গাছের ওপর বাড়ি

কথায় বলে, শখের তোলা আশি টাকা। শখ এমন এক জিনিস, যা যেকোনো বয়সী মানুষকে ছেলেমানুষী, মেয়েমানুষী করতে বাধ্য করে। মানুষের চিন্তাধারা যেমন একজন মানুষকে অন্যদের থেকে আলাদা করে, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন জনের ভিন্ন ভিন্ন শখও মানুষকে ভিন্নতা দান করে। পৃথিবীতে বিখ্যাত মানুষদের কিছু শখ ছিল, যার কিছু কিছু ছিল সত্যিই অদ্ভুত।
ইতিহাসে কুখ্যাত অ্যাডলফ হিটলার তাঁর সময়ে জার্মানির অন্যতম শ্রেষ্ঠ বেহালাবাদক ছিলেন। এক অদ্ভুত স্বভাব ছিল তাঁর। তাঁর নির্দেশিত প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর তিনি বেহালা বাজিয়ে সেই হত্যাকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেন। এই শখটিকে যদি নির্মম মনে হয়, তবে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির শখটি আপনাকে নিশ্চিত মুগ্ধ করবে। বিশ্বখ্যাত ‘মোনালিসা’ চিত্রকর্ম ও তার রহস্যময় হাসি দিয়ে বিখ্যাত হয়ে থাকা এই শিল্পী বাজার থেকে বিভিন্ন জাতের পাখি কিনে এনে তা না পুষে উড়িয়ে দিতেন। বাজার থেকে পাখি কিনে আড়িতে এনে তাদের মুক্ত করে দেওয়াটাই ছিল তাঁর শখ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শখ ছিল বিভিন্ন রকমের কলম সংগ্রহ করা। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সেই সব রকমারি কলম দিয়ে তিনি কোথাও একটি আঁচড়ও কাটতেন না। আর বিজ্ঞানী মার্কনির স্বভাবে ছিল অদ্ভুত এক ছেলেমানুষী। বছরের ৩৬৫ দিনই তিনি সমুদ্র উপকূলে ঘুড়ি ওড়াতেন। যদি কোনো কারণে একদিন তা বাদ পড়ত, সেদিন তিনি ঘুমাতে পারতেন না।
কথায় আছে গল্পের গরু গাছে চড়ে। প্রাচীনকালের মানুষের বসতি ছিল অরণ্যে। গাছের ডালপালা ছিল তাদের থাকার জায়গা। ফলই ছিল খাবার। আর ছিল স্বপ্ন। মানুষের স্বপ্নের কোনো পরিধি নেই। সাধ ও সাধ্য একসঙ্গে না হলে স্বপ্ন স্বপ্নেই মিলিয়ে যায়। কিন্তু অনেকে আছেন, যারা তাঁদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথে হাঁটেন, হাঁটতে পারেন। কিংবদন্তিতুল্য লেখক হ‌ুমায়ূন আহমেদ মেঘের ওপর বাড়ি রচনা করেছিলেন। মেঘের ওপর বাড়ির ঠিকানা কি? কোন কোন উপাদান দিয়ে রহস্যময় বাড়িটি নির্মিত? ঐন্দ্রজালিক লেখকের পক্ষেই কেবল সম্ভব ‘মেঘের ওপর বাড়ি’ নির্মাণ। অথচ আমার কল্পনা মেঘের ওপরে উঠতেই পারে না। ঘুড্ডির মতো গোত্তা খেয়ে শূন্যেই লন্ডভন্ড হয়ে যায়। মৃত্যু অলঙ্ঘনীয় জেনেও জীবনের প্রতি আমার আকর্ষণ তীব্র। আর চিলের চোখ তো ঘোরে বিলের ওপর।
আমারও সাধ জাগে তৈরি করি ‘গাছের ওপর বাড়ি’। কিন্তু ‘কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার’। আমাকে গাছ প্রেমিকই বলা যায়। আমি গাছকে ছাড়তে চাইলেও গাছ আমাকে ছাড়ে না। বাড়ির সামনে পেছনে দুটি গাছ আমার সহোদরের মতো। কাউকে বাড়ি চেনাতে হলে বলি, ‘দেখবেন, সামনে বড় গাছ; এটাই আমার বাড়ি।’ কানে কানে আরও একটা মজার কথা বলি, প্রকৃতির নিয়মেই সময়ের সঙ্গে মোটা হয় গাছ। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মোটা হই আমিও।
মেয়েবেলা কাটিয়েছি সবুজ বৃক্ষঘেরা এক গ্রামীণ বাড়িতে। আমার আমেরিকা-ফেরত বাবা মাঠে-ঘাটে সবখানে গাছ লাগাতেন। কোনো বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কাঁঠাল, আম বা অন্য ফল খেয়ে ভালো লাগলেই তার বীজ নিয়ে আসতেন। তখন গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে প্রচুর ফলফলাদির গাছ ছিল। আর সেসব গাছের ফলনও এত বেশি হতো যে, লোকে খেয়ে শেষ করতে পারত না। সংরক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল না। গরুকে খাওয়ানোর পরও গাছের নিচে বেশুমার ফল পঁচে থাকত।
বাবার গাছ লাগানোর সঙ্গী ছিলাম আমি। প্রতিটি গাছ লাগানোর পর বাবা আমাকে গাছের নাম রাখতে বলতেন। আমাদের বাপ-বেটির কাণ্ড দেখে লোকে হাসত। ‘ও মাঠের মাঝখানে গাছ লাগাইতেছ কেন’, লোকে বলত। আমাদের কোনো ভাবান্তর হতো না। গাছের সঙ্গে সেই থেকে আমার সখ্য। এই সখ্য থেকেই গাছের ওপর বসত গড়তে চাই আমি। নিজের মনের এই ইচ্ছার প্রকাশ কোথাও হতে দেখলে তাই ভালো লাগে।
চলুন দেখে আসি কোস্টারিকার ‘গাছবাড়ি’ গ্রাম। প্রশান্ত মহাসাগর ও ক্যারিবিয়ান সাগর ও জঙ্গলে ঘেরা সে দেশে বছরের ছয়-সাত মাসই বৃষ্টি হয়। আমেরিকার কলোরাডোর এক দম্পতি জঙ্গল ও প্রকৃতির ভালোবাসায় পড়ে ৬০০ একর জঙ্গল কিনে তৈরি করেছেন আস্ত এক ‘গাছবাড়ি গ্রাম’। সেখানে দড়ির মই, দড়ির সেতু, দড়ির ট্রলিতে চড়ে যাতায়াত করতে হয়। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয় কাঠের সিঁড়ি। রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষেরা নিজেদের জন্য ও রোমাঞ্চ বিলাসীদের জন্য পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি রয়েছে ট্রি হাউস, ট্রি রিসোর্ট, ট্রি হোটেল ইত্যাদি।
আমি ঘোরলাগা মনের চোখে দেখছি, আমার ঘরের সামনের বিরাট গাছ গরমকালে চারপাশের বাতাসকে আরামদায়ক ও বিশুদ্ধ রাখে। যখন আকাশের কান্নার জল প্রবলবেগে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে, তখন ওই গাছ নাকি আড়াই হাজার গ্যালন জল পান করে বন্যার কবল থেকে অত্র এলাকাকে রাখে শঙ্কামুক্ত। পাখিদের প্রেম-প্রীতি গানে, কাঠবিড়ালিদের খেলায়, পাড়া প্রতিবেশী সবার চোখ আটকে রাখে সে। সেই গাছেই আমি বাড়ি বানিয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছি। আর বেসুরো গলায় গান করছি, ‘আমারে ধইরাছে হায়রে তেঁতুল গাছের ভূত’। কেমন হবে তখন?
আমার প্রতিবেশী ন্যান্সি ফোন হাতে দৌড়ে আসবে হয়তো। ‘Don’t move’, বলেই হয়তো দমকলে ফোন দিতে উদ্‌গ্রীব হবে। রেনি হয়তো বলবে, ‘what happened Mrs Quader’। এদের হইচই শুনে স্টিফেন আসবে, আসবে বুড়ো রেনা। আর কেউ আসবে না। আমেরিকানরা যেকোনো ঘটনায় মৌমাছির মতো জড়ো হয় না। তাদের সময় ডলারে বিক্রি হয়।
আমাদের বাংলাদেশে কত অহেতুক কারণেও লোকজন জড়ো হয়ে যায়। ‘কী হয়েছে ভাই’, ‘বিষয়টা কী’, ইত্যাদি বলে বলে একজনের কণ্ঠ গিলে খেতে থাকে আরেকজনের গলাকে। আমাদের শেয়াল স্বভাব। একজন হুক্কাহুয়া আওয়াজ দিলেই, মিছিলে মিছিলে হুক্কাহুয়ার গগনবিদারী আওয়াজ শুরু হয়ে যায় হয়। এখন তো আবার ফেসবুকের যুগ। ডিমটা ভাজি করে নিজেই পোস্ট দিয়ে দেয়।
প্রচলিত আছে যে, বাঙালিরা কাউকে ওপরে উঠতে সাহায্য করে না। তবে কেউ উঠে গেলে ঠ্যাং ধরে নামানোর নাকি লোকের অভাব হয় না। তাই আমার গাছবাড়ির শখের কথা বাঙালিপাড়ায় চাউর হলে মুখরোচক রসালো আলোচনার উপাদান পেয়ে পরিচিত মহল গা ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠবে নিশ্চয়। বলবে ‘নির্ঘাত মেয়েটার মাথার নাট-বল্টু ঢিলা হয়েছে’। কতটা হয়েছে তা দেখতেই ছুটে আসবে হয়তো অনেকে। শুধু আমার সাহিত্যিক বন্ধুরা হয়তো বুঝবেন, ‘গাছবাড়ি আমার দিকশূন্যপুর/ মনের ঘরে বসত যাহার বাস্তবে বহু দূর।