নিউইয়র্কে পেন্সিল এর নববর্ষ আয়োজন

নববর্ষের আয়োজনে পেন্সিলর ও অতিথিরা
নববর্ষের আয়োজনে পেন্সিলর ও অতিথিরা

নিউইয়র্কে পেন্সিল আয়োজিত নববর্ষের আয়োজন ছিল ২০ এপ্রিল। এবারের আয়োজনে পেন্সিলের পক্ষ থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার জন্য আমন্ত্রণ করেছিলাম মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমামকে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তিনি এসেছিলেন এবং আমাদের সবাইকে শুনিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে সময়ের নানা অভিজ্ঞতা।
১৯৭১ সালে আমি খুব ছোট ছিলাম। অ্যানা ফ্রাঙ্কের মতো ডায়েরি লেখার বয়স ছিল না আমার। থাকলে আমিও লিখতাম। মনে পড়ে, আমাদের শান্ত সুন্দর ছবির মতো শহরটিতেও আগুন জ্বলেছিল, শকুন উড়েছিল। তছনছ হয়ে যাওয়া শহরটি ছেড়ে আমরাও একদিন পালিয়ে যাই। আমার পুতুল খেলার সাথিরা ভারতে চলে গেল সীমান্ত পেরিয়ে, আর ফিরল না। তরুণ-যুবা-বয়স্ক নারী-পুরুষ, যাঁরা অস্ত্র ধরেছেন, তাঁদের আমরা সব সময় শ্রদ্ধা করব; দেশ কিংবা বিদেশ যেখানেই হোক। আর এ জন্যই পেন্সিল আয়োজিত এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় নিউইয়র্কপ্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমামকে। পেন্সিলের শিশুদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে, রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের দেশের ইতিহাস জানাতেই এই আয়োজন।
মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম ১৯৭১ সালে মেট্রিক পরীক্ষার্থী ছিলেন। বেশির ভাগ মা-বাবা স্বেচ্ছায় তাঁদের সন্তানকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেননি। তাজুল ইমামকেও দেননি তাঁর মা-বাবা। দেশের ডাকে সাড়া দিতে তিনি পালিয়ে যুদ্ধে চলে যান। সেই পালিয়ে যাওয়া থেকেই শুরু হয় তাঁর মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা। তিনি প্রজেক্টরে ছবি সেট করে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলা শুরু করেন।
পেন্সিলের নববর্ষ আয়োজনটি ছিল জ্যাকসন হাইটসের বাংলাদেশ প্লাজায়। জাতীয় সংগীত গেয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। এর পর শম্পা রহমানের নেতৃত্বে সবাই মিলে গাই, ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’। শুরু হয় নতুন প্রজন্মের পেন্সিলরদের ছবি আঁকা। তারা জাতীয় পতাকা রং করে লাল-সবুজে। আর গ্রামের দৃশ্য রং করে সিয়ান, ফারহান, পূর্ণতা, জায়ান, অঙ্কিত ও ছোট্ট অত্রি। তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন তাজুল ইমাম। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন প্রীতি।
‘এসো হে বৈশাখ’ সম্মিলিত ভাবে গাওয়ার পর মোয়া, নাড়ু, পাটিসাপটা, নারকেলের পিঠা, দুধ-চিতই ও চা পরিবেশন করা হয়। পেন্সিলর জেবা নূর নিউইয়র্ক পেন্সিলরদের নববর্ষের ভালোবাসা জানিয়ে পাঠিয়েছিলেন সন্দেশ, মুড়কি দিয়ে সাজানো কুলা ও ডালা। বাক্সভর্তি গোলাপ পিঠা। আর বাংলাদেশ থেকে এই ভালোবাসা বয়ে নিয়ে আসেন আরেক পেন্সিলর মো. ফখরুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে কিশোর-কিশোরীরা বাংলা গান ও আবৃত্তি ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। নুসরাত নাবিলা তাবাসসুম আবৃত্তি করে ভবানী প্রসাদ মজুমদারের ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ কবিতা। ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে’ নজরুলগীতি গায় অহনা। ‘তুমি কী দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’ গেয়েছিল মনন মুস্তাকিম হায়দার। ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’ গেয়ে শোনায় পূর্ণতা অন্যতমা হাসান। এই প্রবাসে বাংলা কবিতা আবৃত্তি ও বাংলা গানের চর্চা বেশ কঠিন। তাই নতুন প্রজন্মের এই পরিবেশনা সবাইকে মুগ্ধ করে।
পেন্সিলর সাবিনা ইয়াসমিন আবৃত্তি করেন কাজী নজরুলের ‘অভিশাপ’ কবিতা। নাসরিন সুলতানা উনার মেয়ে অহনা ও ছেলে আয়ুষমানকে নিয়ে সৈয়দ শামসুল হকের ‘আমার পরিচয়’ কবিতার অংশবিশেষ পাঠ করেন। শাহেদা চৌধুরী তাঁর মেয়ে নুসরাত নাবিলা তাবাস্‌সুমসহ আবৃত্তি করেন রফিক আজাদের ‘নেবে স্বাধীনতা’ কবিতার অংশবিশেষ। কবি আলেয়া চৌধুরির কবিতা পাঠ করেন রুপা খানম। ফখরুল ইসলাম ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে ‘মহুয়া সুন্দরী’ পাঠ করেন। শিল্পী কাজল জমজমাট বাংলা আধুনিক গান গেয়ে পুরা অনুষ্ঠান জমিয়ে তোলেন। আর হাসান মাহমুদ ‘নেশা লাগিল রে’ শুনিয়ে নেশা ধরিয়ে দেন।
পেন্সিল পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত বইসহ নিউইয়র্কের পেন্সিলরদের এ বছর অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত বইগুলোর মোড়ক উন্মোচন করেন তাজুল ইমাম ও কবি আলেয়া চৌধুরি। এ পর্বে একে একে উন্মোচিত হয় স্মৃতি ভদ্রের ‘অন্তর্গত নিষাদ ও পায়রা রঙের মেঘ’, মনিজা রহমানের ‘অশুভকাল’, রোকেয়া দীপার ‘জোনাকী পোকা’, রোমেনা লেইসের ‘ঘুঙুর’, রিমি রুম্মানের ‘অনুভূতির আকাশে তারার মেলা’, শেলী জামান খানের ‘বুকের গহীনে কীর্তনখোলা’ ও ‘এক মোহনার জীবন’, নাজমিন সুলতানার ‘ভালোবাসার অণুকাব্য’ এবং ‘মেঘ সমুদ্র ও পাহাড়ের হাতছানি’।
পেন্সিলর আরিফুজজামান শাহিন, কামরুল হাসান ও অমিত্র ভদ্র আমাদের এত সুন্দর আয়োজন সফল করার পেছনের কারিগর। খাদিজা পারভিন, শম্পা রহমান, ফরিদা ইয়াসমিন, মাসুম আহমেদ, দীপ্ত, নীহার সিদ্দিকী, রওশন হক, শিমু আফরোজ, কাজী জেবুন্নেসা, পলি শাহিনা, ভায়লা সালিনা, পপি বেগম, ফাল্গুনী, ইয়াসমিন মুক্তা, কামরুন্নাহার, রওশন হাসানসহ আরও অনেকের উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুষ্ঠানটি দীপ্তিময় করে তোলে। এসেছিলেন আরও অনেকে বহু দূর থেকে। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ছিল জমজমাট এ আয়োজন।