বাফেলোর পথে

রাতেই ফোন করেছিল জাকেরীন। ভোরে আসবে তুলে নিতে। প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম একটু আগে আগে ঘুমানোর। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে কনফারেন্স কলে থাকায় পরিকল্পনায় ছেদ পড়ল। গাড়ি ছাড়বে ৭টায়, বাফেলো যাচ্ছি। বাফেলো নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের কানাডা সীমান্তবর্তী আপ স্টেট সিটি। নায়াগ্রার আমেরিকান পার্ট পড়েছে বাফেলোতে। ছোট বোন মেঘলা ওখানে থাকে। নতুন বাড়ি কিনেছে। ওদেরকে দেখতে হঠাৎই যাওয়ার পরিকল্পনা জাকেরীনের। দূর যাত্রায় বাস-ভ্রমণে পরিবারের কারওরই আগ্রহ নেই। অতএব দুই ভাই–ই যাত্রী।
মিতু খানিক পরপরই তাগাদা দিচ্ছিলেন জামাকাপড় গোছাতে। একদিনের জন্য যাচ্ছি। বাড়তি ১ জোড়া প্যান্ট-শার্টই যথেষ্ট। সেভাবেই গোছাচ্ছি। এমন সময় রণধীর স্যারের ফোন। স্যার থাকেন সী-সাইডে। ১৩ বছর আগে নিউইয়র্কে পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। বিসিএস সপ্তম ব্যাচের মেধাবী মানুষ। ছিলেন শিক্ষা ক্যাডারে। স্যারের ব্যাচের অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই এখন সচিব পদমর্যাদায়। আমেরিকা সরকারের ডাইভার্সিটি (ডিভি) প্রোগ্রামের মোক্ষম শিকার, ব্রেন ড্রেন। অবিভক্ত আসাম বাংলার শতাব্দীপ্রাচীন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিলেটের মুরারি চাঁদ কলেজে স্যার ছিলেন আমার জ্যেষ্ঠ সহকর্মী। স্যারের সঙ্গে কথোপকথন অন্যদিনের মতো দীর্ঘায়িত হলো না। বিছানায় যখন গেলাম, তখন মধ্যরাত পেরিয়েছে।
ঘুম ভাঙল অ্যালার্মের কর্কশ শব্দে। ভোর পৌনে ৫টা। আট থেকে সাড়ে আট ঘন্টার ভ্রমণ। পথের ক্লান্তি কমাতে গোসল করে নিলাম। জামাকাপড় পরতে পরতে ছোট ভাই চলে এসেছে। ব্রঙ্কস থেকে জ্যামাইকায় উবারে আসতে সময় লেগেছে ২৫/৩০ মিনিট। নামাজ শেষে নাশতার প্রস্তুতির মধ্যেই মিতু হাজির। সারা দিনের কর্মক্লান্তি নিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন, তাই জাগাতে চাইনি গিন্নিকে। নাশতা সেরে উবারে উঠলাম। গন্তব্য পোর্ট অথোরিটি বাস টার্মিনাল। কৃষ্ণাঙ্গ ড্রাইভার জানালেন মিনিট ৩০ লাগবে।
পোর্ট অথোরিটি বাস টার্মিনাল পড়েছে ম্যানহাটন বরোতে। যেতে ইস্ট রিভারের নিচের মানব-সৃষ্ট সুড়ঙ্গ পথে পড়ে। টানেল পেরোতে পেরোতে ভাবছিলাম, প্রকৃতি ও প্রতিকূলতার সঙ্গে মানুষের প্রতিযোগিতার এ আরেক বিজয়কেতন। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে যত সীমাবদ্ধতা দিয়ে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন, মানুষ একের পর এক তা অতিক্রম করেছে! প্রকৃতি যদি তার সমুদ্র, পাহাড়, মরুভূমি, নদী দিয়ে মানুষকে আটকে দিতে চেয়েছে, মানুষ তা অবলীলায় অতিক্রান্ত করেছে উড়াল দিয়ে অথবা পাহাড়, নদী, সমুদ্রের নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে! কী বিস্ময়কর! এ কারণেই বুঝি সৃষ্টি কূলের শ্রেষ্ঠ সে।
পোর্ট অথোরিটি টার্মিনালে পৌঁছে দেখি এলাহি কারবার। অনেক বৃহদাকার ও পরিকল্পিত পরিবহন ব্যবস্থার ছাপ সর্বত্র। নিউইয়র্ক থেকে অন্য নগর ও অঙ্গরাজ্যের যানবাহনের জন্য এই সুবিশাল টার্মিনাল। আমাদের টিকিট ‘গ্রে হাউন্ড’ পরিবহনের। এক যাত্রী জানালেন, দুটি পাবলিক ইন্টার সিটি ও ইন্টার স্টেট ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি নিউইয়র্ককে আশপাশের অঙ্গরাজ্য ও নগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, এটি তার একটি। অন্যটি পিটারপ্যান। টার্মিনাল কাউন্টারের নারী কর্মকর্তার কাছ থেকে আমাদের গাড়িতে চড়ার পথনির্দেশ পাওয়া গেল। নির্দেশিত পথে ২২ নম্বর গেটে পৌঁছে দেখি, জনা বিশেক যাত্রী সারিতে দাঁড়ানো। গেটের ওপরে লেখা বিভিন্ন গন্তব্য পড়ে বুঝলাম, টরন্টো (কানাডা) যাওয়ার যাত্রীরাও এই রুটই ব্যবহার করেন।
গাড়ি ছাড়ল ঠিক সকাল সাতটায়, যাকে বলে ‘জাস্ট টাইম’। নিউইয়র্কে আমার এই প্রথম দূরপাল্লার বাস-ভ্রমণ। আমাদের ও আশপাশের কয়েকটি বাসের বাইরের ধূলিধূসরিত অবস্থা দেখে মনটা খারাপ হলো। যাওয়ার কথা ছিল বিমানে, কিন্তু আমেরিকার পরিবেশ, প্রকৃতি, পর্যটন ভাবনায় বাস ভ্রমণ আমিই বেছে নিয়েছি। ভাড়াও কম না, যাত্রীপ্রতি ১৫০ ডলার, রাউন্ড ট্রিপ। গাড়ির ভেতরে ঢুকেও প্রাপ্তির পাল্লাকে ভারী মনে হলো না। এখানে যা দেখি তার সঙ্গে দেশের তুলনা করি। বাতিকটা চেপেছে এ দেশে ঢোকার পরপরই। উন্নত বিশ্বের সবকিছুই আহামরি হয় না। আমাদের গ্রিনলাইন, সোহাগের আসন ও যাত্রী ব্যবস্থাপনা অনেক ভালো। এখানকার গাড়িতে বাড়তি বলতে বিমানের মতো টয়লেট ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস রিচার্জের সুবিধা। দেশের দূরপাল্লার বেসরকারি পরিবহনগুলোর মতো সার্বক্ষণিক অ্যাটেন্ড্যান্ট, ফ্রি ওয়াটার বোতল, টিভি ইত্যাদি নেই। ঢাকা-সিলেট-ঢাকা পথের যাত্রীদের জন্য তো ফ্রি লাঞ্চ/ডিনারে আপ্যায়ন রীতিও চালু হয়েছে সম্প্রতি। আর অনলাইন টিকেটিং ও ওয়াইফাই সুবিধা দেশের প্রায় গাড়িতেও এখন সুলভ। তবে চালককে মনস্তাত্ত্বিক চাপে রাখতে গাড়ির ভেতরে ও বাইরে ‘হাউ ইজ মাই ড্রাইভিং’ কিংবা ‘টেল আস অ্যাবাউট ইওর ড্রাইভার’ বলে যে অভিনব ‘টেক্সট অর কল’ কার্যক্রমটি এ দেশে দেখছি, তা সত্যিই ইউনিক। আমাদের দেশে মালিকপক্ষ এ ধরনের প্রচারণা কার্যক্রম চালু করলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে আসত।
গাড়ির মাঝামাঝি বসেছি আমরা। আসন নম্বর ২৫ ও ২৬। অনলাইনে টিকিট কাটা হয়েছিল দিন তিনেক আগেই। টিকিটে আসন নম্বর উল্লেখ থাকে না বলে এখানে ‘আগে এলে আগে’ পছন্দসই আসনে বসার রীতি প্রচলিত। টিকিটে আসন নম্বর না থাকার সুবিধা কী বুঝতে পারিনি, তবে অসুবিধার দিকটা বেশ বুঝেছি। সপ্তাহ, মাস, সময়, বার ইত্যাদি ভেদে এখানে বাস, ট্রেন, স্টিমার, বিমানের ভাড়াও উঠানামা করে! এদিক থেকে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে অনেক স্থিতিশীল, যাত্রীবান্ধব ও সহনীয়।
আমেরিকার মহাসড়কগুলো যে কী পরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিউইয়র্ক-বাফেলো যাত্রাপথের প্রায় পুরোটাই ন্যূনতম চার থেকে আট লেনে সুবিন্যস্ত। সড়কের পাশে যথাস্থানে দিকনির্দেশনা সংবলিত সাইনবোর্ড থাকায় কেবল চালকই নন, আগ্রহী যাত্রীও পথনির্দেশ পান, পথনির্দেশনা উপভোগ করেন। পথের দু পাশের শত সহস্র একর অনাবাদি, অনাবাসী সমতল ভূমি, বৃক্ষরাজি, পার্বত্য উপত্যকার অপার সৌন্দর্য আর বনভূমি অতিক্রম করার সময় ভাবছিলাম, না জানি আরও কত শতাব্দী লাগবে এগুলো ব্যস্ত জনপদে রূপান্তরিত হতে! সৃষ্টিকর্তা কী ‘আবাদ করলে ফলতো সোনা’–এর মতো এমন সম্ভাবনার জমিন পতিত রেখেই মহাপ্রলয় ঘটাবেন? জানি না, জানি না, জানি না।
১২টায় পৌঁছলাম সিরাকিউজে। ১২টা মানে ১২টাই। ২০ মিনিটের যাত্রাবিরতি দিল। ইতিপূর্বে আরও এক জায়গায় নির্ধারিত বিরতি ছিল। জায়গার নামটা সম্ভবত এক্সন। এ জাতীয় দূরপাল্লার যাত্রাপথে আমাদের দেশের হাইওয়ে রেস্টুরেন্টগুলোর পরিসর ও জাঁকজমকের সঙ্গে নিউইয়র্ক-বাফেলো হাইওয়ের পরিবহন ও আনুষঙ্গিক সুবিধা বিবেচনা করলে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখতেই হয়। শিক্ষা বিষয়ক সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে দেশব্যাপী পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছি, দেশের সড়ক ও জনপথ ব্যবস্থায় অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে।
সিরাকিউজে গাড়ি প্রায় খালি হয়ে গেল। ড্রাইভারও বদল হলো। তবে নতুন যাত্রী উঠলেন ১৪/১৫ জন। যাত্রীদের মধ্যে শিশু, নারী ও পুরুষ মিলিয়ে ১০ জন শ্বেতাঙ্গের একটি ব্যতিক্রমী গ্রুপ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বিভিন্ন বয়সী পুরুষের মাথায় কাউবয়দের মতো কালো রঙের হ্যাট, ফুলস্লিভ রয়েল-ব্লু শার্টের ওপর কালো ওয়েস্ট কোট, কালো প্যান্ট ও কালো সু। কিশোর ও মধ্যবয়সী সবার মুখেই অযত্নে (অথবা সযত্নে) গজানো দাঁড়ি। মাথার চুল আমাদের সুফিসাধক ও বাউলদের মতো ঘাড় পর্যন্ত ছাঁটা। মহিলা, শিশু ও তরুণীদের মাথায় কালো স্কার্ফ ও কালো আলখাল্লা। মনে হলো, এঁরা কোনো বিশেষ ধর্মীয় নৃগোষ্ঠী অথবা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধি। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রের কৌতূহল থেকে এঁদের পরিচয় উদ্ধার করতে না পারার আফসোস অনেক দিন তাড়িয়ে বেড়াবে আমাকে।
আপ স্টেট রচেস্টারে পৌঁছলাম ঠিক ২টায়। ৫ মিনিটের বিরতির পর আবারও যাত্রা শুরু। চালক ঘোষণা করলেন, পরবর্তী স্টেশনই বাফেলো। গন্তব্যে পৌঁছার সম্ভাব্য সময় বললেন ৩টা ৩০ মিনিট, অপরাহ্ণ। যাত্রাপথে একটা বিষয় খেয়াল করলাম। গাড়ি কখনোই স্পিডোমিটারের কাঁটায় তুফান তোলেনি। বরং একই গতিবেগ এবং বেঁধে দেওয়া সময় মেনে চলেছে। নির্ধারিত সব স্টেশনে সুনির্দিষ্ট সময়ের যাত্রাবিরতি ও পুনঃযাত্রা করেছে নিয়মমাফিক। বোধকরি চলার গতি ও যাত্রা বিরতির এই পরিকল্পিত পদ্ধতিই দীর্ঘপথে যাত্রীদের কাহিল ও ক্লান্ত করতে পারে না। আমাদের দেশেও এ ধরনের ব্যবস্থা চালু করা গেলে পথের ক্লান্তিই কেবল নয়, বরং অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা রোধ ও হ্রাস করাও সম্ভব হতো। #

লেখক: বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার), শিক্ষা মন্ত্রণালয়