নারীর যুদ্ধ ঘরে-বাইরে

রূপা খানম
রূপা খানম

নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করি প্রতিনিয়ত। পক্ষে–বিপক্ষে নানা যুক্তি দাঁড় করাই। নিজেই নিজের উকিল, নিজেই নিজের বিচারক। এ এক কঠিন লড়াই। হোঁচট খেতে খেতে আবার উঠে দাঁড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা। শক্তি–সাহস সঞ্চয় করি আশপাশের মানুষের কাছ থেকে। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক আমাকে বলছিলেন, সবকিছু ছেড়ে ফেলে অটিস্টিক ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে। তখন বেছে নিয়েছেন প্রবাস জীবন, সেই সঙ্গে নতুন করে নিজেকে তৈরি করেছেন, তখন মনে হয়েছিল, নাহ, আমি পারব। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারব আমি।
প্রতিষ্ঠিত স্বামীর ঘরে অটিস্টিক বাচ্চাকে নিয়ে লড়াই করার গল্প আরেকজন সাহসী লড়াকু নারীর। যিনি বাংলাদেশ থেকে এই প্রবাসে আসার পর কিছুই জানেন না, চেনেন না। নিজের চেষ্টায় নতুন জগতে নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন। আজ এক স্কুলের টিচার অ্যাসিস্ট্যান্ট তিনি। আর সব সময় হাসিমাখা মুখে বাঙালি কমিউনিটিতে নানা অনুষ্ঠানে দেখা যায় তাঁকে।
বোস্টন ইউনিভার্সিটির চিফ লাইব্রেরিয়ান বা প্রধান গ্রন্থাগারিক বলছিলেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে যখন তার বিচ্ছেদ হয়ে যায়, তখন তিনি লড়াই করেছেন। দুটি বাচ্চাকে মানুষ করতে লড়াই করেছেন, আর্থিক নিশ্চয়তার জন্য কাজ শুরু করেন। আবার নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টাও করেছেন। তাই একই সময়ে করেছেন পড়াশোনা। তখন মনে হয়, তার ঘড়ির কাটা কি ২৪ ঘণ্টাই ছিল? সন্তান দেখা শোনা, কাজ আবার পড়াশোনা।
নিউইয়র্ক শহরের আলো ঝলমলে রূপের পাশে অন্ধকারের গল্পও কম নয়। মানুষের ভিড়ে নির্ঘুম এই নগরীর একাকিত্বের গল্পও অনেক। এক সময় দাদার বাড়ি, নানার বাড়ির আদরের ছোট মেয়েটাকে রাখার সুযোগ ছিল, কিন্তু এই নগরীতে আমার কেউ নেই। একদিন বাচ্চার স্ট্রলার নিয়ে, বাচ্চার আট ঘণ্টা-নয় ঘণ্টা আমার সঙ্গে অফিসে থাকার প্রস্তুতি হিসেবে খাবার, কাপড় নিয়ে যখন সাবওয়ের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে পারছিলাম না, তখন খুব অসহায় লাগছিল। তখন প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে ভেবেছিলাম, পারব কি আমি এই শহরে এগিয়ে যেতে?
এমন সময় কানের কাছে কে যেন ইংরেজিতে বলল—আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি? তাকিয়ে দেখি, প্রায় ৮০ বছরের এক বৃদ্ধা। তখন নিজের প্রতিই লজ্জা লাগছিল। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলে উঠি, না আমি পারব। ধন্যবাদ তুমি আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলে বলে। এই বলে আমি এগিয়ে যাই। কত দিন অ্যাসাইনমেন্ট করতে গিয়ে ভুল ট্রেনে উঠে, পরে আবার সাইন দেখে দেখে সঠিক ট্রেন বেছে নেওয়ার গল্পও আছে। সেই আমিই নতুন গাড়ি কিনে প্রথম দিনেই সাহস করে হাইওয়েতে গাড়ি চালিয়েছি দুরুদুরু বুকের কম্পন নিয়ে। কিন্তু মনে মনে সাহস জুগিয়েছি, আমাকে পারতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে।
সব সময়ই মাকে খুব মনে পড়ে। খুব সাহস জোগান আমার মা। ছোট বেলা থেকে পড়তাম খুব সুন্দর করে। সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও মায়ের হাত ধরে পথ চলা। গান শেখা, আবৃত্তি শেখা, বিতর্ক করা। মা তখনই বলতেন, তুই টেলিভিশনে খবর পড়তে পারবি। স্কুলের বিতর্কে যখন হেরে যেতাম, মঞ্চে থেকে দেখতাম মায়ের চোখে জল। কিন্তু মঞ্চ থেকে নামার পর হাসিমাখা মুখ নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, দেখবি এরপর আরও ভালো করবি।

নিউইয়র্কের এক পাবলিক স্কুলের টিচার অ্যাসিস্ট্যান্ট রূপা খানম। একমাত্র সন্তান অটিস্টিক। পেশা ও সন্তানকে দেখাশোনার পাশাপাশি বাঙালি কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যায় তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি। বাধা–বিপত্তিকে নিয়েছেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। প্রতিনিয়ত সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে চলছেন তিনি
নিউইয়র্কের এক পাবলিক স্কুলের টিচার অ্যাসিস্ট্যান্ট রূপা খানম। একমাত্র সন্তান অটিস্টিক। পেশা ও সন্তানকে দেখাশোনার পাশাপাশি বাঙালি কমিউনিটির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যায় তাঁর প্রাণবন্ত উপস্থিতি। বাধা–বিপত্তিকে নিয়েছেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে। প্রতিনিয়ত সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে চলছেন তিনি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ভর্তি হই, প্রথম বছরেই টেলিভিশন বিতর্কে দল বাছাই নেওয়ার পরীক্ষা। মাকে বললাম, মা আমি তো মাত্র প্রথম বর্ষে, মাস্টার্সে পড়া আপুরা আছেন বিতর্কিক দলে, আমি কি পারব? মা বললেন, অবশ্যই পারবি। চেষ্টা কর। বাছাইয়ের দিন সবাইকে টপকে আমি প্রথমে। আমি দলনেতা। মাস্টার্সে পড়া আপুরা আমার অধীনে বিতর্ক করেন। এরপর নিজের হাতে হলে বিতর্কের সংগঠন মৈত্রী ডিবেটিং ক্লাব গড়া, দ্বিতীয় বর্ষেই প্রেসিডেন্ট। অর্গানাইজেশন কাজটিও দক্ষতার সঙ্গে করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল দলেও দলনেতা হওয়ার সুযোগ মেলে। চ্যাম্পিয়নের ট্রফিটিও আসে। টিএসসি মিলনায়তনে কত কত অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করা।
এরপর গণমাধ্যমে বিটিভি–রেডিও টুডে’তে কাজ করার পর বাংলাদেশের প্রথম নিউজ চ্যানেলে সিএসবিতে যখন কাজ করার সুযোগ পেলাম, মনে আছে প্রথম নিউজ পড়ার দিনটি। টানা প্রায় চার ঘণ্টা খবর পড়ে মাকে যখন ফোন দিলাম, কেমন হয়েছে? মায়ের কাঠ খোট্টা উত্তর, তুই তো চার ঘণ্টা বিতর্ক করলি। এরপর নতুন করে পরীক্ষা। নিজেকে ভাঙার পরীক্ষা। নিজেকে খবর পড়ার একজন মানুষ হিসেবে গড়া। প্রতিনিয়ত নিজেকে ভাঙি। একটি রাজনৈতিক অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে গেলে একরকম, একটি গানের অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে গেলে আরেকরকম।
তবে বাংলাদেশে সাজানো–গোছানো সংসার, ক্যারিয়ার রেখে এই নতুন দেশে যখন আসা, তখন প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করি নিজের সঙ্গে। রাস্তার নাম যে ইংরেজিতে বলতে হয় সব সময়, সেটিও শিখি, নতুন করে শিখি এখানকার স্থান চিনতে হলে স্ট্রিট অ্যাভিনিউ হিসাব করে এগোতে হয়। এর চেয়েও কঠিন এক পরীক্ষা দিতে হয় প্রতিনিয়ত, যখন নিজের মেয়ের সঙ্গে সময়ের হিসাব মেলে না। মেয়েটির সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য অপেক্ষা করতে হয় ছয়দিন। অপেক্ষা করে থাকি একটি রোববারের। আমার মেয়ে যেদিনের নাম দিয়েছে ‘ফান ডে’।
এ এক কঠিন লড়াই। মাঝে মধ্যে ভাবি, ছেড়ে দেব কি চাকরি! যখন ভোট কেন্দ্রে যাই, বৃদ্ধা জড়িয়ে ধরে আমাকে বলেন, তোমার সঙ্গে দেখা করার কত দিন ইচ্ছে ছিল আমার। তোমার খবর পড়া আমার খুব ভালো লাগে। বুকে ঝাপটে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, এই সভ্য দেশের নিয়মকে তোয়াক্কা না করেই। অপরিচিত এই বৃদ্ধার বুকে জড়িয়ে ধরার মাঝেও আমার শূন্য বুকটা হাহাকার করে ওঠে। নিজের মাকে বুকে ধরে রাখার জন্য অপেক্ষা, অপেক্ষা ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন।
মা বলেন, এটাই মেয়েদের জীবন চক্র। তুই যদি মেয়েকে সময় দেওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে দিস, তাহলে তোর মেয়েকে পড়াশোনা করানোর দরকার কি? ও তো ওর মেয়ের জন্য চাকরি ছেড়ে দেবে!
আবারও সাহস পাই, নিজেই নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়া। অসহায়ত্বের মধ্যে নিজেকে গোছানোর মন্ত্র খোঁজে নিই। নারীর জীবনের লড়াই একেকটি উপন্যাস। ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পও একেকটি মহাকাব্য। তবে নারীকে সমাজ-রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করার আগে, যুদ্ধ করতে হয় নিজের সঙ্গে। নিজের সঙ্গে এই যুদ্ধে যে জয়ী হয়, সেই খুঁজে পায় আত্মতৃপ্তির ঠিকানা।