এবার গণমাধ্যমকে ব্যবহার

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন অভিবাসনবিরোধী পদক্ষেপ ক্রমাগত জোরদার করছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সরকারি পদক্ষেপের সমর্থনে অভিবাসীবিরোধী প্রচার। মূলত অবৈধ অভিবাসীদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচার করছে ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থক হিসেবে পরিচিত কিছু সংবাদমাধ্যম। সম্প্রতি ফক্স নিউজ এমনই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে বলা হয়েছে, অধিকাংশ অবৈধ অভিবাসীই সরকারি সহায়তা প্রকল্পগুলোর ওপর নির্ভরশীল, যার অর্থায়ন হয় করের টাকায়। করদাতাদের শত কোটি ডলার অবৈধ অভিবাসীদের জন্য ব্যয় হচ্ছে বলে দাবি করেছে সংবাদমাধ্যমটি।
ফক্স নিউজের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, করদাতাদের অর্থে পরিচালিত সরকারি সহায়তা তহবিলের ওপর নির্ভরশীল অধিকাংশ অবৈধ অভিবাসী।
মধ্য আমেরিকা অঞ্চল থেকে হাজার হাজার অবৈধ অভিবাসী আসছে, যাদের পকেটে একটি কানাকড়িও নেই। এই অবৈধ অভিবাসীরা তাহলে কীভাবে চলছে, এমন প্রশ্ন রেখেছেন ফক্স নিউজের সাংবাদিক উইলিয়াম লা জিউনিস।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি সপ্তাহে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন রেখেছে স্বঘোষিত অবৈধ অভিবাসীদের ২০২০ সালের আদমশুমারিতে গণনা করা হবে কিনা। বিভিন্ন শহর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কারণ তাদের মতে, যদি অবৈধ অভিবাসীদের আদমশুমারিতে গণনা করা না হয়, তাহলে প্রকৃতি জনসংখ্যার চেয়ে ৬৫ লাখ মানুষ হিসাবে কম আসবে। ফলে টান পড়বে তহবিলে। মূলত মধ্য আমেরিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের আসা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এ সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
ডানপন্থী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফেডারেশন ফর আমেরিকান ইমিগ্রেশন রিফর্মের (ফেয়ার) পরিচালক ড্যান স্টেইন বলেন, ‘আগামী কয়েক বছরে অবৈধ অভিবাসীদের জন্য সরকারি সহায়তা তহবিল বাবদ করদাতাদের কয়েক শ কোটি ডলার ব্যয় হবে। করদাতাদের অর্থের ওপর এটি একটি বিরাট চাপ, যা কোষাগারকে আরও সীমিত করবে।’
২০১৭ সালে ফেয়ার পরিচালিত আরেক গবেষণার তথ্যমতে, সরকারি সহায়তা প্রকল্পের ওপর নির্ভরশীল অবৈধ অভিবাসীদের পেছনে বছর ১০ হাজার কোটি ডলার ব্যয় হয়। এই ব্যয়ে অবৈধ অভিবাসী ঠেকাতে সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারের জন্য ব্যয়িত অর্থ অন্তর্ভুক্ত নয়।
আমেরিকার আবাসন ও নগর উন্নয়ন বিভাগের তথ্যমতে, ২৫ হাজারের বেশি অবৈধ অভিবাসী আবাসন ভর্তুকি গ্রহণ করে। তাদের সন্তানেরা বিনা মূল্যে শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খাবার ও শিক্ষা উপকরণ পায়। অবৈধ অভিবাসীরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার (ওবামাকেয়ার) আওতাধীন না হলেও ফেডারেল আইন অনুযায়ী যেকোনো হাসপাতাল তাদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দিতে বাধ্য। প্রসূতি সেবাও এর আওতায় পড়ে। এ বিষয়ে আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেডারেল-স্টেট ইমিগ্রান্ট প্রকল্পের আওতায় বছরে ব্যয় কয় ২০০ কোটি ডলার। সন্তান জন্মদানের জন্য দেওয়া সেবার ব্যয় ধরলে এ ক্ষেত্রে আরও ১২৪ কোটি ডলার যুক্ত হবে।
অবৈধ অভিবাসীরা স্ন্যাপ প্রকল্প নামে পরিচিত ফুড স্ট্যাম্প সুবিধা পান না। তবে যেসব অবৈধ অভিবাসী পরিবারে আমেরিকায় জন্ম নিয়েছে এমন শিশু রয়েছে, তারা এ সুবিধা পায়। সেন্টার ফর ইমিগ্রেশন স্টাডিজের গবেষণার তথ্যমতে, ৩১ শতাংশ অবৈধ অভিবাসী পরিবার স্ন্যাপ প্রকল্পের সুবিধা গ্রহণ করে। আর মধ্য আমেরিকা থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী পরিবারগুলোর ৫০ শতাংশই কোনো না কোনো সরকারি সহায়তা গ্রহণ করে।
ইমিগ্রেশন স্টাডিজের গবেষক ও সাবেক অভিবাসন আদালতের বিচারক আর্ট আর্থারের মতে, এই ব্যয়ের হিসাবটি পূর্ণাঙ্গভাবে তুলে ধরা অনেক কঠিন। কারণ অবৈধ অভিবাসীদের পেছনে করদাতাদের এই ব্যয়ের সঙ্গে শরণার্থীদের জন্য ব্যয়িত অর্থও যুক্ত করা জরুরি। শরণার্থীদের আমেরিকায় আসা থেকে শুরু করে আদালতে তাদের হাজির করতে মোটামুটি তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগে। এই সময়ের মধ্যে তরুণ শরণার্থীদের একটি বড় অংশই আমেরিকায় কোনো না কোনোভাবে তাদের ভিত গেড়ে বসে। একই সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি তহবিলের দ্বারস্থ হতে শুরু করে তারা।
এ ছাড়া ২৬টি অঙ্গরাজ্য নিজস্ব তহবিল থেকে অবৈধ অভিবাসীদের বিভিন্ন সহায়তা দেয়। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যই অবৈধ অভিবাসীদের মাসে ৩০০ ডলার করে নগদ সহায়তা দেয়। ১১টি অঙ্গরাজ্য বিনা মূল্যে বা ভর্তুকি মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেয়। ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য ৬৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী কিংবা অক্ষম অবৈধ অভিবাসীদের খাদ্য সহায়তা দেয়।
ফক্স নিউজের প্রতিবেদনে অবৈধ অভিবাসীদের জন্য সরকারি সহায়তা বাবদ অর্থের হিসাবই শুধু তুলে ধরা হয়নি। একই সঙ্গে অবৈধ অভিবাসীরা চাকরির বাজারে ভাগ বসাচ্ছে বলেও মন্তব্য করা হয়েছে, ঠিক যেমনটি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হরহামেশাই বলছেন ক্ষমতায় আসার পর থেকে। কিন্তু এই অবৈধ অভিবাসীরা আমেরিকার অর্থনীতিতে যে অবদান রাখছে, তার কথা সবিস্তারে তুলে ধরেনি। চাকরির বাজারে ভাগ বসাচ্ছে এমন তথ্য তুলে ধরলেও এটা উল্লেখ করেনি যে, অবৈধ অভিবাসীরা মূলত নিম্ন মজুরির কাজ করে থাকে, যা উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে মার্কিন ভোক্তাদের কম মূল্যে সেবা ও পণ্য পাওয়া নিশ্চিত করছে।
অবৈধ অভিবাসীরা একই সঙ্গে ভোক্তাও। ফলে তারা বিভিন্ন পণ্য ও সেবার চাহিদা সৃষ্টি করছে, যা আমেরিকার চাকরির বাজারে গতির সঞ্চার করছে। বিভিন্ন মাধ্যমে এই বৈধ-অবৈধ অভিবাসীরা বিরাট অঙ্কের কর দিচ্ছে আমেরিকাকে। ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ী বৈধ-অবৈধ অভিবাসীদের কাছ থেকে বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া করের অর্থের পরিমাণ ৩২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার, যা গত কয়েক বছরে নিঃসন্দেহে বেড়েছে। শুধু ড্রিমারস প্রকল্পের আওতায় থাকা এবং বর্তমানে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত অনিবন্ধিত তরুণ অভিবাসীরাই বছর দেড় শ কোটি ডলারের বেশি কর পরিশোধ করে।
অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যায় টান পড়লে বিপদে পড়বে মার্কিন অর্থনীতিই। কারণ ২০১৬ সালে আমেরিকান অ্যাকশন ফোরাম পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমেরিকার মোট শ্রমশক্তির ৫ দশমিক ৬ শতাংশই অবৈধ অভিবাসী। এই শ্রমশক্তির অনুপস্থিতি আমেরিকার উৎপাদনশীল খাতকে রীতিমতো বিপদে ফেলবে। আর চাকরির বাজারে ভাগ বসাচ্ছে এমন তথ্যকে খোদ ফেডারেল সরকারে তথ্যই খারিজ করে দেয়। কারণ ২০১৮ সালে প্রকাশিত ফেডারেল তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় বর্তমানে চাকরিপ্রার্থীর চেয়ে চাকরির সংখ্যা বেশি। ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ফক্স নিউজ মূলত প্রশাসনের অভিবাসনবিরোধী অবস্থানকে ন্যায্যতা দিতেই উদ্দেশ্যমূলকভাবে এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বলে মনে করছেন অভিবাসন আইনজীবীরা। তাদের মতে, খণ্ডিত তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসনবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনের লক্ষ্যেই এই সংবাদমাধ্যমগুলো কাজ করছে।