গবেষণামুখী হতে হবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে

টাইমস হায়ার এডুকেশন সম্প্রতি উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে গবেষণা করে একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে এশিয়ার মোট ৪০১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে। কিন্তু এ দীর্ঘ তালিকায় কোনো বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। টাইমস হায়ার এডুকেশনের ২০১৯ সালের তালিকায় বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই দুশ্চিন্তার গাঢ় ভাঁজ তৈরি করেছে। এ দুশ্চিন্তা বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীরা তাহলে কী পড়ছে? তারা কিভাবে বাংলাদেশে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে?
টাইমস হায়ার এডুকেশন গত চার যুগ ধরে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে গবেষণা করে আসছে। প্রতি বছর এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ২০০-এর বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান নিয়ে গবেষণা করে তালিকা তৈরি করে। এ ক্ষেত্রে পাঁচটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে, শ্রেণিকক্ষে শেখার পরিবেশ, গবেষণা, গবেষণার প্রভাব, আন্তর্জাতিক মান ও প্রকৃত জ্ঞান আহরণ।
টাইমস হায়ার এডুকেশনের ২০১৯ সালের তালিকায় যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুপস্থিতির অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট না পড়ানো এবং ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ১ হাজারটি গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ না করা। বাংলাদেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়ানো হলেও বছরে গড়ে ১৫০টি গবেষণা হয় না। অবিশ্বাস্য তথ্যই বটে! আর যদি না হয় তাহলে বলতে হবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও গবেষণামুখী হতে হবে। বছরে গড়ে ১৫০টি গবেষণা করা কিন্তু বেশি কিছু নয়। ছাত্র বা ছাত্রী তো দূরের কথা, বছরে গড়ে ১৫০টি গবেষণা তো অধ্যাপকেরাই করতে পারেন। আমেরিকার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বছরে গড়ে ২-৪টি গবেষণা করতে হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫০ জনের বেশি শিক্ষক থাকে। তাঁরা গবেষণামুখী হলে প্রতি বছর প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধের সংখ্যা এমনিতেই বেড়ে যাবে। তাঁরাই পথ দেখাতে পারেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীর চিন্তাভাবনা নতুন ও
ভবিষ্যৎমুখী করতে হলে শিক্ষকদের গবেষণার বিকল্প নেই। পাশাপাশি শিক্ষকগণ তাঁদের গবেষণায় শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা গবেষণায় মনোযোগী নন। তাই এশিয়ার ৪০১টি তালিকাভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কোনো বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকার দায় শিক্ষকদেরই নিতে হবে। অতি সহজেই রাজনৈতিক প্রভাব বা অস্থিতিশীলতাকে আমরা দোষারোপ করি। কিন্তু আমাদের নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে যে, এর পেছনে আমাদের নিজেদের কী ভূমিকা রয়েছে? এটা সত্য যে, বাংলাদেশের শিক্ষা পরিবেশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বা অস্থিতিশীলতাই অধিকাংশ দায়ী। কিন্তু একই সঙ্গে এও ভাবতে হবে যে, এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে আমরা নিজেরা কতটা উদ্যোগী। শুরুতেই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোন শিক্ষার্থী যদি পড়াশোনায় ভালো না করে, তাহলে তাদের কোনো রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পাস করানো ঠিক হবে না। আপনি শিক্ষার্থীর কাছে যতটুকু আশা করবেন, তারা ততটুকুই দেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু শিক্ষকদের চাওয়া কম হলে শিক্ষার্থীরা ভালো করার স্পৃহা হারিয়ে ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নিয়ন্ত্রণে আনাটাও জরুরি। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা যেন ভবিষ্যতে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে, সে চেষ্টা শিক্ষকদেরই করতে হবে। যদি বাংলাদেশের শিক্ষকেরা সব সময় প্রতিকূলতাকেই দোষারোপ করেন, তাহলে বাংলার শিক্ষার্থীরা কখনোই এগোতে পারবে না।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক