আড্ডায় প্রাণের জোয়ার

মিটিং? নো।
আড্ডা? ইয়েস।
আড্ডার প্রতি এ এক আলাদা আকর্ষণ। বড় হয়েছি আড্ডায় আড্ডায়। এ সত্তরেও দিন-রাত মেতে থাকতে পারি। বিরক্ত বোধ করি না। বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর আড্ডায় পাঁচ/ছয় ঘণ্টা কীভাবে কেটে যায়, টেরই পাই না। মনে হয়, ঘণ্টাও হয়নি।
পেশাগত কারণে আগে নিউইয়র্কের অনুষ্ঠান-পর্ব, সভা-সমাবেশে যেতাম, এখন যাওয়া হয় না। আগে বাধ্যবাধকতা ছিল, এখন নেই। না–যাওয়ার আরেকটি কারণ, উৎসাহ পাই না। ঘণ্টাখানেকের অনুষ্ঠান শেষ করতে সময় লাগে চার-পাঁচ ঘণ্টা। বক্তৃতা শুনতে হয় ৩০/৪০ জনের। অসুস্থবোধ করি, কুলোতে পারি না শরীরে-মনে।
কিন্তু আড্ডায় সেই ক্লান্তি আসে না। বিরক্তিবোধ তো নয়–ই। আর শেখা যায় অনেক অনেক কিছু।
বাঙালিরা আড্ডাপ্রিয়। এই আড্ডা থেকে জন্ম নিয়েছে (বা এখনো নেয়) বহু কিছু।
মান্না দে’র গান ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ কার না–জানা! শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে, পাঠাগারে-রেস্তোরাঁয় আড্ডায় আড্ডায় গড়ে উঠে নতুন কিছু, এই যেমন নতুন চিন্তা, নতুন কর্ম, নতুন সংগঠন। শাণিত হয় চেতনা, কখনো কখনো উন্মেষ ঘটে নতুন ভাবনার। বাঙালির রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনের চর্চা ও বিকাশ ঘটে এই আড্ডাতেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনের কথা সবার জানা। ওখানকার আড্ডার দ্যুতি ছড়িয়ে আছে সবখানে।
আমি দেশে-প্রবাসে যেসব পত্রিকায় কাজ করেছি, আড্ডার মাঝেই কাজ সেরেছি। অবশ্য ব্যতিক্রম ছিল। পেয়েছিও, দেখেছিও। ওখানে মনে করা হতো, আড্ডা মানে অপচয়! কর্মঘণ্টা নষ্ট আর কাজের ব্যাঘাত। বলতাম, এটাতো সামরিক আঙিনা নয়, পত্রিকা। সৃষ্টি আর মননশীল কাজে এক-আধটু আড্ডা থাকবেই। কর্তৃপক্ষ দোহাই দিতেন অফিস শৃঙ্খলার। তাদের কথা, শৃঙ্খলা আগে। জানি না, হয়তোবা। তবে কখনো শৃঙ্খলা ভেঙে আড্ডা দিইনি—এটুকু বলতে পারি।
অবশ্য নির্মল আড্ডার সংজ্ঞা অনেকেই জানি না। জুয়া ও পানীয়ের আড্ডার সঙ্গে এই আড্ডার কোনোই মিল নেই।
মোগলাবাজার ও সিলেট শহরের কথা মনে পড়ে। কৈশোর ও যৌবনের। বাড়ি, স্কুল ও খেলার মাঠের বাইরেও আড্ডা হতো। সে সব আড্ডায় থাকত রাজনীতির কথা, সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা খবরাখবর আর বই আদান-প্রদান। মোগলাবাজারে কোনো পাঠাগার ছিল না। আমাদের নিজেদের সংগ্রহের বই একে অন্যকে দিতাম। কেউ শহর থেকে কোনো দৈনিক বা সাপ্তাহিক নিয়ে এলে সবাই ভাগ করে পড়ে নিতাম। আড্ডা হতো টিফিনের ফাঁকে, বেশির ভাগ সময় রেবতী রমণ হাইস্কুলের কাছে কেশরখালি সেতুর পাশের চা দোকানে। মালিকের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। পাশের গ্রাম রাঘবপুরে বাড়ি। খুবই সজ্জন ব্যক্তি। আমাদের খাতির-যত্ন করতেন, বাকিতে চা-বিস্কুট খাওয়ারও সুযোগ দিতেন।
অবশ্য মোগলাবাজার জীবনে স্থায়ীভাবে আড্ডার কোনো জায়গা ছিল না। কখনো চা-দোকানে, কখনো খোলা মাঠে বা কারও বাড়িতে, কখনো রেল স্টেশন বা কোনো সেতুর রেলিংয়ে বসে মেতে থাকতাম গল্পসল্পে। এর মাঝে একটি জায়গার কথা ভুলব না। মোগলাবাজার রেল স্টেশনের পাশেই ছিল মরহুম তফাজ্জুল আলীর ছোট্ট চায়ের দোকান। ভেতরে তিনি বসতেন, বাইরে রাখা ছিল একটি বেঞ্চ, সেখানে বসতাম আমরা। তিনি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। আমাদের উপস্থিতি পছন্দ করতেন। থানা-ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও ওখানে আসতেন। আড্ডা চলতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ওই আড্ডা বেশ কয়েকবছর স্থায়ী হয়।
সিলেট শহরে আমাদের আড্ডার প্রধান জায়গা ছিল মরহুম আমীনুর রশীদ চৌধুরীর যুগভেরী অফিস। প্রেসক্লাব তখনো হয়নি। সাহিত্য-সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িতদের কয়েকটি প্রিয় জায়গা ছিল। যুগভেরী প্রাচীনতম সাপ্তাহিক ও সিলেট অঞ্চলের প্রধান সংবাদপত্র। লেখক-সাংবাদিকদের সারাক্ষণ আনাগোনা, আড্ডা ছিল যুগভেরীতে। সত্তরের দশকে যুগভেরীর ‘শাপলার মেলা’ পাতাকে কেন্দ্র করে কিশোর-তরুণদের সাহিত্য চর্চা ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। ওই সময় প্রতি মাসে যুগভেরী কার্যালয়ে তরুণ কবি-সাহিত্যিকদের সমাবেশ হতো। সৌভাগ্য আমার, এই কর্মকাণ্ডের এক ছোট্ট অংশীদার ছিলাম আমি।
অন্য যেসব জায়গায় আড্ডা হতো, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদ ও পৌর পাঠাগার। জিন্দাবাজারে জেলা তথ্য কেন্দ্রেও সাংবাদিকেরা জড়ো হতেন। মুহম্মদ নুরুল হক ছিলেন মুসলিম সাহিত্য সংসদের প্রাণ পুরুষ। সংসদের পাঠাগার ছিল খুবই সমৃদ্ধ। সারা দেশ থেকে গুণীজনরা পাঠাগারে আসতেন গবেষণা কাজে সহায়তা নিতে। মুহম্মদ নুরুল হক ‘আল ইসলাহ’ নামে একটি সাময়িকীও বের করতেন।
সুরমা নদী তীরের সিলেট পৌর পাঠাগার ছিল আড্ডার আরেক আকর্ষণীয় স্থান। আমরা যারা সাংবাদিকতা পেশায় ছিলাম আমাদের জন্য বাড়তি আকর্ষণ ছিলেন আবদুল মালিক চৌধুরী। তিনি ইত্তেফাকের জেলা প্রতিনিধি ও একই সঙ্গে সিলেট পৌর পাঠাগারের প্রধান। আমরা তার ওখানে প্রেসক্লাবের সভাও করতাম। তখনো সুবিদবাজারে (মিরের ময়দান) প্রেসক্লাব হয়নি। প্রেসক্লাবের সভা আমীনুর রশীদ চৌধুরীর বাসভবন ‘জ্যোতি মঞ্জিল’ ও যুগভেরী কার্যালয়েও হতো। এ ছাড়া মিরের ময়দানে বেতার ভবন ছিল সংস্কৃতিসেবীদের সম্মিলনের আকর্ষণীয় স্থান।
জিন্দাবাজারে আকসার বক্সের ‘ছাপাঘর’ ছিল আড্ডার আরেকটি স্থান। বন্দর বাজারে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের (বাবুল দা) ‘নিরালা রেস্তোরাঁ’ ছিল সংস্কৃতিসেবীদের প্রিয় স্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মণ্ডিত এমসি কলেজের আঙিনায় আড্ডাপ্রিয় ব্যক্তিদের আনাগোনা লেগেই থাকত।
মনে পড়ে, আমি, মরহুম কবি মাহমুদ হক, ছড়াকার শামসুল করিম কয়েস, লন্ডনপ্রবাসী শিল্পী ও চিকিৎসক ফজল মাহমুদ, সাংবাদিক অজয় পাল, রেডিও বাংলাদেশের মাহফুজুর রহমান প্রমুখ সন্ধ্যায় সুরমা নদীতে নৌকা ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম আড্ডায়। নদীতে বেশ কিছুক্ষণ নৌকা ভ্রমণ করে ফিরে আসতাম তীরে। পরে প্রেসক্লাব হলো, নতুন নতুন পত্রিকা বেরোল, আড্ডার জায়গাও বিস্তৃত হলো।
নিউইয়র্কেও বাঙালিরা আড্ডা বেশ জমিয়ে ফেলেছেন। জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকা, অ্যাস্টোরিয়া, চার্চ অ্যাভিনিউ, পার্কচেস্টার, ওজন পার্কের রেস্তোরাঁগুলোতে উঁকি দিয়ে দেখতে পারেন জমজমাট আড্ডায় বসেছে প্রাণের মেলা।
দেশে-বিদেশে মানুষ আছে নানামুখী সমস্যায়। প্রচণ্ড মানসিক চাপ। অনিশ্চিত জীবন। অর্থনৈতিক সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা, কাজের নিরাপত্তা, বিরহের যাতনা, সন্তানের ভবিষ্যৎ, দুশ্চিন্তা জীবনকে জড়িয়ে রেখেছে। যান্ত্রিক সভ্যতায় নগর জীবন কারও কারও জন্য নিয়ে এসেছে অভিশাপ। এই জীবনে প্রাণের কোলাহল কোথায়? সামান্য সুখ-দুঃখ শেয়ার তো দূরে থাক, শোনার মানুষই বা কোথায়। অনেকের জীবন একা, নিঃসঙ্গ।
এই আমেরিকায় মনোচিকিৎসকদের কদর খুবই বেশি। কারণ, জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ নিয়মিত তাদের কাছে যান। তারা হতাশায় ভোগেন। মানসিক চাপে বিপর্যস্ত তাদের জীবন। মনোচিকিৎসকদের সাহায্য নেন। চিকিৎসকেরা ওষুধ দেন, কাউন্সেলিং করেন, প্রয়োজনীয় আরও ব্যবস্থা নেন।
যতটুকু জেনেছি, কাউন্সেলিংয়ে ভুক্তভোগীরা মূলত এক ঘণ্টা চিকিৎসকের সঙ্গে গল্প করে কাটান। এটাইবা কম কিসে। এখানে তো গল্প করার লোকও সহজে পাওয়া যায় না। সবাই ব্যস্ত। ছকে বাঁধা জীবন। কে কাকে সময় দেয়।
এদিকে যদি আমাদের বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের চিত্র চোখের সামনে মেলে ধরি, কী দেখতে পাই! সবাই সবার সঙ্গে কথা বলছে, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করছে। কোনো কথাই কারও একা থাকছে না। একের পাশে অন্যজন এসে দাঁড়াচ্ছে। টাকা দিয়ে না হোক, মুখে সান্ত্বনার বাণী শোনাচ্ছে, বিপদে জানাচ্ছে সহানুভূতি। কেউ নিঃসঙ্গ নয়, একাকিত্বের যন্ত্রণা কাউকে বয়ে বেড়াতে হয় না। গল্প করার জন্য পকেটের পয়সা খরচ করতে হয় না। দিতে হয় না ফি।
এই আড্ডায় যে মানসিক প্রশান্তি মিলে তা গাঁটের কড়ি খরচ করেও অন্যত্র মিলে না।
জয় হোক আড্ডার।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।