এসো হে বৈশাখ-এসো এসো

ঋতু চক্রের আবর্তনে বারো মাসে তেরো পার্বণ। কবি কণ্ঠে ধ্বনিত—
‘বৎসরেতে ছয়টি ঋতু দেয় দরশন
ঋতু ভেদে ধরা দেয় বিবিধ ভূষণ।’
প্রকৃতি বিভিন্ন ঋতুতে নানা রঙে ও বৈচিত্র্যে রূপ পরিবর্তনের মাধ্যমে সকলের মনে আবেগের সঞ্চার করে। প্রকৃতির এ রূপ বদল মানুষকে জানিয়ে দেয় পরিবর্তনই জীবনের চলার পথের একমাত্র সত্য। মরণশীল মানুষ এই বহুরূপী প্রকৃতিতে খুঁজে পায় আনন্দ, জন্ম নেয় উৎসব-পার্বণ। এই আনন্দযজ্ঞে মানুষের দৈনন্দিন জীবন খুঁজে পায় আবেগ, বৈচিত্র্য ও নবজীবনের সঞ্জীবনী সুধার খোঁজ।
এ ঋতুচক্রের পরিবর্তন চলছে বিশ্বজুড়ে। ইংরেজি কবি জন কিটস প্রখ্যাত কবিতা ‘হিউমেন সিজনে’ ঋতুচক্রকে মানব জীবনের চারটি ভাগের সঙ্গে তুলনা করেছেন। বসন্তকালকে সেখানে বলা হয়েছে ‘ভরা যৌবন’। তাঁর চোখে গ্রীষ্ম ‘পড়ন্ত যৌবন’, শরৎ ‘প্রৌড়ত্ব’ ও শীত ‘বার্ধক্য’ বৈশিষ্ট্যধারী। ‘ভরা যৌবন’ তথা বসন্তকে উদ্‌যাপনের জন্যই উৎসবের আনাগোনা শুরু হয় মানুষের দরজায়। সব বয়স, সব শ্রেণির মানুষ এই উৎসবের অংশ। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে উৎসবের প্রাণ হয়ে থাকে তরুণ-যুবারাই। বসন্তে প্রকৃতি সাজে মনের মতো করে। বনরাজিতে দেখা দেয় নব পল্লব। বসন্ত দূত কোকিল কুহু কুহু রবে যুবক-যুবতীর প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর করে তোলে; এনে দেয় সীমাহীন আনন্দ।
যৌবনের চোখে থাকে রঙিন চশমা, যা দেখে তাই ভালো লাগে এ সময়। প্রকৃতি তাদের ভুলিয়ে রাখে। কবির ভাষায়, ‘আনন্দের সাগর থেকে এসেছে আজ বান/ জীবনচক্র দ্রুত ধাবমান।’ যৌবনের আতিশয্যকে ধরে রাখা যায় না। আসে গ্রীষ্ম। পড়ন্ত যৌবন। প্রকৃতি হয় বাস্তবধর্মী। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের দাবদাহ। ঝড়-তুফান, উত্থান-পতন। সবকিছুকে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে গড়ে তোলার অঙ্গীকারের সময়। ইংরেজ কবি শেলি যেমন তাঁর কবিতায় ‘ওয়েস্ট উইন্ড’কে আহ্বান করেছেন অনাচার, ব্যভিচার ও অত্যাচারীদের ধ্বংস করে এক সুন্দর পার্বণমুখর মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে। একইভাবে মানুষের সামনেও হাজির হয় কর্তব্য সম্পাদনের আহ্বান।
এ বৈশাখই আবার বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। সুতরাং পহেলা বৈশাখেই বাঙালির নববর্ষ, হালখাতা যার চিহ্নবাহী। ইংরেজি নতুন বছরের মতো অতটা আতিশয্য থাকে না এর উদ্‌যাপনে। কারণ ১ জানুয়ারি চরিত্রগতভাবেই আলাদা। আছে ঋতুর তফাৎ। বৈশাখে বসন্ত শেষের রেশটুকু খুঁজে পাওয়া যায়। পড়ন্ত সূর্য পশ্চিমাকাশে ছড়িয়ে দেয় আবির রঙের বর্ণচ্ছটা। অনেকটা ম্যাজিকের মতো। ছুটে চলে ফুরফুরে দখিনা বাতাস। এই বৈশাখ খুব কাঙ্ক্ষিত। কবিগুরু তাই আহ্বান জানান বৈশাখকে—‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো।’ নববর্ষবরণে মানুষের মনের আকুলি-বিকুলি। দোকানপাট, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শহরে-গ্রামে সাজ সাজ রব ওঠে। কিটসের ভাষায় প্রকৃতির পড়ন্তবেলাতেই বাংলা দেখে ‘ভরা যৌবনের’ ঝিলিক।

সর্বত্র তখন আড্ডার মেজাজ। চলে নিমন্ত্রণ-আমন্ত্রণের পালা। বিত্তশালী খদ্দের বড় বড় দোকান-পাট থেকে আমন্ত্রণ পান। আর সাধাসিধে মানুষদের এর বালাই নেই। বারো মাসের সাথি দোকানদারদের হালখাতা অনুষ্ঠানে গিয়ে ভিড়ে যান। এই দিনে একটু আপ্যায়ন, মিষ্টিমুখ ও ভাবের আদান-প্রদানই তাদের কাছে যথেষ্ট। দোকানিও খোশমেজাজে সবাইকে আপ্যায়ন করেন। বছরের অন্য দিনের মতো এই দিনে লেনদেন তেমন প্রাধান্য পায় না। চলে নানা অনুষ্ঠান। পাড়ায় পাড়ায় শখের নাটক। এখন অবশ্য এই প্রথায় কিছুটা ভাটার টান চলছে। বর্তমানে উৎসব-পার্বণে ততটা আন্তরিকতা নেই। এটা অবশ্য পয়লা বৈশাখ, নবান্নসহ সব উৎসবের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এর স্থান দখল করেছে টেলিফোন/ মোবাইল বা ইন্টারনেটে ছোট্ট আলাপন। উৎসবের নয় সংস্করণ—বিচিত্রানুষ্ঠান। বাংলা গানের বদলে হিন্দি গানের রমরমা। উৎসব জায়গা নিয়েছে বোকা বাক্সের ছোট রঙিন পর্দায়। সেখানে হরেক রকম সিরিয়ালের আয়োজন। ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে ৬০০ কোটির বিশ্বকে কান ও চোখের সীমায় নিয়ে মানসিকভাবে আমরা রয়েছি ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আন্তরিকতা এখন ভণ্ডামির নামান্তর।
উত্তরণের পথ উগ্র আধুনিকতা নয়। প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত নব-নবায়নের প্রতিষ্ঠা। নগ্ন পপ গানের আসরের চেয়ে প্রাচীন জলসার আসর অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী ছিল। সেখানে শ্রোতা ও শিল্পীর মধ্যে একটা আদান-প্রদান হতো। আমাদের কালে কবিয়াল, উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর দেখেছি। সেটা পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কথা। বড় বড় শিল্পীর অনুকরণে গ্রামগঞ্জের শিল্পীরাও নিজ নিজ আসর জমিয়ে রাখতেন। মানুষ এখন কর্মব্যস্ত। একটু-আধটু অবসর বিনোদনই যথেষ্ট, যা অবারিত করে দিয়েছে ছোটপর্দা ও কেবল লাইন।
আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধাকে অগ্রাহ্য করে নয়, বরং এর সঙ্গে ঐতিহ্যকে সমন্বয় করেই এগিয়ে যেতে হবে। এই সমন্বয়ের মাধ্যমেই গড়ে তুলতে হবে উন্নত রুচিবোধ, যা উৎসবকে সবদিকে সব স্তরে ছড়িয়ে দেবে। নববর্ষ থেকে শুরু করে সব উৎসবে আয়োজনে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে বারো মাস তেরো পার্বণের সঙ্গে অসংখ্য পার্বণ শামিল হয়েছে। এটা ভালো কথা। প্রতিটি দিনই একটি পার্বণের রূপ নিক। বিগত বছরের সব গ্লানি মুছে যাক। প্রতিটি পার্বণ পরিণত হোক মানবতাবোধের আনন্দযজ্ঞে।