অচৈতন্য ভাবনা

মনে হয় অনাহূত ঝামেলা থেকে নিষ্কৃতি আসবে না। সমস্যার পাহাড় কেটে সমাধান হলে আবারও পূর্বাবস্থায় ফিরে আসা। নতুন কিছু এসে হাজির। এ যেন ভিসিয়াস সার্কেল। জীবনে টিকে থাকার সংজ্ঞা বুঝি এমন।
থ্যাংকস গিভিং সন্ধ্যায় শরিফদের বাসায় যাব। রেখা আপা বারবার কল দিচ্ছিলেন। কিন্তু মেয়ের অ্যাপ্লিকেশন কমপ্লিট করতে গিয়ে যাওয়া হলো না। মাসুদকে আগেই বলে দিয়েছি ওদের বাসায় হয়তো যাওয়া হবে না।
আমাকে দিয়েই ফরম ফিলআপ করতে হবে। ১০ থেকে ১৫ মিনিটে শেষ হওয়ার কথা কিন্তু আরও বেশি লেগে গেল। ট্যাক্স ইনফরমেশনসহ অনেক কিছুর দরকার। ইদানীং আইআরএস থেকে অহেতুক উৎপাত বেড়েই চলছে। ছাপোষাদের ওপর চওড়া হওয়া যেন তাদের প্রধান টার্গেট। অথচ ইনকাম আগের চেয়েও অর্ধেকের বেশি নিচে নেমেছে।
মেয়েকে বললাম, তোমার ভাইয়েরা স্কুলের সবকিছু আমাকে না জানিয়েই ফিলআপ করে ফেলত? বড়জোর একটা কল দিয়ে বলত এই ইনফরমেশনগুলো ইমেইলে পাঠিয়ে দাও। ব্যাস।
—আমিতো তোমার মেয়ে। তোমাকে অনেক কেয়ার করি আব্বু। ভাইয়াদের মতো নই।
আমি ওর রেসপন্সে একেবারেই চুপ হয়ে গেলাম। নিজেকে অনেক অনুতপ্ত হতে হলো। সত্যিই এ রকম বলা ঠিক হয়নি। মেয়ের প্রতি আমার আরও বেশি আস্থা প্রকাশ করা উচিৎ ছিল। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। ছোট্ট খুকি নয়। আমাদের হজে যাওয়ার সময় সে একটা ভালো অ্যামাউন্ট দিয়ে সাহায্য না করলে বেশ অসুবিধায় পড়তাম। ছোট্ট মেয়ে। সামারে তিন মাস কাজ করে পুরো ইনকাম বাবা-মাকে দিয়ে দিল! মরগেন স্টেনলির মতো বিশ্বের প্রথম সারির ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে শিক্ষানবিশ ডেটা অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করে আমাদের বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। তখনো হাইস্কুল গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়নি।
সেদিন খাওয়ার টেবিলে অনেকক্ষণ গল্প করায় সেটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। ওর মার প্রতি অমনোযোগিতা দেখলে ক্ষোভ প্রকাশ করবেই। এই ব্যাপারে ওর ভাইদের চেয়ে অবজারভেশন শতগুণ বেশি। ছোট হয়েও অনেক বিষয়ে তাদের চেয়ে পরিণত। মেয়েরা এমনি। সবাই তাই বলে।
—আমরা সবাই বাইরে। আম্মুও এখন ঢাকায় কয়েক মাস থাকবে। তুমি কি খুব লোনলি ফিল কর বাবা? আমি আজকে সারা দিন তোমার সঙ্গে থাকব। কোথাও যাব না। ঠিক আছে?
আমার সম্মতি নিতে চাইল। নিউইয়র্কে আসলে বান্ধবীদের সঙ্গে সময় বেশি কাটাতে পছন্দ করে ছুটির দিনগুলোতে। এবার কিছুটা ব্যতিক্রম। একটু সময় নিয়ে বললাম, তোমরা তো সবাই একে একে দূরে চলে যাচ্ছ আম্মু, আমাদের সঙ্গে কি আর থাকবে?
—হ্যাঁ, আমরা সবাই ফিরে আসব বাবা।
অনলাইনে ফরম ফিলআপ করতে গিয়ে একটা পর্যায়ে নতুন করে পাসওয়ার্ড চাওয়ায় সমস্যা দেখা দিল। প্যারেন্টসের ইমেইলে ছোট ছেলের ইমেইল দেওয়া আছে। আমার ইমেইল কেন দাওনি? অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
—তুমি তো সব সময় মেইল চেক কর না বাবা? মেয়ের সোজা উত্তর।
ছোট ছেলেকে কল করলে মেসেজ চলে যায়। এখন কি করা? সময় তো খুব কম। ঠিক আমার মতো স্বভাব হয়েছে। একেবারে ইলেভেন্থ আওয়ারে কিছু নিয়ে বসবে।
একটু পরে ছেলের রিটার্ন কল। কেন কল করেছ বাবা? আমি তো লস অ্যাঞ্জেলসের বাইরে।
মেয়ে তার ভাইকে বুঝিয়ে বলল সমস্যাটা কোথায়। তবুও এখন সে সময় বের করতে পারবে না।
না বাবা, এখনই এই কাজটা সেরে ফেলতে হবে নতুবা তোমার বোনের ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস এবং স্কলারশিপের প্রবলেম হতে পারে, আমি বললাম।
আমি তো সানফ্রান্সিসকোতে বন্ধুর বাসায় থ্যাংকস গিভিং ডিনারে। এই হই চইয়ের মাঝে তোমাদের হেল্প করা অসম্ভব, এ ছাড়া কম্পিউটার সঙ্গে নেই।
ওখানে কেন? লস অ্যাঞ্জেলস থেকে তো ওই সিটি অনেক দূরে। কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলাম।
বন্ধুর বাড়িতে সাত ঘণ্টা ড্রাইভ করে থ্যাংকস গিভিং ডিনারে যোগ দিতে গেছে। অফিস বন্ধ। দুই বন্ধু মিলে চলে গেছে। দুজনই ভিন্ন ভিন্ন আর্কিটেক্ট ফার্মে কাজ করে। জানি না ছোট ছেলের নিউইয়র্কে আসা আদৌ হবে কি না?
বড় ছেলে সিয়াটল থেকে মাঝে মধ্যে হাই হ্যালো করে। তাতেই সন্তুষ্টি আমাদের। মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানে জয়েন করে এখনো আগের মতোই রয়ে গেছে। কয়েক দিন আগে হঠাৎ কল দিয়ে জানাল আমার জন্য বার্থ ডে গিফট কিনেছে। অত্যাধুনিক ঘড়ি। যেটা হয়তো আমার কোনো প্রয়োজন নেই। অনেক অ্যাকটিভিটিস আছে ওতে।
শেষ পর্যন্ত ছোট ছেলের সহায়তায় ফরমটি সময় মতো ফিলআপ করে সাবমিট করল। পরদিন সন্ধ্যায় পোর্ট অথোরিটি বাস টার্মিনালে মেয়েকে নামিয়ে মধ্য রাতে বাসায় ফিরলাম। আবার সপ্তাহের জন্য ছুটি হলে তখন আসবে। ঘরে ফিরে সবকিছু যেন অর্থহীন লাগল। মনে হলো সমস্ত অ্যাপার্টমেন্ট একরাশ নীরবতা নিয়ে তাচ্ছিল্য করছে। জানালা দিয়ে দূরের আকাশে দৃষ্টি ফেলতে মনে হলো কিছু সুবিধাবাদী দুষ্টু গ্রহ আটকে পড়া তারাকে ব্যর্থ ছোবল দিতে দ্বিধা করছে না। তারাগুলি ওদের পরোয়া করছে না। মিটমিট আলোর ঝলকানিতে স্নিগ্ধ শোভায় উদ্ভাসিত হচ্ছে। কাজ থেকে বাসায় ফেরার পর লিভিং রুমে জানালার ওপারে সেতুটির ওপর চোখ পড়বেই। দ্রুত চলে যাওয়া রংবেরঙের যানবাহনগুলোর স্পন্দন যেন তার প্রাণশক্তি। দীর্ঘদিন থেকে এমন হয়ে আসছে। হঠাৎ খেয়াল হলো এখানে জ্যোৎস্না বা তারা আসবে কোত্থেকে? বিশাল ঝুলন্ত সেতুর অগণিত সারি সারি হ্যালোজেন বাল্বের বিচ্ছুরিত নীলাভ আলো এতক্ষণ ধরে দেখছিল। এই অপরূপ সৌন্দর্যের ঝুলন্ত সেতুটি কুইন্স, ম্যানহাটন এবং ব্রঙ্কসকে সংযুক্ত করে রেখেছে একই বন্ধনে। তবে কেন এমন ভাবনায় পেয়ে বসেছিল? যে ঘরটি সবার কলকাকলিতে মুখরিত থাকত শুধু সেই আঙিনায় এখন তার নিঃসঙ্গ পদচারণা হয়তো কারণ। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি ও তীব্র গতি নিয়ে সেতুটির ওপর প্রকাণ্ড লরিগুলো চোখের সামনে অন্য কোনো স্টেটের উদ্দেশ্য অদৃশ্য হয়ে যায় তখনি মধ্যে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে যাওয়ায় অচৈতন্য ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসে।