প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হাতের মুঠোয় রিপাবলিকান পার্টি

ডোনাল্ড ট্রাম
ডোনাল্ড ট্রাম

২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিনও রিপাবলিকান দলের মধ্যে ছিল সুস্পষ্ট বিভাজন। এর কেন্দ্রে ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হলেও তাঁর পেছনে রিপাবলিকান দল এককাট্টা তো ছিলই না, বরং তাঁকে নিয়েই বিভাজন ছিল দলে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। রিপাবলিকান পার্টিতে নিজের প্রভাব বলয় তৈরি করেছেন ট্রাম্প। এখন দলটিতে তিনিই সর্বেসর্বা হয়ে উঠছেন।

অথচ গত নির্বাচনের আগেও অবস্থা ছিল ঠিক এর বিপরীত। ওহাইওর মতো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী মাঠ শেষ সময়ে এসেও তিনি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেননি। ওহাইও অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান দলের চেয়ারম্যান ট্রাম্প সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করা গভর্নর জন কাসিচের পক্ষাবলম্বন করে ট্রাম্পকে তিরস্কার করেছিলেন। নিউ হ্যাম্পশায়ারের রিপাবলিকান দলের চেয়ারম্যান এক ব্যক্তিগত আলাপে নিজ দলের প্রার্থী নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন। আর ফ্লোরিডার রিপাবলিকান দল স্থানীয় সমর্থক ও দাতাদের ওপর ব্যাপক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে শুধু এ কারণে, তারা কেন সিনেটর মার্কো রুবিও ও গভর্নর জেব বুশকে রেখে ট্রাম্পকে সমর্থন দিচ্ছে। এই ক্ষোভের পেছনে বড় কারণ হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প দলীয় প্রাথমিক নির্বাচনের সময় এই দুই নেতার সঙ্গে অপমানজনক আচরণ করেছিলেন। কিন্তু এখন এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বগুলো যেন একপক্ষীয় সমাধান হয়ে গেছে। বর্তমানে আমেরিকার প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের ভালো নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এই নিয়ন্ত্রণকে আরও দৃঢ় করতেই তাঁরা বর্তমানে সচেষ্ট আছেন। এখন যেকোনো বিবেচনাতেই রিপাবলিকান দল ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল হয়ে উঠেছে।

পুনর্নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতির প্রথম পর্বেই ট্রাম্প ছোট কিন্তু আগ্রাসী যে প্রচার কার্যক্রম শুরু করেছেন, তাতে প্রায় সব অঙ্গরাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্বে এমন নেতাদের বসানো সম্ভব হয়েছে যে, তাঁরা দলের রক্ষণশীল অংশটিকে ট্রাম্পের সমালোচনা থেকে বিরত রাখতে পারছেন। এই শীর্ষ নেতৃত্বের মূল কাজই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যগুলোয় ট্রাম্পের ভিতকে শক্ত করা। একই সঙ্গে ট্রাম্পের পক্ষে ও ট্রাম্প-সমালোচকদের বিপক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখাটাও তাঁদের কাজ। অঙ্গরাজ্যগুলোয় দলের একান্ত সভা, দলের নির্বাহী কমিটির সভায় উপদেষ্টাদের পাঠানোর পাশাপাশি তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে নৈশভোজের আয়োজন করা হচ্ছে। আর এসবই করা হচ্ছে আগামী বছর নর্থ ক্যারোলাইনার শার্লটে অনুষ্ঠেয় রিপাবলিকান কনভেনশনে ট্রাম্পের প্রতি অনুগত প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে।
গত নির্বাচনে ফ্লোরিডায় ট্রাম্পের প্রচার শিবিরের কো-চেয়ারম্যান জো গ্রুটার্স এখন অঙ্গরাজ্যটির রিপাবলিকান দলের শীর্ষ নেতা। ফলে এই অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান দলটি নিশ্চিতভাবে আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পের বড় অস্ত্র হয়ে উঠছে বলে মনে করেন অনেকে। জো গ্রুটার্স নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘ট্রাম্প ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আগামী সম্মেলনে ফ্লোরিডার প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত আমার অন্তত ১০ বার আলাপ হয়েছে। এখানকার দল প্রেসিডেন্টকে পছন্দ করে। কেউ তাঁর বিরুদ্ধে (প্রাথমিক নির্বাচনে) লড়ার চিন্তা করলে, এখানে তিনি ভূমিধস পরাজয়ের শিকার হবেন।’
সাধারণত অঙ্গরাজ্য ও স্থানীয় রাজনীতি মূলত জাতীয় রাজনীতিকে অনুসরণ করে। যদিও স্থানীয় রাজনীতিই আবার জাতীয় রাজনীতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ফলে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে গেলে এই স্থানীয় রাজনীতিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়। কারণ বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের দলীয় চেয়ারম্যান ও উপপ্রধানদের মাধ্যমেই নির্বাচনী প্রচার থেকে শুরু করে নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের জন্য তহবিল সংগ্রহের কাজটি করতে হয়। এই স্থানীয় রাজনীতিকেরাই মানুষের দ্বারে দ্বারে যান। আবার ফ্লোরিডার মতো কিছু অঙ্গরাজ্য রয়েছে, যেখানে এই রাজনীতিকেরাই দলীয় সম্মেলনের জন্য অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি মনোনীত করেন।
২০১৬ সালেও ট্রাম্প রিপাবলিকান দলে একজন বহিরাগত ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যে যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন, তাতে প্রাথমিক নির্বাচন বা মূল নির্বাচনে দলের ভেতর থেকে তাঁর বিরুদ্ধতার আশঙ্কা ক্রমেই কমে আসছে। এর মাধ্যমে শুধু আগামী নির্বাচনের জন্যই যে ট্রাম্প সুরক্ষা বলয় তৈরি করছেন, তা নয়। এর মাধ্যমে প্রশাসনিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি দলের মধ্য থেকে সম্মতি আদায়েও এগিয়ে যাচ্ছেন। ফলে সময়ের সঙ্গে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের মতো বিতর্কিত বিষয়গুলোতে দলের ভেতর থেকে বিরোধিতার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা কমছে তাঁর।
আগামী বছরে অনুষ্ঠেয় শার্লট সম্মেলনের দিকেই এখন ট্রাম্পের উপদেষ্টাদের মূল নজর। ট্রাম্পের দুই প্রচার উপদেষ্টা বিল স্টিপিন ও জাস্টিন ক্লার্ক অনেকটা নীরবে কিন্তু সুপরিকল্পিতভাবে রিপাবলিকান দলের স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। এমনকি ম্যাসাচুসেটসের মতো ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত অঙ্গরাজ্যগুলোতেও তাঁরা ট্রাম্পের মিত্র তৈরি করতে পেরেছেন। কিছুদিন আগে ডেনভারে ট্রাম্পের প্রতি আনুগত্যের এক দারুণ প্রদর্শন হলো। ডেনভারে রিপাবলিকান রাজনীতিকেরা সমবেত হয়েছিলেন কলোরাডো রিপাবলিকান দলের নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে। এক চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী নেতা সেখানে আসেন ট্রাম্পের ছবি বুকে করে। সঙ্গে ছিল একটি লাল পতাকা যেখানে লেখা ছিল, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’। শুধু তিনিই নন, অনেক কর্মীকেই দেখা গেছে ট্রাম্পের ছবিসংবলিত কোটপিন পরে সম্মেলনস্থলে আসতে। কিন্তু ট্রাম্প তাঁর উপদেষ্টাদের পরামর্শ অনুযায়ী, ওই বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। এর ফলও পান তিনি। চরম রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত কেন বাক কলোরাডোর রিপাবলিকান চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্পের প্রতিই আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন।
এক সময় জন কাসিচের কট্টর সমর্থক ছিলেন এবং বর্তমানে জর্জিয়া রিপাবলিকান দলের চেয়ারম্যান জন ওয়াটসনও ট্রাম্পে মুগ্ধ এখন। নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, ‘এখানে প্রেসিডেন্টকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে এমন কেউ নেই। দলে তাঁর একচেটিয়া কর্তৃত্ব রয়েছে বলা যায়। সক্রিয় রাজনীতিক থেকে শুরু করে প্রতিনিধি সবাই তাঁর পক্ষে।’
নানা কৌশল কাজে লাগিয়ে ট্রাম্প ও তাঁর প্রচার পরামর্শকেরা বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে তাঁর ভিতকে আরও মজবুত করছেন। মিশিগানে এরই মধ্যে তাঁরা সফল হয়েছেন। ম্যাসাচুসেটসে গত জানুয়ারি থেকে ট্রাম্পের প্রতি বৈরী গভর্নরকে হুমকিতে ফেলতে পাল্টা আরেকজনকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। সেখানে ম্যাসাচুসেটসের গভর্নরের বিরুদ্ধে জিম লিয়নসকে দাঁড় করানো হচ্ছে। ম্যারিল্যান্ডে ট্রাম্প সমালোচক হিসেবে পরিচিত গভর্নর ল্যারি হোগানকে ঠেকাতে ট্রাম্পের প্রচার উপদেষ্টারা মনোযোগ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে ট্রাম্পের প্রচার উপদেষ্টা জাস্টিন ক্লার্ক নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘যেকোনো ভালো প্রচার কার্যক্রমের মতোই আমরা চাই রিপাবলিকান ভোটারদের ইচ্ছাই যেন অঙ্গরাজ্যগুলোর প্রতিনিধি ও চেয়ারম্যানদের কাজে প্রকাশ পায়। আর রিপাবলিকান ভোটারদের নিরঙ্কুশ সমর্থন রয়েছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি। আমরা এমন একটি পথ তৈরি করতে চাই, যা আমাদের শার্লটের কয়েক দিনব্যাপী সম্মেলনে প্রেসিডেন্টের বিস্তারিত আলোচনার পথকে প্রশস্ত করবে। সেখানে তিনি যেন তাঁর অর্জনের কথা ৩০ কোটি আমেরিকানের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটি ভিত পান, সেই চেষ্টাই করা হচ্ছে।’