নারী মুক্তির জন্য চাই মানসিক পরিবর্তন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস নারীদের রাজনৈতিক-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের কথা মনে করিয়ে দেয়। মানব জগৎ নারী-পুরুষ উভয়কে নিয়েই। অথচ নারীদের অধিকারের স্বীকৃতির জন্য অতীতে আন্দোলন করতে হয়েছে। আজও করতে হয়।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রাসঙ্গিকভাবে নারীদের নিয়ে ভাবলে মনে আসে, ইতিহাসের কোন সন্ধিক্ষণে শুরু হয়েছিল নারী-মুক্তি আন্দোলন? যে মুহূর্ত থেকে নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়ে নারীরা চিন্তা করতে শুরু করেছিল, তখন থেকেই শুরু হয়েছিল মুক্তির চিন্তা। ঘরের ভাইটি খেলছে বল নিয়ে, বোনটি মাকে সাহায্য করছে ঘরের কাজে। কাজ করতে করতে মেয়েটি ভাবছে, আমারও খেলতে ইচ্ছে করে। আমি কেন মাকে সাহায্য করব? আমি কেন খেলব না? ইচ্ছে করে, কিন্তু পারি না, কেন পারি না? সেখান থেকেই শুরু হয় প্রতিবাদ করার স্পৃহা। জন্ম নেয় অধিকারবোধ। একই কাজ ছেলেদের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছামূলক আর মেয়েদের ক্ষেত্রে যখন বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে, তখনই মেয়েদের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠে। অবস্থার পরিবর্তনের জন্য লড়াই করে।
একটা সময়ে ফরাসি সিভিল কোডে বড় বড় করে লেখা থাকত। ১. স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীকে রক্ষা করা এবং স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর প্রতি অনুগত থাকা। ২. কোনো স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ছাড়া আদালতে মামলা করতে পারবেন না, এমনকি তিনি ব্যবসায়ী হলেও নয়। স্বামী তার সঙ্গে যোগ না-দিলে বা লিখিত অনুমতি না-দিলে কোনো স্ত্রী যদি সেখানে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন, কোনো কিছু বন্ধক দিতে বা সম্পদ অর্জন করতে পারবে না।
ফরাসি কিশোরী জোয়ান অব আর্ক সেই পঞ্চদশ শতকে পুরোনো মূল্যবোধকে ভেঙে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। সামাজিক বিধিনিষেধ অমান্য করেই তাঁকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। জোয়ান অব আর্ককে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। পৃথিবীর মানবীবিদ্যার ইতিহাসে প্রথম শহীদ হিসেবে তাঁর নাম উজ্জ্বল হয়ে আছে। ১৪০৫ সালে ফরাসি রাজসভায় একজন নারী সদস্য ছিলেন। তাঁর নাম ক্রিস্টিন দ্য পিজান। তিনি একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম সিটি অব লেডিস। পিজন মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। তিনি সে সময় লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি নারীদের জীবনের গভীর কষ্টকে অনুভব করেছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতায় রাজনৈতিক মতাদর্শের আলো না-থাকলেও অনুভব করেছিলেন পুরুষের মতোই নারীও মানুষ এবং মানবজাতির অংশ।
অনেক পরে ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালে পুরুষ নাগরিকদের অধিকার ঘোষণার পরে নারী সমাজ একই অধিকার নিয়ে এগিয়ে আসে। ফরাসি নাট্যকার ও বিপ্লবী অলাহান্দ্রো¤দ্য ওঁজ (১৭৪৮-১৭৯৩) নারীর অধিকারের কথা ঘোষণা করেন। তিনি নারীর জন্য রাজনৈতিক ও আইনি অধিকার দাবি করেন। তিনি লিখেন নারী জেগে ওঠো, গোটা বিশ্বে যুক্তির সংকেতধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তোমার অধিকারকে আবিষ্কার করো। ফরাসি বিপ্লবের সম্ভাবনা ইউরোপের নারীদের আইনি ও রাজনৈতিক দাবিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এ রকম এক পরিবেশেই মারি ওলস্টোনক্রাফট ও ভিন্ডিকেশন অব দি রাইটস অব উইমেন গ্রন্থটি লিখেছিলেন। একটা সময়ে এই বই নারী মুক্তি আন্দোলনের নেত্রীদের কাছে বাইবেলের মতোই ছিল। মারি ওলস্টোনক্রাফট পারিবারিক উৎপীড়নকে সামাজিক উৎপীড়নের সঙ্গে যুক্ত করে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। ফরাসি ও আমেরিকার বিপ্লব সমর্থন করা জনগণকে বুঝিয়েছিলেন, এই বিপ্লব যেমন ন্যায়সংগত তেমনি পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় অবস্থিত পারিবারিক নিপীড়ন থেকেও মেয়েদের মুক্তি দিতে হবে। তিনি বৈবাহিক সম্পর্ক ও পারিবারিক পরিকাঠামোর শ্রদ্ধা-ভালোবাসাকে নতুন আলোয় ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমেরিকার দাস প্রথা ও নারীর শোষণকে একই রকমের বলে ভেবেছিলেন সে সময়ের নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবক্তারা।
অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কয়েকজন অভিজাত শ্রেণির মেয়ে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে ও নারীমুক্তি আন্দোলনে শামিল হন। তাঁদের মধ্যেই দুই বোন সারা ও অ্যাঞ্জেলিনা গ্রিমের নাম উল্লেখযোগ্য। আরেকজন সক্রিয় নেত্রী লুক্রোশিয়া মট সেনেকা ফলস। তাঁরা উইমেন রাইটস কনভেনশন (Women Rights Convention) সংগঠিত করেছিলেন। মূলত ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়েই মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সারা ও অ্যাঞ্জেলিনা গ্রিম এবং লুক্রেশিয়া মট সেনেকা ফলস।
সেনেকা ফলসের কনভেনশনে নারীর অধিকারের জন্য মোট বারোটি প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল। সম্পত্তির অধিকার, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, ব্যবসা-বাণিজ্যে নারীদের অধিকারসহ আরও কয়েকটি অধিকার পেশ করার সময় বিশেষ অসুবিধা হয়নি। বারো নম্বর প্রস্তাবটি ছিল নারীদের ভোটাধিকার। এই অধিকার তখন ছিল না। ১৮৬৬ সালে জন স্টুয়ার্ট মিল, ইংরেজ দার্শনিক অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিক (১৮০৬-১৮৭৩) নারীর সমান অধিকারের দাবি জানিয়ে পার্লামেন্টে একটি আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলেন। এই আবেদনপত্রে দেড় হাজার নারী-পুরুষ স্বাক্ষর করেছিলেন। উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, বাটলার, হ্যারিয়েট মানিডু, মারি সমার ভিল প্রমুখ।
উনিশ শতকের শেষার্ধে বিভিন্ন নারী সংগঠন ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব উইমেনস সাফ্রেইজ সোসাইটির (National Union of Women’s Suffrage Society) ছাতার তলায় মিলিত হন। এর আগে আন্দোলন ছিল উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক শ্রেণির নারীদের আন্দোলন। কিন্তু ধীরে ধীরে নিম্নবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির নারীরাও এতে শামিল হন। শান্তি প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধের বিরোধিতা ও নারী প্রতিবাদের পক্ষে কলম ধরেন নারীবাদী লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২-১৯৪১)। তিনি চেয়েছিলেন নারীরা এমন এক সমাজ গড়ে তুলুক, যা হবে শান্তির। তিনি বিশ্বাস করতেন, মেয়েরা যুদ্ধকে বেশি ঘৃণা করে। কারণ যুদ্ধ তাদের অনেক বেশি কঠোরভাবে আঘাত করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের নারীরা ১৯১৯ সালে ভোটাধিকার পায়। ব্রিটেনের যেসব নারীর বয়স ত্রিশের বেশি তারা ভোট দিতে পারতেন এবং ব্রিটেনের নারী সমাজ একই বছর পার্লামেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পান। এরপর ১৯২৮ সালে এই আইনের সংস্কার হয়। সোভিয়েত রাশিয়া ১৯১৭ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ১৯২০ সালে মেয়েদের ভোটাধিকার দেয়। ফ্রান্সে ১৯৪৪ সালে এই অধিকার স্বীকৃত হয়।
আমেরিকা, ব্রিটেনে নারীমুক্তি আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় বিশ শতকের ষাটের দশকের শেষে। দ্বিতীয় পর্যায়ের আন্দোলন অনেক জটিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীনে নারীদের অবস্থার পরিবর্তন হয়। নারী কর্মী তৈরি হয়। দক্ষ, কর্মঠ শ্রমিকে পরিণত হন নারীরা। জননেতা মাও-সে তুং নারীকে অর্ধেক আকাশ বলেছিলেন। সেখানে নারী ও পুরুষের মাঝে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। দেশে দেশে মানুষের মুক্তির সংগ্রামে মেয়েদের ভূমিকা ছিল, বর্তমানেও আছে। আলজেরিয়ার স্বাধীনতার সংগ্রামে মেয়েরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী সংগ্রামে মেয়েদের সংগ্রামী ভূমিকা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হিরোশিমা নাগাসাকি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওয়ার্ল্ড মাদারস কনফারেন্স ফর পিস (World Mother’s Conference for Pease) গড়ে তুলেছিল।
নারীমুক্তি আন্দোলনেও দুটি ধারা। একটি হচ্ছে বুর্জোয়া ফেমিনিজম, আরেকটি বিশ্বে পুঁজিবাদের উত্থান। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে যে আন্দোলনের বীজ বপন করেছিল, তার মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছিল অসংখ্য সাধারণ নারী যারা কল-কারখানায়, খেতে-খামারে কাজ করে। যারা নিম্নবিত্তের প্রান্তিক মানবী, যারা আজও পায়নি জীবনধারণের ন্যূনতম সুযোগ। নানা পারিবারিক-সামাজিক নির্যাতনের শিকার নারীদের সংঘবদ্ধ করার আন্দোলন, তাদের দুর্বিষহ জীবনের গ্লানি থেকে মুক্তির আন্দোলন এখনো চলছে।
বর্তমানেও নারীর অবস্থান সর্বত্র এক নয়। শ্রেণিবৈষম্য নারীর আর্থসামাজিক অবস্থা চিহ্নিত করে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যাঁরা উঁচুতে বিশেষ করে মহানগর, নগরে আছেন তাঁরা কিছু সুবিধা পান। যেমন-রান্নার আধুনিক উপকরণ, পানির সুব্যবস্থা, সর্বক্ষণের কাজের লোক, আবার শহর নগরে যারা বস্তি অঞ্চলে থাকে, তাদের জীবনসংগ্রাম কিন্তু ভিন্ন। তেমনি গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র নারীদের জীবনসংগ্রাম নতুন এক বোধের জন্ম দেয়। আমাদের দেশের নারীরা পরিবারের জন্য প্রতিদিন চৌদ্দ থেকে পনেরো ঘণ্টা শ্রম দেয়। ভাত রাঁধা, জ্বালানি কাঠ জোগাড় করা, পানীয় জলের ব্যবস্থা করতেই সাত ঘণ্টা খরচ হয়ে যায়।
আমাদের দেশে আজও বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয় ‘নারীর পূর্ণতা মাতৃত্বে’। এ দাবি পূরণ করতে গিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পূর্ণ শ্রমিক থেকে ক্রমশ আংশিক শ্রমিকে পরিণত হচ্ছে মেয়েরা। আমাদের দেশে নারীশিক্ষার প্রসার, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ ইত্যাদি বিষয়ে উনিশ শতক থেকে সমাজের প্রগতিশীল অংশ কাজ করে গেছেন। সে কাজ আজও চলছে।
আমাদের দেশে বেগম রোকেয়া, ফজিলতুন্নেছা প্রমুখ নারী নেত্রীরা উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। আজকের নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রপথিক হিসেবে বহু নারী কাজ করে গেছেন যাঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় লেখা হয়নি। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে মেয়েদের গৌরবজনক ভূমিকা আছে। আজকে সাক্ষরতার হার বেড়েছে, নারীর ক্ষমতায়নে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। মেয়েরা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। আমাদের উনিশ শতকের মানবতাবাদের প্রথম শর্তই ছিল নারীমুক্তি। নারীর যাবতীয় সমস্যাকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা প্রয়োজন।’
মানব জীবনের মর্যাদাবোধকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়েই নারীমুক্তি আসবে। মানসিক দাসত্ব বড় কঠিন। এই দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। নারীদের নিজস্ব সদগুণরাশি ও মূল্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। জ্ঞান অর্জন, আত্মসংযম, শ্রমনিষ্ঠা, আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, সেবা, ক্ষমতায়ন তার সঙ্গে থাকবে দৃঢ়তা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। প্রতিবাদ হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসত্যের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। আইন আছে, প্রচার আছে, তারপরও পণপ্রথার শিকার হয় বহু বধূ পারিবারিক হিংসার বলি হয়, কিশোরী কন্যা, বৃদ্ধা মাসহ আরও নানা সম্পর্কের পানিতে আবদ্ধ নারী। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে মেয়েরা। একুশ শতকের পৃথিবী মেয়েদের আজও নিরাপত্তা দিতে পারেনি। মুক্ত দুনিয়া মুক্ত বাণিজ্যের জগতে মেয়েরা হয়ে যায় পণ্য। এর থেকে মুক্তি বড় জরুরি। এ মুক্তির জন্য প্রয়োজন আমাদের মানসিক পরিবর্তন। রাষ্ট্রীয় সামাজিক পারিবারিক কাঠামোর পরিবর্তন আর বহুযুগ লালিত সংস্কার আর অভ্যাসের দাসত্ব থেকে মুক্তি। তবেই হয়তো আসবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি।