পদাবলি ধুয়ে গেছে অনেক শ্রাবণে

পঞ্চাশ বা তারও অনেক আগে চৈত্রের দিনগুলো কৃষকদের জন্য ভয়াবহ ‘খরা’ হয়ে আসত। নুয়ে পড়া হাড়-জীর্ণ মানুষের দিকে তাকানো যেত না। আকাশে তীব্র প্রখর তপন-তাপ, পাকস্থলী শূন্য, তবুও মাথলা মাথায় নিড়ানির কাজ করে যেত নীরবে। বাবা–কাকারা ভাবতেন, আর মাত্র কয়েকটা দিন পরই আউশ ধান উঠলে দিন কিছুটা ফিরবে গরিব কৃষি শ্রমিকদের। কিন্তু এরই মধ্যে শিশুরা অপেক্ষা করত অন্য একটি দিনের। আমাদের কাপড়ের দোকানের কর্মচারীরা বলতেন, হালখাতা, মা-চাচি-ফুফু-খালারা গ্রামের ভাষায় বলতেন ‘গলইয়া’! সেদিন আমাদের দোকানে হরেক রকমের মিষ্টি আনা হতো সুবল ঘোষের দোকান থেকে। রসগোল্লা, লালমোহন, নিমকি। আমাদের দোকান থেকে বাকি নেওয়া খরিদ্দাররা আসতেন পাওনা শোধ করতে, তাদের ছোট প্লেটে মিষ্টি-নিমকি দেওয়া হতো। ছোট কাকা মাঝে মাঝে আমার মতো শিশুর হাতে পরিবেশনের দায়িত্ব দিতেন। কাপড়ের আলমারিগুলোর পেছনে রাখা মিষ্টির হাঁড়ি থেকে আমি মিষ্টি–নিমকি প্লেটে করে এনে দিতাম। কিন্তু আমার মন পড়ে থাকত অন্যত্র। বাজারের উত্তর দিকটায় হাতি ঘোড়া পুতুলসহ মাটির তৈরি নানান রঙিন খেলনাসহ আরও অন্য কিছুর দিকে। আর থাকত আমার প্রিয় নলের বাঁশি।

আমি অপেক্ষা করতাম, কখন ছোট মামা আসবেন। আমার সব আরজি থাকত ছোট মামার কাছে, যিনি আমাকে স্নেহের ছায়ায় রাখতেন সব সময়। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে মা জামার বোতাম লাগিয়ে মাথা চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতে আঁচড়াতে বলতেন, আমি যেন কিছুতেই ছোট মামাকে বিরক্ত না করি। আর আমার হাফ প্যান্টের পকেটে দিতেন একটা কাঁচা টাকা, ধাতব, আজকাল যা বিলুপ্ত! মা ঠিক জানতেন, সেদিন মামা এসে আমার বায়না মেটাতে আমাকে নিয়ে ‘গলইয়ার’ খেলনা কিনতে যাবেন। আমি মাটির ও কাঠের তৈরি খেলনা কিনে দিতে বলতাম মামাকে, আর মামা হাসতে হাসতে সবই কিনে দিতেন, আর বাড়তি কিনতেন কিছু কদমা, সাদা গোলাকার ছোট মিষ্টি যা চিনি আর ময়দা দিয়ে তৈরি। মা কদমা খেতে খুব ভালোবাসতেন। কদমার প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে মামা সব খেলনা যাতে ভেঙে না যায়, সে জন্য নিজের হাতে নিতেন। আমি বারবার তা আমার হাতে দিতে বায়না ধরতাম। মামা বলতেন, ‘তুমি তো এতগুলো নিতে পারবে না, বাড়ি গিয়ে নিয়ো।’
বাড়ির পথ দীর্ঘ মনে হতো আমার, কতক্ষণে পৌঁছাব! কিছুতেই সময় যেন এগোয় না, কতক্ষণে মাকে এসব দেখাব, কতক্ষণে বন্ধুরা কে কী কিনেছে তা দেখব। বাড়ি ফেরার পর বৈঠকখানা থেকে উঠান পেরিয়ে এক দৌড়ে রান্না ঘরে মায়ের কাছে যেতাম, দেখতাম মা আর দাদি ঘর্মাক্ত। কপালে ও গ্রীবায় চিক চিক করছে ঘাম। আমার মায়ের উজ্জ্বল সাদা দাঁতগুলো হাসত, আমাকে তিরস্কার-মেশানো ভঙ্গিতে বলতেন, মামাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেছি তাও এত কিছু কিনেছ! আমি কিছুক্ষণ পরই সবকিছু নিয়ে আমার পাশের বাড়ির বন্ধু হজরত আলী ও সামাদের বাড়ির দিকে যেতাম ওদেরকে দেখাতে। একসময় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলে কখন ঘুমিয়ে পড়তাম আমার ঘোড়া ও নলের বাঁশি বালিশের কাছে নিয়ে। সকালে উঠে সেগুলো না দেখলেই ভয়ার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকাতাম, মা কাঠের আলমারি থেকে সেগুলো বের করে দিতেন। ঘুমিয়ে পড়ার পর মা আমার হাত দুটো সন্তর্পণে সরিয়ে খেলনাগুলোকে তুলে রাখতেন। এভাবেই আমি আমার ছেলেবেলার পয়লা বৈশাখ কাটিয়েছি।


ধীরে ধীরে প্রকৃতির নিয়মে সময় বদলে গেল। আমি শিশুবেলা কাটিয়ে বালক বয়স বা কৈশোরে, আমার প্রথম প্রেমের অঞ্জন মাখা কল্লোল জড়ানো ঢাকায় পয়লা বৈশাখকে ভিন্নভাবে দেখতে শিখলাম। সকালে রমনা, ওয়াহিদুল হক-সন্‌জীদা খাতুনের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়া রবীন্দ্রনাথের সুরের স্নিগ্ধতায় বাতাস সৌভাগ্যবতী হতো, আমরা একটু একটু করে বাঙালি সত্তার শেকড় সন্ধানে নিমগ্ন হওয়ার চৈতন্যে পৌঁছলাম। সেটা খুব বেশি দিন আমাদের ধরে রাখতে পারেনি। হয়তো বিশ্বাসঘাতকতা-প্রবণতা রক্তে ছিল, আমরা চকচকে ঝকঝকে ইংরেজি-মার্কিন সংস্কৃতিতে যুক্ত হওয়ার ব্যর্থ-বাসনায় ডুবে গেলাম। আমার ছেলেবেলার হাতি–ঘোড়া–নলের বাঁশি সবই স্মৃতি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে আমার মায়ের কপালের গ্রীবার চিকচিকে ঘামের মমতা বিষয়ে বিস্মৃত হলাম।
প্রায় মধ্য তিরিশে যখন দেশ ছেড়ে নিউইয়র্কে স্থিত, তখন বৈশাখ একেবারে ভিন্ন রূপে দেখা দিল আমাদের জীবনে। তরুণীরা হলুদ শাড়িতে, খোঁপায় পুষ্পশোভিত, চোখে মুখে উদ্দাম যৌবনের ছায়া ফেলে জ্যাকসন হাইটসে প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাঙালি দোকানগুলোতে গরম ভাতের সঙ্গে ঠান্ডা পানি মিশিয়ে নকল পান্তা ভাত বানিয়ে তাতে ইলিশ মাছ দিয়ে দেদার ভিড়ে খাচ্ছেন সবাই। আমার ছেলেবেলার অনাহারী মানুষগুলোর পান্তা ভাতের জরাজীর্ণ জীবনকে ব্যঙ্গ করার এর চেয়ে উজ্জ্বল রসিকতা আর কী হতে পারে! নিজের অজান্তে আমিও বন্ধুদের সঙ্গে সেই রসিকতায় শামিল হয়ে নিজের শেকড়ের আর সংস্কৃতির নকল ও পাপ মেশানো আভিজাত্যে নিজেকে আরও ধারালো করার চেষ্টা করছি আড়াই দশক ধরে। শুধু মাঝে মাঝে চকিতে মায়ের অসহায় মুখখানা মনে ভেসে উঠে, কিছুটা বেদনার্ত হই ক্ষণিকের জন্য, এই যা!