পাগলা ঘণ্টার ডাক

কর্নেল (অব.) আবদুস সালাম বীর প্রতীক দলদলি চা বাগানের লেবার বস্তি থেকে একটু দূরে বরুণের ভাঙা ঘর দেখতে এসেছিলেন। বন্ধু ড. জিয়াউদ্দিন সাদেক অনুরোধ করেছিলেন বরুণের ভাঙা ঘর দেখতে।
ডা. সাদেক ফিলাডেলফিয়ার ডেক্সসেল ইউনিভার্সিটি অব মেডিসিনের অধ্যাপক। তাঁর সঙ্গে কর্নেল সালামের বন্ধুত্ব কৈশোর থেকে। ডা. সাদেক আমেরিকায় থাকেন। তাঁর মা অধ্যক্ষ হোসনে আরাসহ অন্য ভাই-বোনেরাও আমেরিকায় স্থায়ী হয়েছেন। কিন্তু দেশ ও দেশের মানুষ তাঁদের হৃদয়জুড়ে আছে।
এই যে বরুণের ভাঙা ঘর দেখতে এসেছেন কর্নেল সালাম, সেও আর কিছু না। বরুণের মাথা গোঁজার ঠাঁই মেরামত করতে ঠিক কত টাকা লাগতে পারে সেই ধারণা নিতেই এসেছেন।
কর্নেল সালাম বর্তমানে ঢাকায় বাস করেন। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ১৯৭৪ সালে কমিশন লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে কর্নেল হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
দলদলি হচ্ছে লাক্কাতুরা চা বাগানের একটি ফাঁড়ি বাগান। তাঁদের চৌকিদেখির বাসা লাক্কাতুরা চা বাগানের লাগোয়া।
সিলেট শহরের উত্তর-পূর্বাংশে শাহী ঈদগাহ থেকে এমসি কলেজমুখী সড়কের যেখানে টিবি হাসপাতাল তার ঠিক পাশেই দলদলি চা বাগানের লোহার গেট। গেটের পাশেই সিলেট সদর উপজেলার খেলার মাঠ। এই মাঠে খেলার চেয়ে মেলা হয় বেশি।
বাগানের রাস্তা ধরে কিছু দূর যেতেই নজরে এল একটি অভিজাত হাউজিংয়ের সীমানা প্রাচীর। প্রাচীরের ভেতর ডুপ্লেক্স বাড়ি। এক সময় এই জায়গাও চা-বাগানের ছিল। কর্নেল সালাম গাড়ি থেকে নামলেন। মাত্র দুই মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে তিনি শহরের মানুষদের থেকে ভিন্ন এক জীবনযাত্রার মুখোমুখি হয়েছেন।
বরুণের বাড়ির পথ দেখাতে ছুটে এলেন লেবার ইউনিয়নের সভাপতি মিন্টু দাস। বরুণকে কর্নেল সালাম শেষ কবে দেখেছেন মনে করতে পারছেন না। তবে বরুণের বাবা নকুলের কথা তাঁর মনে আছে।
ডা. জিয়াউদ্দিন সাদেকের হাউজিং এস্টেটের বাসায় গেলে দেখতেন নকুল বাগানে কাজ করছেন। জিয়াউদ্দিন সাদেকের পরিবারের সঙ্গে বরুণের পরিবারের সম্পর্ক প্রায় ৫০ বছরের। ১৯৬৭ সালে সিলেট জেলা পরিষদ যখন আবাসিক এলাকা তৈরি করে তখন সেই আবাসিক এলাকায় সাদেকের বাবা প্রফেসর ডা. শামসুদ্দিন আহমদ একটি প্লট কেনেন। সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের উত্তরে ও লাক্কাতুরা চা বাগান লাগোয়া মালিনীছড়া দক্ষিণ পাশে তৈরি করা এই আবাসিক এলাকায় তখনো ঘরবাড়ি তৈরি হয়নি। ডা. শামসুদ্দিন আহমেদের প্লটের পাশেই একখণ্ড জায়গায় ছিল নকুলের পরিবারের বসত। নকুল সেই বসতির দখল শামসুদ্দিনের কাছে বিক্রি করে লাক্কাতুরা চা বাগান এলাকার বাদামুড়ার দিকে চলে যান।
ডা. শামসুদ্দিন সেই প্লটে টিন শেড একতালা বাড়ি তোলেন। বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় বাগান করেন বেগম হোসনে আরা। নকুল সেই বাগানে কাজ করতে আসতেন। সেই নকুলের ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে মৃত্যু হয়।
১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল সিলেট মেডিকেল কলেজের শল্য বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. শামসুদ্দিন আহমেদকে কর্তব্যরত অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে। তাঁর সঙ্গে ডা. শ্যামল কান্তি লালাসহ আরও সাতজন নার্স ও কর্মচারী হাসপাতাল চত্বরে হত্যার স্বীকার হন।
নিরীহ নকুলও একই ভাবে চা-বাগান এলাকায় হত্যার স্বীকার হয়েছিলেন। সেই থেকে এই দুই শহীদ পরিবারের মধ্যে অন্য রকম এক বন্ধন গড়ে ওঠে। বেগম হোসনে আরা দুই ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে জীবনযুদ্ধ শুরু করেন। তিনি ছিলেন সিলেট এলাকা থেকে প্রথম নারী যিনি কলকাতায় গিয়ে এমএ পাস করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় সিলেট মহিলা কলেজ যাত্রা করে মাত্র ছয়জন ছাত্রী নিয়ে। তিনি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। নকুলের এক ছেলেকে তিনি মহিলা কলেজে অফিস সহকারীর চাকরি দেন। আর বরুণ তাঁর বাবা নকুলের স্থলাভিষিক্ত হন। আশির দশক থেকে এই পরিবারের সদস্যরা আমেরিকা নিবাসী হলেও বরুণের পরিবারকে নিয়মিত মাসোহারা দেওয়া হয়। বরুণ এখন চলাফেরা করতে পারেন না। পক্ষাঘাতগ্রস্ত। কিছুদিন আগে তাঁকে একটি হুইল চেয়ার দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁর বসত ঘরটি মেরামত করা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্নেল সালাম ছিলেন সরকারি জিন্নাহ (তিতুমির) কলেজছাত্র সংসদের প্রতিনিধি। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ৭ মার্চে পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভার পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে ছাত্রনেতাদের অনেকেই নিজ নিজ জেলা শহরে ফিরে আসেন। স্বাধীনতার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে সশস্ত্র যুদ্ধের গোপন প্রস্তুতি শুরু করেন। তাঁরা সে সময় গোপনে কাজিটুলার পেছনে কয়েক দিন সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নেন। জিন্দাবাজারের একটি বাসায় হাতে বানানো বোমা তৈরির সরঞ্জাম প্রস্তুত করেন। সে সময় ডা.দেলোয়ার, ডা. নজরুল ইসলাম, ডা. আহাদ ও ডা. জিয়াউদ্দিন সাদেকের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত বৈঠক হতো
২৫ মার্চের রাতে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে এমন এক গোপন বৈঠকের সময় খবর আসে পুলিশ লাইন ঘেরাও করে রেখেছে পাকিস্তানি বাহিনী। বাঙালি পুলিশদের থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সাহায্য দরকার। মিটিং থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যেকোনো ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার। রাত তখন ১১টা। নিস্তব্ধ শহরে কোথাও কেউ নেই। শহর থেকে প্রতিরোধ গড়তে না পেরে কর্নেল সালাম চৌকিদেখিতে ফিরে আসেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হামিদ মিয়ার পরামর্শে লাক্কাতুরা বাগানের পাগলা ঘণ্টি বাঁজাতে থাকেন।
পাগলা ঘণ্টি শুনে চা-শ্রমিকেরা তীর, ধনুক, বল্লম, দাঁ, লাঠিসোঁটা নিয়ে বেড় হয়ে আসে। ঘটনা শুনে সবাই স্লোগান দিতে দিতে ছুটে চলে। ভোর পাঁচটার দিকে মিছিল চৌহাট্টাতে সিভিল সার্জন অফিসের কাছে পৌঁছাতেই পাকিস্তানি আর্মির প্রতিরোধের মুখে পড়ে। বর্তমান মহিলা কলেজের সামনে থেকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি ছোড়ে। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কয়েকজন চা-শ্রমিক আহত হয়।
২৫ মার্চের পর কর্নেল সালাম ও তাঁর বন্ধুরা পালিয়ে থাকেন। ২৮ মার্চ কর্নেল সালাম, ডা. জিয়াউদ্দিন সাদেক, ডা. বুলু ও আনিস সশস্ত্র যুদ্ধে যোগ দিতে সিলেট থেকে বেরিয়ে পরেন। প্রথমে কর্নেল সালামের গ্রাম গোলাপগঞ্জের উত্তরভাগে রাত কাটিয়ে বিয়ানীবাজার-জকিগঞ্জ হয়ে ভারতের করিমগঞ্জ চলে যান। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে দুই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে তিন নম্বর সেক্টরের আশ্রমবাড়ি সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্নেল সালামকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে।
ড. জিয়াউদ্দিন সাদেক মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে জানতে পারেন তাঁর বাবা ডা. শামসুদ্দিন আহমেদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি সেক্টর কমান্ডার মেজর শফিউল্লাহর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে সিলেট শহরে পরিবারের কাছে ফিরে আসেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন কর্নেল সালাম। সিলেট ফিরে জানতে পারেন নকুলকেও পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করেছে।
কর্নেল সালাম বরুণের ভাঙা ঘর দেখতে থাকেন। এ সময় দশ-বারো বছর বয়সের একটি লাজুক ছেলে তাঁর পাশে দাঁড়ায়। সে তাঁর হাত ধরে বলে, ছাহেব হামার স্কুল ঘর একটু দেখবেন?
তিনি বলেন কোথায় তোমার স্কুল ঘর?
ছেলেটি আঙুল দিয়ে পাহাড়ের নিচে দেখায়। তিনি বরুণের খোঁজ-খবর নিতে থাকেন। বিদায় নিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় ছেলেটি আবার এসে দাঁড়ায়। চোখাচোখি হতেই সে আবার অনুরোধ করে স্কুল দেখার। তিনি গাড়িতে না ওঠে স্কুল দেখতে ছেলেটার সঙ্গে পা মেলান।
ছেলেটি একটি ভাঙা ঘরের সামনে তাঁকে নিয়ে আসে। ভেতরে শিশুদের কোলাহল। বাইরে ঝোলানো সাইনবোর্ডে লেখা ‘দলদলি চা-বাগান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্থাপিত: ১৯৭০ সাল।’ ভেতরে একটি কক্ষ। সেখানেই প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস হয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯০ জন। স্কুলটির দুরবস্থা দেখে তাঁর একমাত্র ছেলের স্কুলের কথা মনে হয়। তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান।
তাঁর কানে বাজতে থাকে ২৫ মার্চের সেই পাগলা ঘণ্টা। সেই ঘণ্টার ডাক শুনে স্বাধীনতার সংগ্রামে যোগ দিতে, মুক্তির সংগ্রামে যোগ দিতে এই চা-শ্রমিকেরা ছুটে এসেছিল তীর-ধনুক হাতে। শত শত কণ্ঠে রাতের নির্জনতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে স্লোগান দিয়েছিল ‘জয় বাংলা’। এর খেসারত দিতে হয়েছিল লাক্কাতুরা, মালিনীছড়া, তারাপুর, আলিবাহার, কেওয়াছড়া, কালাগুল, খাদিম ও দলদলি চা-বাগানের শত শত চা-শ্রমিককে। পাকিস্তানি বাহিনী চা-বাগানে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। নকুলের মৃত্যু হয়েছিল লাক্কাতুরা বাগানে। ৫০ বছরেও চা-শ্রমিকদের জীবনে অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি।