প্রস্ফুটিত হোক নারীর পথচলা

আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা গ্রামে। আশির দশকের কথা, যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা রাখতেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার বিষয়টি ছিল খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। নিশিতা ইসলাম আমার দূর সম্পর্কের মামাতো বোন। রহিম মামা ছিলেন আমাদের এলাকার নামকরা ধনী মানুষ। তাঁর মেয়ে নিশিতা হাইস্কুলে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে। আমি আর নিশিতা একসঙ্গে স্কুলে যেতাম। পড়াশোনায় বেশ মেধাবী ও মনোযোগী ছিল নিশিতা।
মনে পড়ে স্কুলে যাওয়ার পথে নিশিতা প্রায় মন খারাপ করে আমাকে বলত, সে এখন বিয়ে করতে চাইছে না। কিন্তু পরিবার তার কোনো মতামত, ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেয় না। তার মায়ের কথা একটাই, মেয়েদের কম বয়সে ভালো বিয়ের প্রস্তাব যেভাবে আসে, বয়স বাড়লে পরে সেভাবে ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসবে না। নিশিতাকে বিয়ে দেওয়ার এখনই মোক্ষম সময়। এমন ভালো প্রস্তাবগুলো পরে নাও আসতে পারে। অতঃপর অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সম্পূর্ণ পরিবারের ইচ্ছানুযায়ী আমেরিকাপ্রবাসী ছেলের সঙ্গে নিশিতার বিয়ে হয়ে যায়।
পৃথিবী নামক এই গ্রহটা খুব ছোট। চলতি পথে ফেলে আসা মানুষগুলোর সঙ্গে আবার দেখা হয়ে যায় সহজেই। অনেক বছর পর নিশিতার সঙ্গে আবার আমার দেখা হয়ে যায় নিউইয়র্ক শহরের এক পথমেলায়। দেখতে ধবধবে সুন্দরী নিশিতার চোখেমুখে ক্লান্তির চাপ স্পষ্ট। অল্প বয়সে কেমন রোগা, মুটিয়ে গেছে বেশ। খোঁজখবর, কুশলাদি জানা শেষে আমরা দুজনে ফোন নম্বর বিনিময় করি। বাসায় ফিরে রাতেই নিশিতার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। তিন কন্যা সন্তানের জননী এখন সে। আক্ষেপ করে বলল, ‘বাবা–মায়ের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমাকে তাঁরা ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়ে দেয় অচেনা এক মানুষের সঙ্গে। আমেরিকা শব্দটার আড়ালে হারিয়ে যায় ছেলেটির ব্যক্তিগত, পারিবারিক সব পরিচয়। আমার বয়স কম ছিল। কিন্তু বাবা–মা তো জানতেন রুচিবোধ, মন মানসিকতা, পছন্দ। এই জিনিসগুলোতে একবারে দুই মেরুর দুজন মানুষ এক ছাদের নিচে বছরের পর বছর বসবাস করা কতটা যন্ত্রণার! বাবা চাইলেই আমাকে পড়াশোনা করিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারতেন। বাবার সে সামর্থ্য ছিল। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বেশির ভাগ মেয়েদের জীবন অন্ধকারেই ঢাকা পড়ে যায়। চাইলেও তারা সংসার, ছেলেমেয়ে সামলিয়ে আর পড়াশোনা করতে পারে না’
নিশিতা এই অল্প বয়সে অন্ধকারে পড়া মেয়েদের-ই একজন। তাঁর আর পড়াশোনা করা হয়নি। তাঁর মুখে শুনলাম, তার সন্তানদের স্কুলের পড়াশোনায় সে সাহায্য করতে পারে না। সে জন্য তার খুব খারাপ লাগে। বাচ্চার স্কুলের বন্ধু–বান্ধবদের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলতে না পারার দুঃখ তাঁকে কুড়ে কুড়ে খায়। বাচ্চাদের চিকিৎসক, স্কুলের জরুরি সভাগুলোতে তাঁকে দোভাষীর শরণাপন্ন হতে হয়। সেজন্য তার স্বামী প্রায়শই কথা শোনাতেও দ্বিধাবোধ করেন না। অথচ স্বামীর সংসার, সন্তান সামলাতে গিয়ে নিউইয়র্কে এসে তার পড়াশোনা কিংবা বাইরের দুনিয়ায় পা ফেলা একেবারেই সম্ভব হয়নি। টেলিফোনের অন্যপ্রান্তে নিশিতার তপ্ত দীর্ঘশ্বাস আমাকে করুণভাবে ছুঁয়ে যায়। বাকরুদ্ধ হয়ে বসে থাকি আমি টেলিফোনের এই প্রান্তে। টেলিফোন রেখে আপনমনে ভাবতে থাকি, নিশিতার রাতদুপুরের হাহাকার, নীরব অশ্রুপাত, দীর্ঘশ্বাসের তাপ কি লাগে না তাঁর বাবা–মা, ভাইদের গায়ে? আদরের কন্যা, বোন যখন কষ্টের নোনা স্রোতে ভেসে যায়, তখন তার পরিবার কেমন করে ভালো থাকে? মেধাবী নিশিতার পরিবার যদি তাঁর মতামত, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁকে পড়াশোনা করাতো, তাহলে আজ আর স্বামীর কটু কথা শুনতে হতো না, রাতদুপুরে কেঁদেকেটে বুক ভাসাতেও হতো না।
আজকের মেয়ে শিশুটিই আগামীকালের মা! আজকের কন্যা শিশুটিই আগামীকাল একজন পরিপূর্ণ নারী হবেন! নেপোলিয়ন বলেছিলেন, ‘আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও,আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি দেব।’ দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আজও আমাদের বেশির ভাগ পরিবারেই বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বস্ত্র সবকিছুতেই ছেলে সন্তানদের তুলনায় কন্যা সন্তানদের প্রতি বাবা–মায়েরা একটু বেশি অমনোযোগী থাকেন।
আমাদের দেশের পরিবারগুলোতে কন্যা সন্তানদের শিশুকাল থেকেই শেখানো হয়, মাথা নিচু করে হাঁটবে, নিচু স্বরে কথা বলবে, কোনো কথার প্রতি উত্তর করবে না, যে যা বলুক সব নীরবে সহ্য করে যাবে। পরিবারের ছেলেটি যা খুশি করবে, কোনো টু শব্দটি নেই। শত হোক ছেলে মানুষ, সব দোষ ত্রুটির ঊর্ধ্বে। কিন্তু মেয়েটির পান থেকে চুন খসলেই পরিবারের সবার শাসন, রক্তচক্ষুর চাহনি তাকে নীরবে চোখের জলে হজম করতে হয়। শিশুকালে পরিবার থেকেই কন্যা সন্তানদের মাথায় কিছু প্রোগ্রাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যা একটা মেয়েকে অথর্ব করে দেয়। যেমন, ‘যত সইবে তত রইবে, যত অবলা হবে, তত প্রশংসিত হবে’ ইত্যাদি।
আজ এই যুগেও আমি অবাক হয়ে বোবা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি যখন দেখি, একটা পরিবারে কন্যা শিশুটিকে শেখানো হয়, তোমার নিজের কোনো জীবন, ইচ্ছে নেই। চারপাশের সব সহ্য করে হাসিমুখে সবাইকে বলবে, আমি ভালো আছি! আজও আমাদের দেশে এমন অনেক পরিবার আছে, যেদিন ভালো খাবার রান্না হয় সেদিন ছেলেকে আগে খেতে দেবে, পরে মেয়েটিকে খেতে দেয়। অপ্রিয় হলেও সত্য, পড়াশোনা, চিকিৎসা সব ক্ষেত্রেই পরিবারে আগে ছেলেটির কথা ভাবা হয়, পরে মেয়ের কথা। সব পরিবার নয়, তবে আমাদের দেশের বেশির ভাগ পরিবার আজও তাঁদের মহামূল্যবান কন্যা সন্তানদের প্রতি এমন সব অন্ধকারাচ্ছন্ন মন মানসিকতা লালন করে রেখেছেন।
যে দেশে, সমাজে, পরিবারে আজও আমরা মেয়েদের মানুষ ভাবতেই শিখিনি, তাঁর ইচ্ছা–অনিচ্ছার মূল্যায়ন করতে জানি না, সে দেশে, সমাজে পরিবারে মেয়েদের শারীরিক, মানুষিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাববার সময় কই আমাদের!
একজন নারী পরিবার, সমাজ সর্বোপরি দেশের চালিকা শক্তি ও এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণাকারী। সব বাবা-মায়েদের প্রতি সবিনয় অনুরোধ করছি, আসুন আমরা সবাই মিলে পরিবারের কন্যা সন্তানটির প্রতি শতভাগ মনোযোগী হই, তাঁর ইচ্ছে, অনিচ্ছা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা ও তাঁর মতামতকে বিবেচনা করি। যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে, আত্মবিশ্বাসী, স্বনির্ভরশীল হতে কন্যা সন্তানটিকে পরিবার থেকেই উপযুক্ত করে গড়ে তুলি, সাহস দিই। কীভাবে নিজেকে সম্মান করতে ও ভালোবাসতে হয়, কন্যা সন্তানদের এই শিক্ষার হাতেখড়ি সবার আগে পরিবারকেই দিতে হবে।
আমাদের কন্যা শিশুরা যেন আগামীদিন শুধু নিজের চোখের পানি নয়, পরিবারের সবার চোখের পানি মুছে দিতে পারে সেজন্য আসুন—আমি, আপনি আমরা সবাই মিলে পরিবার থেকেই সেভাবে আমাদের কন্যা সন্তানদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে উপযুক্ত করে গড়ে তুলি।
ফুলে ফুলে প্রস্ফুটিত হোক পৃথিবীর সব কন্যা, নারীদের আগামীর পথচলা!