মানচিত্র আবিষ্কারের কথা

দুই হাজার বছরের আগের কথা। তখন ইউরোপের গ্রিসে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছে। সেখানকার মানুষ সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা, হলঘর, স্তম্ভ ইত্যাদি নির্মাণ করতে শিখেছেন। কিন্তু এত সব বানানোর জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং কলা-কৌশল শিখলেও তাঁদের জানা ছিল না পৃথিবীর আকার, আকৃতি ও আয়তনের প্রকৃত অবস্থা কী। তাঁরা তখনো জানতেন না পৃথিবীর কোন দেশ কোন জায়গায় অবস্থিত, মহাদেশগুলোর আকার কেমন, এসব সম্পর্কে তাঁদের কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। তাঁরা যে যার মতো নিজেদের দেশ নিয়েই ব্যস্ত।
তবে এ নিয়ে অন্যরা মাথা না-ঘামালেও পৃথিবীর আকার, আকৃতি, কোন দেশ কোথায় অবস্থিত ইত্যাদি নিয়ে একজন মানুষ ভাবতে শুরু করেছিলেন। তিনি অনুভব করলেন পৃথিবীর মানচিত্র থাকা খুবই প্রয়োজন। তাঁর কথা শুনে অনেকেই ঠাট্টা করতে লাগলেন। তাঁরা বলতে লাগলেন, এটা কী করে সম্ভব? এত বড় লম্বা গজ ফিতে কোথায় পাওয়া যাবে, যা দিয়ে পৃথিবী মেপে মানচিত্র বানানো সম্ভব? এত কঠিন মাপামাপিও সম্ভব হবে না এবং পৃথিবীর মানচিত্রও বানানো যাবে না। এ এক অবাস্তব কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।
কিন্তু এতেও তিনি থামলেন না। কারণ তিনি জানতেন, ভালো কাজে সমালোচনার অভাব হয় না। তিনি এই সমস্যা নিয়ে অনেক পড়াশোনা শুরু করে দিলেন। সে সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি ছিল মিসরের আলেকজান্দ্রিয়াতে। সেই লাইব্রেরিতে সাত লাখের বেশি বই ছিল। এ লাইব্রেরির দেখাশোনার দায়িত্বও এক সময় তাঁকেই দেওয়া হলো। তিনি দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে লাগলেন। মন দিয়ে পড়তে লাগলেন। লাইব্রেরির মোটা মোটা সব বই। যেহেতু তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান আর গণিতশাস্ত্রে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, তাই পড়তে পড়তে অনেক কিছুই বুঝে ফেললেন। অনেক সমস্যার সমাধানও পেয়ে গেলেন। পড়াশোনা ছাড়াও নানা দেশের বিভিন্ন পণ্ডিত ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনাও করলেন। অবশেষে বহু পরিশ্রমের পর তৈরি করলেন পৃথিবীর মানচিত্র। শুধু মানচিত্রই নয়, তিনি পৃথিবীর ব্যাস প্রায় নিখুঁতভাবে বের করতে সমর্থ হলেন। পৃথিবীর প্রকৃত ব্যাসের (৮০০০ মাইল) সঙ্গে তাঁর আবিষ্কারের (৭৮৫০ মাইল) পার্থক্য ছিল মাত্র ১৫০ মাইলের।
ওই ব্যক্তি যে মানচিত্র তৈরি করেছিলেন তাতে সবগুলো মহাদেশের অবস্থান চিহ্নিত করা ছিল না। আর সে সময়ে তা করা সম্ভবও ছিল না। কারণ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের কথা কলম্বাসের আগে আর কেউ জানতেন না। সে সময় অ্যান্টার্কটিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার কথাও কেউ জানতেন না। সে সময়ে এ মহাদেশগুলো সবার কাছে অজানা ছিল। সে কারণেই তাঁর বানানো মানচিত্রে দেখানো হয়েছিল ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশ। অবশ্য এ অসম্পূর্ণতার কারণে তাঁর কাজের গুরুত্ব মোটেই ম্লান হয়ে যায়নি। যে কোনো মহৎ কাজের সূচনাটাই সবচেয়ে বড় কথা এবং সেটি তিনি আমাদের জন্য করে গেছেন।
যে মহা পণ্ডিতের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বিশ্ববাসী আজ একটি মানচিত্র পেয়েছে, তাঁর নাম হলো এরাতোস্থেনিস। তাঁর জন্ম হয়েছিল আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ২৭৬ অব্দে এবং তিনি মারা যান আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৯৪ অব্দে।
এরাতোস্থেনিস যেভাবে মানচিত্র এঁকেছিলেন, তার সঙ্গে আজকের পৃথিবীর মানচিত্রে অনেক তফাৎ আছে। ছবি আঁকার ধরন ও মাপামাপির মধ্যে অনেক পার্থক্যই এর প্রধান কারণ। মানচিত্রের কথা আসলেই তাঁর কথা চিরকাল স্মরণ করা হবে। তাঁর এ সৃষ্টির জন্য তিনি আজও এ পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেনও।