আদরের কুকুর বনাম নেড়ি কুত্তা

হাতে চালের গুঁড়া, খেজুরের গুড় আর নারকেল-কোরা। অবশ্যই সেগুলি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সিল-ছাপ মারা প্যাকেটবন্দী। প্যাকেটগুলো মুক্ত নয়, পলিথিন ব্যাগের ভেতরে। এত এত বাহ্যিক আবরণে আবৃত, তারপরেও হাতের ব্যাগ দুটি এলিভেটর ফ্লোরে রাখতে কিছুতেই মন সায় দিচ্ছে না। কার্পেটের একাংশ সদ্য ভেজানো হয়েছে। ঠিক ঢেলে পড়েনি, ওপর থেকে এক জায়গায় ছাড়া হয়েছে, সেখান থেকে একটা মোটা রেখা হয়ে এঁকে বেঁকে আশপাশ ভিজিয়ে দিচ্ছে। আয়না না দেখেও বুঝতে পারছি কপালে ভাঁজ পড়েছে, ভ্রু কুঁচকে গেছে, অক্ষি গোলকে ক্রোধের আগুন জ্বলছে। এর আগেও এই অভিজ্ঞতা গত উনত্রিশ বছর ধরেই ভিন্ন ভিন্ন নানা আবাসিক ভবনের এলিভেটরে হয়েছে। সব সময় কুঞ্চিত হয়েছে ভ্রু। বিরক্তির কালি সারা মুখ লেপেছে। নিজের মনেই গজর গজর করে ব্যাপারটির অপনোদন ঘটাই। কিন্তু আজ রাগটা মনে স্থায়ী আসন পাতছে। প্রথমত ছুটির দিনেও সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে সারাটা দিন নানা প্রয়োজনে সারা কুইন্স-ম্যানহাটন চষে বেরিয়ে সাঁঝবেলায় জ্যাকসন হাইট্‌স এসে ওপরে উঠে নানান দোকান, সুপার মার্কেট ঘুরে স্ত্রীর ফরমায়েশ মতো শাক-সবজির সঙ্গে পিঠা বানানোর উপকরণাদি কিনে দীর্ঘ পথ দুহাত ব্যথা করে টেনে এনে এলিভেটরে এই বিপত্তি! হাতটা একটু খালি করার ইচ্ছা ছিল, তা তো হলোই না। সঙ্গে ঘেন্নায় গা গুলাতে লাগল। দরজাসই কোনোরকম দাঁড়িয়ে পাঁচতলায় থামা মাত্র ঝটিতি বেরিয়ে একপ্রকার দৌড়ে বাসার দরজায়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ব্যাগগুলি রেখেই বাথরুমে।
চোখে মুখে জল দিয়ে ধাতস্থ হয়ে বসে ভাবতে শুরু করলাম। আমরা কুকুরকে দেখে ভয় পেতে শিখে এসেছি। ঘৃণা করতে শিখেছি (সমাজের উচ্চবিত্তের মানুষ অবশ্য ইংরেজদের অনুসরণে বিলাতি কুকুর বাসায় পালন এবং কোলে-বুকে নিয়ে বসে থাকা বা সম্ভ্রান্ত মেহমানদের অভ্যর্থনা জানাতে বাচ্চাকে আদর করার অনুকরণে বুকে জড়িয়ে বেরিয়ে আসা কিংবা কথা বলতে বলতে অতিথির চেয়ে তার পোষা প্রিয় টমি বা জিমির প্রতি বেশি মনোযোগ দিয়ে থাকেন)। ভয় করতে শিখেছি তার কামড়ে দেওয়ার আশঙ্কায়। কুকুর কামড়ালে জলাতঙ্ক নামক ভয়ংকর রোগাক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকে। জলাতঙ্ক থেকে বাঁচতে কুকুর কামড়ে দিলে নাভির গোড়ায় চৌদ্দটি ইনজেকশন নিতে হয়, যাকে সবাই ভয় পায়। সময়মতো ইনজেকশন সংগ্রহ করে নিতে না পারলে আক্রান্ত ব্যক্তি জলাতঙ্ক রোগে বিকারগ্রস্ত, উন্মাদ হয় অথবা মারা যায়। ভয় সে কারণে।
আর যেখানে-সেখানে মুখ ডুবিয়ে এঁটোঝুটা পচা-বাসি যা-তা খায়, ভাগাড়ে মুখ ডুবিয়ে খাবার খায়, যেখানে-সেখানে শোয় ঘুমায়, এ জন্যই ঘৃণা। এ ছাড়া মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় বিধিনিষেধ তো আছেই।
ধনী মানুষের পোষা, আরাম আয়েশে পালিত হওয়া, বাজার থেকে কেনা মাংস, নামি কোম্পানির প্রস্তুতকৃত বিশেষ খাবার খাওয়া, দামি শ্যাম্পুতে স্নান সারা, বিশেষ চিকিৎসা পাওয়া নাদুসনুদুস লোমওয়ালা আদুরে কতিপয় কুকুর ছাড়া সবই প্রায় বেওয়ারিশ। রাস্তার কুকুর। এদের মাঝে বড় একটা অংশই ঠিকমতো খেতে না পাওয়া, অপুষ্টিতে ভোগা, জীর্ণ, রোগগ্রস্ত, শরীর ভরা ঘা নিয়ে একটুখানি এঁটো ঝুটা, হাড্ডি, কাটা পাওয়ার আশায় গৃহস্থ বাড়ির দ্বারে দ্বারে, আঙিনায় ঘুরে বেড়ায় আর দূর দূর শুনে, তাড়া খেয়ে, লাঠি পেটা খেয়ে ফেরে। কেউ কেউ, ঘেউ ঘেউ করে প্রতিবাদ করে, কাঁদে। কিন্তু খানিক বাদে পেটের খুদায় কোনো বাড়ির খোলা দরজা দিয়ে আবার চুপিসারে ঢুকে পড়ে, নয় কোনো খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে লোভাতুর ঘুরতে থাকে। ওদের ঘৃণা ভরে মানুষ ডাকে নেড়ি কুত্তা। এরা বেওয়ারিশ পড়ে মরে থাকে। পুরসভায় এদের জন্য কোনো ডেথ রেজিস্ট্রার থাকে না, যেমন থাকে না বার্থ রেজিস্ট্রার।
পশ্চিমের চিত্র একেবারে বিপরীত। আমেরিকায় আসা অবধি দেখছি, মানুষ কঠিন শীতে সাইডওয়াকে বড় ভবনগুলোর আনাচে-কানাচে, অথবা বড় বড় চার্চের সুপ্রশস্ত চাতালে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকতেও পারে, দু-এক বেলা খাবার নাও পায়, কিন্তু কুকুরের বেলায় ওসব হওয়ার জো নেই। শীতের সাত মাস গ্যাস অথবা ইলেকট্রিক হিটের উষ্ণতায়, লেপের আরামে মানুষের পাশে মানুষের মতোই ঘুমায়। আলাদা ব্যবস্থা থাকলেও সেটিও বড় আরামপ্রদ, স্বাস্থ্যসম্মত। খাবারদাবার মানসম্মত, ব্যয়সাপেক্ষ। নিয়মিত ব্যয়বহুল চিকিৎসা পেয়ে থাকে। এরা এদের পালক পিতা-মাতার সঙ্গে শহর পরিভ্রমণে, কী দীর্ঘভ্রমণেও যায়। গাড়ির আসনে বসে খোলা জানালা দিয়ে চারদিকের দৃশ্য অবলোকন ও পর্যবেক্ষণের বিজ্ঞ মুখ, মাথা চোখ ঘোরানো দেখলে মানুষ বলেই চকিত বিভ্রম হয়।
এসব কুকুর কামড়ায় না। কিশোরবেলায় দেখা ইংরেজি ছবির কথা আবছা মনে পড়ে। সিনেমাটির মূল বিষয় ছিল, মানুষের মতোই প্রাণীদের স্বভাব অভ্যাস তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে চেয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থা, প্রতিবেশ, প্রশিক্ষণের কার্যকারণ ভূমিকা বেশি। উদাহরণ হিসেবে ব্যাঘ্রশাবককে জন্মের কিছু সময় পরে মানুষের সমাজে এনে মানুষের পরিবারে বড় করা হয়। সে যথেষ্ট বড় হলে তাকে বনে নিয়ে স্বজাতির মাঝে ফিরিয়ে দিয়ে দেখা যায়, সে বাঘের মতো আচরণ করতে পারছে না। অন্যরা তাকে আক্রমণ করছে, সে প্রতি আক্রমণ করছে না। তখন তাকে সরিয়ে আনা হয়।
এখানকার কুকুর কামড়ায় না। কামড়ালে, আঁচড়ালেও ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না, কারণ পূর্বাহ্ণেই কুকুর-বিড়ালের পশু হাসপাতালে নিয়ে নিয়ম করে ইনজেকশন দেওয়া হয়। এসব উন্নত দেশে এদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র আছে। সেখান থেকে অনেকে তাদের নিয়ে পরিবারে নিজেদের সঙ্গে লালন-পালন করে।
বিত্তবানেরা দামি জাতের নামি কুকুর চড়া দামে কিনে এনে পোষেণ। আবার সাধারণ কর্মজীবী মানুষও সাধ্যের মধ্যে অ্যাডাপ্ট করে বা কিনে ঘরে পালন করেন। এদেরও যত্নের ত্রুটি হয় না। ধর্মীয় প্রভাব, সামাজিক সম্মান বৃদ্ধি, নিঃসঙ্গতা দূরীকরণ, স্নেহ-বাৎসল্য প্রকাশের বিকল্প ধারা যেটাই বা যেগুলো সারমেয় শ্রেণিকে সযত্নে লালন-পালনের কারণ হোক, আমার কেন জানি মনে হয়—‘জীবে সেবিছে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’—এই আপ্তবাক্যের মান্যতাই বুঝি এই সমাজকে পশুপ্রীতির শিক্ষা দিয়েছে।
বর্ণিত জাত, শ্রেণির বাইরেও সারমেয়দের আর একটি লঘু অংশ বিশেষ শিক্ষা বা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়, ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়। মোটা অঙ্কের মাইনের সরকারি গোয়েন্দা বিভাগের চাকরিতেও নিয়োগ পায়। সংবাদমাধ্যমে মাঝে মধ্যে সংবাদ দেখি, কোন কোন ধনকুবের চিরপ্রস্থানের আগে তাঁদের পালিত কুকুরের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার উইল করে রেখে গেছেন। মনটা আবার আমাদের দেশে আমার ছেলেবেলায় চলে যায়। ক্লাসে পণ্ডিত স্যার পড়াচ্ছেন, গ্রামের অতি সাধারণ স্কুলের জনৈক পণ্ডিত মশায়ের গল্প। পণ্ডিত মশায় এক ইংরেজ সাহেবের তিন পেয়ে কুকুরের (এক পা খোঁড়া ছিল) পেছনে ব্যয়ের হিসাব সংক্রান্ত পাঠকালে ছাত্রদের প্রশ্ন করে বসেন, ‘সাহেবের তিন পেয়ে কুকুরের জন্য মাসিক খরচ যত টাকা, পণ্ডিত মশায় তাঁর পুরো পরিবার প্রতিপালনের জন্য মাসিক বেতন পান তার তিন ভাগের এক ভাগ, তাহলে তিনি ওই কুকুরের কয় পায়ের সমান?’ ছাত্ররা হিসাব করে জবাব দিয়েছিল, ‘এক পায়ের সমান’।
বাংলাদেশ অনেক দিক থেকে এগিয়েছে। অনেক শিক্ষকও পাল্লা দিয়ে অর্থবিত্তের দৌড়ে অনেক দূর এগিয়েছেন। গ্রামের অতি সাধারণ স্কুলের অতি সাধারণ শিক্ষক কি নিজেদের অবস্থাকে এগিয়ে নিতে পেরেছেন? নাকি আজও তাঁদের পরিবার-পরিজন নিয়ে অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়? অন্যের ছেলেমেয়েকে যত্নে মানুষ করার ব্রত মেনে নিজের ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে পারছেন না? কন্যা সম্প্রদান করতে গিয়ে আজও কি তাঁরা আগের মতোই ভিটে-মাটি বিক্রি করে নিঃস্ব হন? আর ভাবতে পারি না। চোখ ফেটে জল আসতে চায়। গলা ধরে আসে।