প্রবাসে আত্মপরিচয় সংকট

পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ত্যাগ ও কঠিনতম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছি। এ স্বাধীনতার সুফল আমরা যেমন দেশে বসে ভোগ করছি, তেমনি প্রবাসেও ভোগ করছি। এ সত্যটি আমরা ভুলে যাই, একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবেই আমাদের অধিকাংশ মানুষ প্রবাসে আসার ও নাগরিক সুবিধা ভোগের সুযোগ পেয়েছি। একটি পরাধীন দেশ থেকে এই সুযোগ কতখানি পেতাম, তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমরা প্রবাসে স্বাধীন বাংলাদেশের পরিচয় নিয়ে কুণ্ঠাবোধ করি, হীনমন্যতায় ভুগি। পাসপোর্ট বহন করছি বাংলাদেশের, সমস্যায় পড়লে বাংলাদেশের দূতাবাসের আশ্রয় নিচ্ছি, বাংলাদেশের কোটায় বিদেশে নাগরিকত্বের আবেদন করছি, অথচ পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নাম উচ্চারণে আমাদের যত লজ্জা!


নিজের আজন্মলালিত পরিবেশ, সংস্কৃতি, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও কর্মক্ষেত্র ছেড়ে বিদেশে আসা অবশ্যই অনেক কঠিন। এ যেন সাগরে নিমজ্জিত হওয়া, একেবারে নতুন করে জীবনসংগ্রাম শুরু করা। যেমন পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সংগ্রাম, তেমনি সামাজিক জীবনেও নিরাপত্তা ও স্বচ্ছন্দের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা। এ সংগ্রামে রয়েছে অনিশ্চয়তা, মেধা ও যোগ্যতার যথাযথ স্বীকৃতি না পাওয়ার কষ্ট। সর্বোপরি জাতি ও বর্ণগত বৈষম্যের স্বীকার হওয়া। আমরা তো এ নতুন সমাজে পরজীবী, আমাদের গ্রহণযোগ্যতা পেতে অবশ্যই বেগ পেতে হবে। এ রকম সংগ্রামে মানুষ স্বভাবতই কোন আশ্রয় খোঁজে, নিরাপত্তা সংকটে ভোগে। তখনই আমরা কোন একটি আত্মপরিচয়ের শরণাপন্ন হই, যা আমাদের এই বৈরী সমাজে সুরক্ষা দেবে। এ কারণেই প্রবাসে আমরা বাংলাদেশের বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে অন্য কোন পরীক্ষিত নিরাপদ পরিচয় ধারণ করি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পরিচয় হচ্ছে ধর্মীয় পরিচয়। আমরা নতুন কোন সমাজে এলে প্রথমেই সেখানে ধর্মীয় উপাসনালয় খুঁজি, ধর্মীয় সম্প্রদায় খুঁজি। কারণ ধর্ম হচ্ছে স্পর্শকাতর বিষয় যাতে প্রচুর উন্মাদনা ও শক্তি কাজ করে। ফলে বৈরী পরিবেশেও অন্য সম্প্রদায়ের কেউ ধর্মকে ঘাটাতে চায় না। সে কারণে নতুন সমাজে নিজের আর কোনো পরিচয় কাজ না করলেও ধর্মীয় পরিচয় ও ধর্মীয় গোষ্ঠী অনেকটা নিরাপত্তা দিয়ে থাকে।
এভাবেই প্রবাসে বাংলাদেশিরা গড়ে উঠে উপাসনালয়কে কেন্দ্র করে। হিন্দুদের মন্দির আর মুসলমানদের মসজিদ। মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় মিশে যায় ভারতীয়দের সঙ্গে। আমি বাংলাদেশি কিছু হিন্দু বন্ধুদের দেখেছি একেবারে ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দিতে, হিন্দি ভাষায় কথা বলতে, এমনকি ভারতের পতাকা বহন করতে। একইভাবে মসজিদে বাংলাদেশিরা একাত্ম হয় পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের সঙ্গে। অনেক বাঙালিকে দেখেছি উর্দুতে স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে, মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হতে, এমনকি বাংলাদেশকে ইসলাম ধ্বংসের অভিযোগে নিন্দা করতে। বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান বন্ধুদের কারও কারও মাঝে একই মনোভাব দেখেছি। সুতরাং প্রবাসে ধর্মীয় পরিচয়েই আমরা বসবাস করি। বাংলার কিছু চর্চা হলেও সেটা উপাসনালয়ভিত্তিক হয়ে থাকে। এতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাদেশ সম্পর্কে জানছে ওই উপাসনালয়ভিত্তিক চর্চা থেকে। ভবিষ্যতে এরা যখন সমাজে নেতৃত্ব দেবে, তখন তারা বাংলাদেশের খণ্ডিত অংশই তুলে ধরবে, কারণ বাকি অংশের কোন ধারণা তাদের কখনো দেওয়া হয় না।
পেশা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও আমরা জাতিগত পরিচয় লুকিয়ে রাখতে চাই। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রকৌশলী, চিকিৎসক কিংবা অধ্যাপক কোথাও দেশের পরিচয় দেন না, ভয় পাছে বৈষম্যের স্বীকার হন। বহু ভারতীয় খাবারের দোকানের মালিক ও কর্মচারী সবাই বাংলাদেশি। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, নামফলক বা প্রচারপত্রে কোথাও বাংলাদেশের উল্লেখ নেই। কারণ, তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশের নামে খদ্দের পাবেন না, ভারতীয় নামেই ব্যবসা চালাতে হবে। সুন্দর হিন্দি বলছেন, ভারতীয় খাবার পরিবেশন করছেন। মজার ব্যাপার, এই মালিকই কিছুক্ষণ পর মসজিদে গিয়ে ভারতকে কাফের রাষ্ট্র হিসেবে তিরস্কার করছেন। কী বৈপরীত্য!
আবার সম্পূর্ণ উল্টো চিত্রও দেখা যায়। ভাষা ও ধর্ম ভুলে কিছু বাঙালি প্রবাসের মূল স্রোতে মিশে যাওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় লিপ্ত। বাংলাদেশি সমাজকে এরা একেবারে এড়িয়ে চলেন। বাংলায় কখনো কথা বলেন না, কোন উপাসনালয়ে যান না। একটি নতুন ভাষা কিছুদিনের চেষ্টায় শেখা যায়, কিছুদিনের চর্চায় আয়ত্তে আনা যায়। কিন্তু ওই সংস্কৃতিতে বেড়ে না উঠলে কখনোই ওই সমাজে মিশে যাওয়া যায় না। ফলে এই নাক সিটকানো বাঙালিরা না পারেন বাংলাদেশিদের সঙ্গে চলতে, না পারেন বিদেশিদের সঙ্গে মিশতে।
তবে আমাদের জাতিগত পরিচয় কার্যকরী না হওয়া ও জনগণের কাছে আকর্ষণীয় না হওয়ার পেছনে অন্য কারণও রয়েছে। প্রবাসে বাংলাদেশিদের যত সংগঠন বা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তার চিত্র খুবই হতাশাজনক। নেতৃত্বের কোন্দল, ব্যক্তিস্বার্থ, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি কারণে আমরা কখনোই এক সঙ্গে থাকতে পারি না। কথায় বলে, একজন বাঙালি হলেই একটা সংগঠন গড়ে উঠে, আর দুজন হলেই সেটা ভেঙে যায়। ফলে একমাত্র যাদের নেতা হওয়ার শখ, তারাই বাংলাদেশি পরিচয়ে আস্ফালন করেন। আর যারা ঝামেলামুক্ত থাকেতে চান, তারা এমনিতেই এসব চর্চা থেকে দূরে থাকেন।
অবশ্যই ওপরের চিত্র সর্বজনীন নয়। প্রবাসে প্রচুর বাংলাদেশি রয়েছেন যারা গর্বভরে নিজের জাতিগত পরিচয় বয়ে বেড়াচ্ছেন। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন এবং বাংলাদেশের জন্য নীরবে অনেক কাজ করে যাচ্ছেন। এঁরা প্রচারবিমুখ বলে আমাদের তথাকথিত সংবাদমাধ্যমে কখনো আসেন না, কিন্তু এঁদের কারণেই বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। ধর্ম, বর্ণ, বা পেশার সঙ্গে জাতিগত পরিচয়ের কোন সংঘাত নেই। আর নিজের শেকড় ভুলে যেতে চাইলেও প্রকৃতি তা হতে দেবে না। অতএব বাংলাদেশের সন্তান হিসেবেই বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্ক, ফার্মিংডেল