যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনে সংস্কারের কত দূর?

অস্ত্র আইনের পরিবর্তন হচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্রে। ছবি: রয়টার্স
অস্ত্র আইনের পরিবর্তন হচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্রে। ছবি: রয়টার্স

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুই মসজিদে হামলার সাত দিন পার হয়েছে। এরই মধ্যে সব ধরনের সেমি-অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্র নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আহডার্ন।

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে গত শুক্রবারের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় সেমি-অটোমেটিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদ ও লিনউড মসজিদে বন্দুকধারীর ওই হামলায় ৫ বাংলাদেশিসহ ৫০ জন নিহত হন। আহত হন ৪২ জন। হামলার পর নিউজিল্যান্ডের অস্ত্র আইন সংশোধনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।

নিউজিল্যান্ডের এসব পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা তুলনা চলে আসে। গত কয়েক বছর বহুবার আগ্নেয়াস্ত্র–বিষয়ক হামলার মতো বহু ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গোলাগুলির ঘটনা তো প্রায়ই ঘটছে। এসব ঘটনায় নিহত ব্যক্তির সংখ্যাও কম নয়। স্কুলে গোলাগুলির ঘটনায় শুধু গত বছর ১১৩ জন নিহত হয়। গত বছর গড়ে প্রতি ৮ দিনে একটি করে হামলা হয়েছে কোনো না কোনো স্কুলে। এরপরও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের তেমন কোনো সংস্কার করতে দেখা যায়নি ট্রাম্প সরকারকে। এমনকি নতুন আইন করার আগ্রহ ও মনোযোগ কোনোটাই দেখা যায়নি। যদিও অনেক জরিপে নির্দিষ্ট ধরনের উচ্চক্ষমতার বন্দুক ও সামরিক রাইফেল নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ব্যাপক জনসমর্থন দেখা গেছে, তারপরও কোনো পদক্ষেপ আসেনি। ট্রাম্প সরকারের দৃশ্যমান সংস্কারের মধ্যে রয়েছে আধা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে মেশিনগানের মতো গুলি করা যাবে না এবং বন্দুক কেনার সময় ডেটাবেইস থেকে তথ্য দেখার কিছু সমন্বয় করা।

নিউজিল্যান্ড দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা, অবশ্যই একটি সংসদীয় গণতন্ত্রকেই নির্দেশ করে। এর ফলে নিশ্চিত হয়েছে যে সরকার, একটি দল বা রাজনৈতিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ একত্রকরণের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণাধীন। তবে এটাই যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র আইনের সংশোধন না করার উত্তর নয়। আরও কিছু বিষয় এসে যায়। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে বিষয়টি।

প্রতিবারই যখন কোথাও বড় কোনো গণ খুনের ঘটনা ঘটে, তার পরপরই এ দেশের চারদিকে আওয়াজ ওঠে, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সারা দেশের অধিকাংশ মানুষ একমত হলেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয় না, তার প্রধান কারণ এ দেশের ‘গান লবি’। ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ) আমেরিকার মানুষের অস্ত্র বহনের অধিকারের পক্ষে প্রধান লবিং গ্রুপ। কংগ্রেসের বিভিন্ন সদস্যকে প্রভাবিত করার জন্য এরা বছরে প্রায় ২৫ কোটি ডলার খরচ করে থাকে। তবে কেবল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের প্রভাবিত করাই মূল নয়, এই সংস্থার সঙ্গে জড়িত ৫০ লাখ সদস্যও অস্ত্র আইন পরিবর্তন না করার পেছনে অন্যতম কারণ। ২০১৬ সালের নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্রের পক্ষে, এমন প্রার্থীদের পক্ষে তারা সরাসরি খরচ করেছে ৫ কোটি ২০ লাখ ডলার।

এনআরএর বছরে বাজেট হলো প্রায় ২৫ কোটি ডলার। শিক্ষা কর্মসূচি, বন্দুক সুবিধা, সদস্যপদের অনুষ্ঠান, পৃষ্ঠপোষকতা, আইনি সমর্থন ও সম্পর্কিত প্রচেষ্টার জন্য বরাদ্দ হয় এই অর্থ।

তবে সদস্য সংখ্যার চেয়েও বড় বিষয় হলো এনআরএ ওয়াশিংটনে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে খ্যাতি গড়ে তুলেছে। তারা এতটাই শক্তিশালী যে বলা হয় রাজনীতিবিদ তৈরি করতেও পারে আবার পদত্যাগও করাতে পারে।

এনআরএর যুক্তি, অস্ত্র হাতে একজন বাজে লোককে ঠেকানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো একজন ভালো লোকের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া। ভয়ের কথা হলো এনআরএর এই প্রচারণায় আমেরিকার মানুষ ক্রমেই বিশ্বাস করা শুরু করেছে। নিজের ঘরে অস্ত্র থাকলে নিরাপদ থাকা যায়, এনআরএর এই যুক্তি সমর্থন করে দেশের অধিকাংশ মানুষ।

অন্যদিকে ২০১০ সালের পর প্রথমবারের মতো প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। আর সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রেখেছে রিপাবলিকান পার্টি। ২০১৮ সালে মধ্যবর্তী কংগ্রেসনাল নির্বাচনে সুইং স্টেটগুলোতে বিজয়ী হয়ে এ সাফল্য পায় ডেমোক্র্যাটরা। যেমন আটলান্টায় রিপাবলিকানকে পেছনে ফেলে একজন বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনকারী জিতেছেন। এর ফলে এখন ডেমোক্র্যাটরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনিক এবং ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করতে পারবে। প্রেসিডেন্টের আইন প্রণয়নসংক্রান্ত পরিকল্পনাতেও বাধা দিতে পারবে ডেমোক্র্যাটরা। দলের পক্ষে এই অগ্রগতি সত্ত্বেও হাউস ইলেকট্ররাল প্লেয়িং ফিল্ড এখনো রিপাবলিকানদের দিকে ঝুঁকে, যারা বন্দুক অধিকারের পক্ষে। ২০১৯ সালের মধ্যে কংগ্রেসে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ সমর্থকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। তাদের প্রথম পদক্ষেপ হলো এমন একটি বিল পাস করানো যার ফলে ব্যক্তিগত বন্দুক বেচার ক্ষেত্রে অতীত ইতিহাস পরীক্ষা করে নেওয়া হবে। এর আগে কেবল রেজিস্টার্ড বন্দুক ব্যবসায়ীরা এই ডেটাবেইস পরীক্ষা করতে পারতেন।

আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণবিষয়ক যে আইন প্রতিনিধি পরিষদে আশার আলো দেখাচ্ছে, সিনেটের কারণে তা আইনি বাধার মুখে পড়ছে। রাজ্যগুলো বড় বড় শহরের ভোট নির্ভর করে যেমন নিউইয়র্ক, ম্যাচুয়েটস অথবা ক্যালিফোর্নিয়া। আর গ্রামীণ ভোট নির্ভর করে দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যের ওপর। সিনেটে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করতে হলে ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ৬০ ভোট পেতে হবে। ২০১৩ সালে কানেকটিকাটে বন্দুকধারীর হামলায় ২০ শিশুসহ ২৬ জন নিহত হওয়ার পর অস্ত্র ক্রেতাদের তথ্য যাচাইসহ বিভিন্ন বাধ্যবাধকতার বিধান রেখে একটি যৌথ বিল পাসে ব্যর্থ হয় ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকানরা। বিলটি পাসের জন্য তখন প্রয়োজনীয় ৬০ ভোটও পাওয়া যায়নি। বিলটির পক্ষে ভোট পড়ে ৫৬টি।