হাতঘড়ি

অনেকটা অন্ধকারাচ্ছন্ন পুরো নিউইয়র্ক। আকাশে মেঘের আনাগোনা। সকালে আবহাওয়া একটু ভালো ছিল। কিন্তু বিকেলের এই মুহূর্তে একটু অন্যরকম আবহ। আজকাল আবহাওয়ার হিসেব–নিকেশ বুঝি যায় না। গুগলে সার্চ করে আবহাওয়া দেখে বের হয়েছিল রাহাত। কিন্তু বিকেলে এই মেঘের ঘনঘটা দেখে তার আজ মনটা খুব খারাপ। মোবাইল বের করে দেখছে কয়টা বাজে। দেখল বিকেল ৪ টা বেজে ৩০ মিনিট।
নিউইয়র্কের ব্যস্ত নগরের একটি সড়কের নাম ব্রাকনার বুলভার্ড। যেখানে তার বসবাস । বাসা থেকে ১০ মিনিট পায়ে হেঁটে ক্যাসল হিল স্টেশন থেকে সে চলে যাবে ম্যানহাটন টাইমস স্কয়ারে। প্রতিদিন তাকে বিশ্বের অন্যতম এই বাণিজ্যিক শহরের জন কোলাহল পূর্ণ এলাকায় একটি কফি শপে কাজ করতে হয়। ৬ টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত ডিউটি। কিন্তু ক্যাসল হিল দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় প্রায় প্রতিদিন বিশাল হাতঘড়ি দোকানের শোকেসের দিকে সে তাকিয়ে হাতঘড়ি দেখে। কোনটা কত দামের সেটা হিসাব করে। কেননা সপ্তাহ শেষের বেতনের পর পরিবারসহ আনুষঙ্গিক খরচ জোটাতেই সব শেষ হয়ে যায়। কিন্তু সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো হাতঘড়ি না দেখলে তার মন ভরে না। হাতঘড়ি ব্যবহারের চেয়ে প্রতিদিন হাতঘড়ি দেখাও তার রুটিনের একটি অংশ হয়ে গেছে।
একদিন ঘটল একটি বিচিত্র ঘটনা। সে কাজে যাওয়ার সময় প্রতিদিনের মতো হাতঘড়ি দেখছে। হঠাৎ তার পিঠে হাত দিল এক ইংরেজ ভদ্রলোক।
ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি তাকে বলল, হেই আমি ডেভিড। আমি তোমাকে প্রায়ই দেখি তুমি ঘড়ি দেখ। তুমি কি কর?
-আমি কফি শপে জব করি।
-আমি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তোমার প্রতিদিনের এই অভ্যাস আমার খুব ভালো লাগে। তুমি প্রতিদিন প্রায়ই ৪ থেকে ৫ মিনিট ঘড়ি দেখ। সময়ের প্রতি তোমার খুব আগ্রহ?
-হ্যাঁ, স্যার। আমি চেষ্টা করি সবকিছু সময়মতো করতে। পড়াশোনা, কাজ।
-আমার কোনো ছেলে সন্তান নেই। একটি মেয়ে ছিল সে বড় হয়ে অন্য এক ছেলের সঙ্গে চলে গেছে। স্ত্রী ৫ বছর হয় মারা গেছেন। তুমি আমার সন্তানের মতো তোমাকে যদি আমি একটি হাতঘড়ি উপহার দিই তুমি তা গ্রহণ করবে?
-না, স্যার। আপনি কেন দেবেন।
-আচ্ছা তোমার যে দিন অফ থাকে সেই দিন বিকেলে দু-এক ঘণ্টা শুধু ওই পার্কে আমার সঙ্গে গল্প করলেই চলবে। আসলে এই বৃদ্ধ বয়সে আমি খুব একা অবসরে; যদিও আমি লেখালেখি করি। মাঝেমধ্যে বন্ধুরা আসে বাসায়। অনেকটা সময় একা কাটে।
-রাহাত বৃদ্ধ লোকটার কথায় রাজি না হয়ে পারল না। কেননা একজন মানুষ খুব একা। আর তার সঙ্গে গল্প করলে অনেক কিছু জানা যাবে, শেখা যাবে।
পরদিন এই দোকানে ঠিক এই সময় আসতে বলে লোকটি চলে গেল ।
পরদিন ঘড়ির দোকানের সামনে এসে রাহাত অপেক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে সড়কে বিক্রীরত ফুলের দোকানি বলে, ‘ভাই আজকে অনেক লোক দেখছি ওই পার্কের বাসায় আসছে। অনেকেই ফুল নিয়ে যাচ্ছে আমার কাছ থেকে। মনে হয় কিছু একটি হইছে।’
রাহাত দৌড়ে গিয়ে বাসায় গিয়ে দেখল মি. ডেভিডের মরদেহ বের করা হচ্ছে। আর কফিনে ফুলের তোড়ায় ভর্তি।
রাহাত ভাবছে উনি বোধ হয় অনেক বড় লেখক ও নামী লোক ছিলেন। তাই এত সম্মান দেওয়া হচ্ছে। রাহাত একটু ভেঙে পড়ল। হায়! আমাকে হাতঘড়ি না দিলে কী হবে। আমি যে একজন বয়োবৃদ্ধের কাছ থেকে অনেক জ্ঞান আহরণ থেকে বঞ্চিত হলাম।