হারিয়ে যেতে হবে নিঃশব্দে কালের গর্ভে!

সম্ভবত ৯০/৯১ সাল হবে। রেস্টুরেন্টে কাজ শেষে মধ্যে রাতে বাসায় ফিরেছি। শীতের সকাল। ঘুম যেন আরও জোরেশোরেই চেপে বসেছে। টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ক্লান্তিতে উঠতে একদম ইচ্ছে হচ্ছে না। তবু বেজেই চলছে।
হ্যালো বলতেই বোঝা গেল অপর প্রান্তে বিলকিস ভাবি। জাফর ভাইয়ের ওয়াইফ। কয়েক মাস হলো গ্রিনকার্ড পেয়ে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে আমেরিকা এসেছেন। ঢাকায় পেট্রোবাংলার চিফ মেডিকেল অফিসার ছিলেন। ভালো চাকরি ছেড়ে ছেলের ভবিষ্যৎ ও স্বামীর সান্নিধ্য পাবেন বলে এখন নিউইয়র্কের স্থায়ী বাসিন্দা। কী ব্যাপার, জানতে চাইতেই জানালেন জাফর ভাইয়ের বুকে ব্যথা শুরু হয়েছে আবার। আমাকে যেতে অনুরোধ করলেন। ‘এখনই আসছি’, বলে ফোন রেখে দিলাম।
মুহূর্তের মধ্যে গেল কিছুদিনের স্মৃতি চোখের সামনে এসে দাঁড়াল। নিউইয়র্কেই জাফর ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম দেখা। সারাক্ষণ হাসিখুশি সুস্থ দেহে থাকা এই মানুষ দুলাভাই আবুল মনসুর খানের বন্ধু এবং বিদেশ বিভুঁইয়ে জীবনযুদ্ধে আমাদের জন্য অফুরন্ত প্রাণশক্তির উৎস।
মনে পড়ল, ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর। ওয়ার্কিং (লিগ্যাল) পেপার কিছুই নেই। মাত্র আমেরিকায় এসেছি। মনে পড়ে মতিঝিল আদমজী কোর্টে তখন আমেরিকান দূতাবাস। ওয়ারীর বাসা থেকে সকালবেলা অফিসে যাওয়ার পথে দেখতাম প্রচুর মানুষের ভিড় লেগেই থাকত। একদিন আমেরিকান দূতাবাসের সামনে ডাক্তার কয়েক বছরের সঙ্গে দেখা। ‘কি ব্যাপার মামা? অনেক দিন পর’ ইত্যাদি প্রাথমিক কথা শেষে ওকে নিয়ে আমার অফিসের কাছে ‘ক্যাফে ঝিল’ রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলাম। জানতে চাইলাম এখন কোথায় থাকে সে। উত্তরে জানাল, তিন বছরের জন্য ইরান চলে গিয়েছিল। বাবার অসুস্থতার কারণে চাকরি ছেড়ে দেশে চলে এসেছে। ফিরে এসে সিলেট মেডিকেল কলেজের শিক্ষক হিসেবে আবার যোগ দিয়েছে; কিন্তু ভালো লাগছে না। আমাকে বলল, ‘মামা, তুমিও আমেরিকায় চল। দূতাবাসে একজন কালো লোক আছে, সহজেই ভিসা পাওয়া যায়।’ কয়েক দিন পর সত্যিই বিকেলে এসে বলল, ‘মামা ভিসা পেয়ে গেছি। এবার তোমার পালা। তোমার অফিসের এত কাছে। কিছু কাগজপত্র নিয়ে উঠে পড়।’
তাড়াহুড়া করে ঠিকই মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলাম। যথেষ্ট পরিমাণে ডকুমেন্ট না থাকায় পাসপোর্টে ডিনাই সিল মেরে দিল। তারপর আমেরিকা আসার জেদ চেপে বসল। সে এক লম্বা কাহিনি। দুই বছর পর ঠিকই আমেরিকায় চলে এলাম। কোথাও বাংলাদেশিদের উপস্থিতি নজরে পড়ে না। কিছুদিন পর রানা এল। বাসা ছিল নাখালপাড়ায়। কঠিন আওয়ামী লিগার। স্বৈরাচারী এরশাদের দুঃশাসনের শেষ মুহূর্ত তখন। সেই সময় অঘটনের আশঙ্কায় বাবা আমেরিকা পাঠিয়ে দেন তাকে। ওদের সঙ্গে এল আরেকজন, কাজল হায়াত খান।
ওয়ার্কিং পেপার ডিক্লাইন হলেও কাজের অসুবিধা হয়নি। এদিকে কাজল হায়াত খান স্থানীয় এক কলেজে কম্পিউটার সায়েন্স পড়বে বলে ভর্তি হয়েছেন। বয়সে তরুণ, চমৎকার রান্না জানেন। অবশ্য রেখা আপার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনীতিক মনসুর খানও খুব ভালো রান্না জানেন। ওদের দুজনের কাছ থেকেই আমার রান্না শেখা। জাফর ভাই অবশ্য রান্নায় তেমন পারদর্শী না। সাইফুল ভাইকে ফলো করতে গিয়েই নাকি খান সাহেব ও কাজল ভাই লন্ডন থেকে আমেরিকায় এসেছেন। এটা অবশ্য সাইফুল ভাইয়ের ভাষ্য। লন্ডনে জীবন নাকি খুব একঘেয়ে। আমেরিকার মতো বৈচিত্র্য নেই।
গ্রিনকার্ড পেয়ে জাফর ভাইয়ের পরিবার চলে এল। ভাগ্যবানই বলতে হবে। একসময় বাংলাদেশ অক্সিজেনের ম্যানেজার ছিলেন। ঢাকায় আমার কর্মস্থল বিআইডাব্লিউটিএ অফিস থেকে বেশ দূরে তেজগাঁওয়ে তাদের অফিস। পরিচয় ছিল না আগে। নিউইয়র্ক এসেই পরিচয়। পরিবার আসার আগ পর্যন্ত অ্যাস্টোরিয়ায় আমাদের সঙ্গে থেকেছেন। দারুণ মজার মানুষ। এই তো সেদিনও একসঙ্গে ম্যানহাটনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজের সন্ধানে ঘুরেছি। আজ তার বুকে চিনচিনে ব্যথার খবর এল।
বুকে ব্যথার জন্য আগের দিন সারা রাত অ্যালমহার্স্ট হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ছিলেন। সব ঠিক আছে বলে ছেড়ে দিয়েছে। ভাবি নিজেও একজন চিকিৎসক। তবু অসহায়। আমেরিকায় বাংলাদেশের ডিগ্রিধারীদের গণনায় ধরা হয় না। জাফর ভাইয়ের খবর শুনে বাসা থেকে বের হব, তখনই ফোনটা আবার বেজে উঠল। ‘এখন কি খবর ভাবি?’ জানালেন, ‘খুব খারাপ। অ্যাম্বুলেন্সে মাউন্ট সানাই চলে যাচ্ছি। অপারেশন করাতে হবে।’ বললাম, ‘কেন? গতকাল না এলমহার্স্টে জানাল কিছু হয়নি; তাহলে!’
দ্রুত সাবওয়ের দিকে পা বাড়ালাম। সুস্থ সবল মানুষ। হঠাৎ করেই বিদেশের মাটিতে এমন অপ্রত্যাশিত বিপদ! মুহূর্তে মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। সবাই ওয়েটিং রুমে। জাফর ভাই অপারেশন থিয়েটারে। ওপেন হার্ট সার্জারি হচ্ছে। বারো/চৌদ্দ ঘণ্টার অস্ত্রোপচার। হার্টের চিকিৎসায় বিশ্বের সেরা হাসপাতাল মাউন্ট সানাই। নিশ্চিত ছিলাম জাফর ভাই সেরে উঠবেন। বিশ/বাইশ ঘণ্টা পর যখন ইনটেনসিভ কেয়ারে দেখতে গেলাম, মিট মিট করে আমাদের দিকে তাকালেন। হাসি তখনো মুখে লেগে আছে। আমেরিকা আসার আগে সৌদি আরবে ডায়েটিশিয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কী কী খেলে দেহে চর্বি জমবে না, সে ব্যাপারে অগাধ জ্ঞান থাকার পরও এই ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ফ্লোর ম্যানেজার হিসেবে কনওয়ে ডিপার্টমেন্টাল (ক্লথিং) স্টোরে কাজ করার সময় তাঁকে দেখেছি প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও হাসতে। ভবিষ্যতের উজ্জ্বল ভাবনায় সতেজ থেকেছেন প্রতিটি মুহূর্ত। কত উত্থান-পতন গেছে।
আমেরিকায় অনিশ্চয়তাময় দিনগুলো আজও মনে পড়ে। বৈধ কাগজ নেই। সব সময় একটা চোর-পুলিশ খেলার মধ্যে রয়েছি। সেই সব দিনে দীর্ঘশ্বাসকে আলিঙ্গন করে দোটানা ও হতাশায় কেটেছে আমাদের প্রতিটি মুহূর্ত। সোনার হরিণ গ্রিনকার্ডের দেখা নেই। নীরবে জন্মভূমির জন্য মন কাঁদে। রাজনৈতিক অচলাবস্থায় সম্ভাবনাময় সদ্য স্বাধীন স্বদেশ তখন পরপর সামরিক অভ্যুত্থানে বিপর্যস্ত। দুর্নীতিবাজ ও পরজীবীদের বাড়বাড়ন্ত। ভেবেছি এই দুর্নীতির আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়া দেশটা থেকে পালিয়ে যেতে হবে অথবা লড়াই করতে হবে। লড়াই করা হয়নি। সরকারি চাকরি ছেড়ে চলে এসেছি। এই সিদ্ধান্ত কতটুকু সঠিক ছিল আজও ভাবায়। কাজে যোগ দেওয়ার জন্য অনেক দিন স্থায়ী ঠিকানায় নোটিশ গেল। ফিরে যাওয়া হলো না। জাফর ভাইও নিশ্চয় এ রকম কিছু করেছিলেন। কখনো জানা করিনি। প্রচুর পরিশ্রম করতে গিয়ে আজকে এই বিপদ। ওপেন হার্ট সার্জারি হওয়ার পরও চার পাঁচ দিনের মাথায় বাসায় চলে আসতে হলো। পূর্বের সেই প্রাণশক্তি অনেকটা ম্লান হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে একমাত্র ছেলে বিশ্ববিখ্যাত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। এখন ভার্জিনিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। মা-বাবাকে সেখানেই নিয়ে গেছে।
তিন চার বছর পর। ৯৫/৯৬ সাল হবে। আমেরিকার প্রচণ্ড ব্যস্ততায় একসময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটা ভুলে যেতে বসেছি। দুপুরে কল এল ভার্জিনিয়া থেকে। জাফর ভাই আর নেই। আবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। এবার সারভাইভ করতে পারেননি। স্পষ্ট মনে আছে , চিকিৎসক দশ/বারো বছর কিছু হবে না বলে ভরসা দিয়েছিলেন। আশাগুলো নিমেষে হারিয়ে গেল।
দূরদেশে নিজেকে উৎসর্গ করে সাফল্য ও ব্যর্থতার দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন এই সামনে ছুটে চলা। পরবর্তী প্রজন্ম এই ঝঞ্ঝাপূর্ণ দুঃসাহসী অভিযাত্রার কতটুকুইবা বুঝবে। হয়তো এখানকার অন্যান্য অভিবাসীদের মতো আমাদের উত্তর প্রজন্ম একদিন মিশে যাবে মূল স্রোতে। দেশের সঙ্গে কোনো মায়ার বাঁধনে জড়াবে না। জাফর ভাইয়ের মতো আমাদেরও হারিয়ে যেতে হবে নিঃশব্দে কালের গর্ভে।