমণ না করার পেছনে অনেক কারণ থাকে। তার মধ্যে প্রধানত দুটি কারণ হচ্ছে অর্থ ও সময়ের অভাব।
১. অর্থের অভাব: আমাদের ভ্রমণ না করার পেছনে সম্ভবত প্রথম কারণটি হচ্ছে অর্থের অভাব। প্রকৃতপক্ষে, ভ্রমণের জন্য বেশি অর্থের প্রয়োজন হয় না। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে (চিফওএয়ার ডট কম, গুগল ফ্লাইটস, এক্সপিড়িয়া, ট্রাভেলওসিটি, ট্রিপঅ্যাডভাইজার, কায়াক, হটওয়্যার, ওরবিটজ, ট্রিভাগো এবং ট্রাভেলজু) নিত্যদিনে বিভিন্ন রকমের সেল বা মূল্যহ্রাস দেওয়া হয়। ফ্লাইটের দাম উঠানামা করে সব সময়। একটু খেয়াল করলেই সস্তা দামে ভ্রমণ করা সম্ভব। ট্রাভেল এজেন্সির প্রয়োজন হয় না। আমাদের স্মার্টফোন থেকে অ্যাপগুলো ডাউনলোড করে প্রতিনিয়ত চেক করলেই এয়ারলাইনসের ভালো ভালো অফার লুফে নেওয়া যায়।

২. সময়ের অভাব: অনেকে বলে সময়ের অভাবে কোথাও ভ্রমণ করতে পারছেন না। আরও বলে, সংসারে ছোট বাচ্চা আছে, কাজ মিস করা যাবে না, সংসারের অনেক কাজ পড়ে আছে ইত্যাদি। সংসার সব সময় থাকবে, সংসারের কর্মও সব সময় থাকবে। একটু খেয়াল করুন, আপনি মৃত্যুশয্যাশায়ী হয়ে পড়ে আছেন। যেকোনো সময় আপনার মৃত্যু হতে পারে। সারা জীবনে নিজেকে বলে এসেছেন, সময় পেলে আপনার স্বপ্নের দেশটিতে ঘুরতে যাবেন। কিন্তু সময়-সময় বলে আর সময় হয়নি। অন্যদিকে, ছোট বাচ্চাদের নিয়েও ভ্রমণ অনেক সুখকর হতে পারে। প্রথমত, বাচ্চারা অনেক কিছু শিখবে বহু দেশ ঘুরে। দ্বিতীয়ত, ওরা অনেক মজা করবে। তৃতীয়ত, বাচ্চা, বয়স্ক এবং বৃদ্ধদের জন্য সব বিমানবন্দরে আলাদা লাইন থাকে। সে জন্য আপনাকে বেশিক্ষণ লাইনেও দাঁড়াতে হবে না।

এবার ভ্রমণ করার উপকারিতা সম্বন্ধে কিছু জানা যাক।
১. স্বাস্থ্যের উন্নতি: ভ্রমণ দৈনন্দিন জীবনে থেকে স্ট্রেস কমায়। গ্লোবাল কমিশন অন এইজিং অ্যান্ড ট্রান্সআমেরিকা সেন্টার ফর রিটায়ারমেন্ট স্টাডিজ এবং ইউএস ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায়, ভ্রমণ স্বাস্থ্যের ব্যাপক উন্নতি করে। মনকে প্রফুল্ল রাখে। গবেষণায় আরও জানা যায়, যে নারী বছরে অন্তত দুই বার ভ্রমণ করে তার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেক কম হয়। আর যে পুরুষ ভ্রমণ করে না, তার হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়।
২. সৃজনক্ষমতা বৃদ্ধি: কলম্বিয়া বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক অ্যাডাম গালিনস্কি ভ্রমণ সংক্রান্ত গবেষণায় বলেছেন, ‘বৈদেশিক অভিজ্ঞতা আমাদের মনের বিকাশ, চিন্তাধারার পরিবর্তন এবং সৃজনক্ষমতা বৃদ্ধিতে অনেক সাহায্য করে।’ ভ্রমণের সময় আমাদের মন প্রফুল্ল থাকে। কারণ চাকরির কথা ও সংসারের কথা সহজে ভুলে থাকা যায়। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, শুধু ভ্রমণের পরিকল্পনা থেকে অনেক সুখ অনুভব করা যায়।
৩. নতুন নতুন খাবার খাওয়া: নতুন খাওয়ার আইটেম কার না ভালো লাগে। যেমন, আমরা চাইনিজ খেতে পছন্দ করি। অনেক সুস্বাদু তাই না। কিন্তু নিউইয়র্কে বসে বা ঢাকায় বসে চাইনিজ খাওয়া আর চীনে বসে চাইনিজ খাওয়ার মধ্যে বিশাল পার্থক্য আছে। আপনি যদি সুশি খাওয়া পছন্দ করেন, তাহলে জাপানে যান। সুশির প্রকৃত স্বাদ শুধু জাপানেই পাওয়া যাবে।

৪. অজানাকে জানা: ভ্রমণ করার আরেকটি সুফল হচ্ছে অজানাকে জানা। যখন আপনি নতুন দেশ ভ্রমণ করবেন, তখন অনেক অজানার মুখোমুখি হবেন। সে দেশের মানুষের আচরণ, মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, এমনকি ট্রাফিক প্যাটার্ন সম্বন্ধে আপনার ধারণা বৃদ্ধি পাবে। নতুন অনেক কিছু শিখতে বাধ্য হবেন। নিজের বেড়ে ওঠা স্থানের সঙ্গে সহজেই ভালো মন্দ তুলনা করতে পারবেন। আপনার জ্ঞানের পরিসীমা বৃদ্ধি পাবে।
৫. সারা জীবনের স্মৃতি: আমরা প্রতিদিন কত কিছুই না দেখি আর শুনি। প্রকৃতপক্ষে তার কতটুকু আপনার মনে থাকে? কিন্তু ভ্রমণের স্মৃতিগুলোকে আমরা সহজে ভুলতে পারি না। ভ্রমণে গিয়ে বেশি বেশি করে ছবি তুলতে ভুলবেন না। একদিন সেই ছবিগুলো আপনার ভ্রমণের স্মৃতিগুলোকে জাগিয়ে তুলবে। আপনার শরীর ও মন হঠাৎ করে প্রফুল্ল হয়ে যাবে।