ব্রিটেনে বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ও দুটি ঐতিহাসিক স্থান

জানা ইতিহাস অনেক সময় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটেন, আমেরিকাসহ ইউরোপের বাঙালিদের অবদান এখন বিস্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। সে সময়ের বিদেশি বন্ধুদের অবদানও এমনি তলিয়ে যাচ্ছে। অথচ ৪৮ বছর আগে যারা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ এখনো বেঁচে আছেন। লন্ডনের বাংলাদেশ সেন্টারে সম্প্রতি তাঁদের বিশেষ সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।
ওই অনুষ্ঠানে সম্মাননা গ্রহণ করতে উপস্থিত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন, যারা ইতিহাসের সাক্ষী। আবার অনেকে হাসপাতালে থাকায়, অনেকে এই ইহলোকেই না থাকায় এতে যোগ দিতে পারেননি। তাঁদের হয় তাঁদের সন্তানেরা সম্মাননা গ্রহণ করেন ওই অনুষ্ঠানে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার কনস্যুলার (রাজনৈতিক) ড. শ্যামল কান্তি চৌধুরী ব্রিটেনে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের কথা বলেন। তাঁর কথার সূত্র ধরে বলতে হয়, এসব কাজ করার এখনই সময়। এখন সব দলিলপত্র সংরক্ষণ না করলে পরে এগুলো আর করা সম্ভব নাও হতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস লন্ডন থেকেই পরিচালিত হয়েছিল কূটনৈতিক তৎপরতা। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এই সংগ্রাম চলেছিল। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। তবে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কমিটিতে ছিলেন না। ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল কোভেন্ট্রিতে লন্ডনে শিক্ষক লুলু বিলকিস বানুর সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আজিজুল হক ভূঁইয়া, মনোয়ার হোসেন, শামসুর রহমান, শেখ আব্দুল মান্নান ও সিলেটের ড. কবির চৌধুরীকে সদস্য করে যুক্তরাজ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিই পরবর্তীকালে স্টিয়ারিং কমিটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন স্থানে যেসব অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়েছিল, তা পরে শাখা কমিটি হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। স্থানীয়ভাবে ট্রাফালগার স্কয়ার ও হাইড পার্কে জনসমাগমে এসব কমিটি বিরাট ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ ফান্ডে প্রবাসীরা চাঁদা দিয়েছিলেন, যা দেশ স্বাধীনের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
কোভেন্ট্রি সম্মেলনে কমিটি গঠনের সময় বেশ বেগ পেতে হয়েছিল উদ্যোক্তাদের। তারপরও কমিটি হওয়ার পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন সবাই। এই কমিটিকে সহযোগিতা করতে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতা গউস খানকে সভাপতি, মিনহাজ উদ্দিনকে সহসভাপতি ও ব্যারিস্টার শাখাওয়াত হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি সহযোগী কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী কমিটিতে না থাকলেও তাঁকে বাংলাদেশ সরকারের অফিশিয়াল প্রতিনিধি হিসেবে শিরোমণি করে রাখা হয়। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে আন্দোলন চলবে বল সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। লুলু বিলকিস বানুর সভাপতিত্বে ২১ নম্বর রোমিলি স্ট্রিটে স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ আব্দুল মান্নানের বাড়িতে স্টিয়ারিং কমিটির দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
হারুনুর রশীদ নামের এক ব্যক্তি তাঁর ব্যবসায়িক কার্যালয়টি কমিটির কাজে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে পাট রপ্তানির ব্যবসা করতেন। ১১ নম্বর গোরিং স্ট্রিট থেকেই শুরু হলো ব্রিটেন থেকে ফরেন ফ্রন্টের কূটনৈতিক যুদ্ধ। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য আজিজুল হক ভূঁইয়াকে কলকাতায় পাঠানো হলো। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের কাছ থেকে অস্ত্র কেনার অনুমতি আনার জন্য তাঁকে চিঠি দিয়ে পাঠানো হলো। তিনি প্রায় তিন মাস কলকাতা ও মুক্তিবাহিনীর শিবিরগুলো পরিদর্শন করেন। এই তিন মাস অফিস পরিচালনা করেন শেখ আব্দুল মান্নান। শেখ আব্দুল মান্নানকে কাজ করতে অনেক সময় ব্যয় করতে হতো। অনেক রাতে তাঁকে বাড়ি ফিরতে হতো।
১৯৭১ সালের জুন মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ টুডে নামে একটি মুখপত্র প্রকাশিত হলো। এক বাঙালি ব্যবসায়ী ফটোকপি মেশিন দান করেছিলেন এ কাজে। ১১ গোরিং স্ট্রিটের কার্যালয়টি একটি অস্থায়ী দূতাবাসে রূপ নিয়েছিল। তখন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আরও প্রশস্ত অফিসের প্রয়োজন অনুভব করলেন। কিন্তু তখন প্রোপার্টি কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ ছিল না বাংলাদেশ তহবিলে। আবার থাকলেও উপায় ছিল না। কারণ, বাংলাদেশ তহবিলের অর্থ প্রোপার্টি কিনতে ব্যয় করা যাবে না। এদিকে যেভাবে বিদেশি সমর্থন বাড়ছে, তাতে একটি দূতাবাস স্থাপন করলে স্বীকৃতি আদায় সহজ হতে পারে বলে মনে করলেন অনেকে। এ সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন এক বিদেশি, ডোনাল্ড চেজওয়ার্থ। তিনি পশ্চিম লন্ডনের ২৪ প্রেমব্রিজ গার্ডেনের একটি বাড়ির নিচতলার কয়েকটি ঘর নামমাত্র মূল্যে বাংলাদেশ দূতাবাসের জন্য ব্যবস্থা করে দিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি’ থেকে এসব তথ্য জানা যায়। আরও জানা যায়, এগুলোর ভাড়া ছিল মাসে মাত্র ১০০ পাউন্ড।
২৪ প্রেমব্রিজ গার্ডেন বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস। ১১ গোরিং স্ট্রিট থেকে ২৪ প্রেমব্রিজ গার্ডেনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। কলকাতার থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের আবাসিক অফিস ছিল। আর লন্ডনে ২৪ প্রেমব্রিজ গার্ডেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের দূতাবাস ছিল। এই ভবনটির ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। সব দেশ ও জাতি তাদের ইতিহাস ঐতিহ্য ধরে রাখে। অথচ ইজলিংটনে ইস্ট পাকিস্তান হাউস, পরে বাংলাদেশ ভবন সংস্কারের অভাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। পূর্ব লন্ডনের নজরুল সেন্টার, সাড়ে বায়ান্ন সেন্টার, বার্নার সেন্টার, ওয়েলফেয়ার ভবন একসময় কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে সরগরম থাকত। এখন এ সেন্টারগুলোও নিষ্প্রাণ। বাংলাদেশ সেন্টারও ছিল হুমকির মুখে। আশার কথা এই যে, বর্তমানে বাংলাদেশ সেন্টারের সংস্কারকাজ চলছে। সংস্কারকাজ শেষে যেন ভারতীয় বিদ্যা ভবন, নেহরু সেন্টারের মতো একটি কেন্দ্র হিসেবে এটি বেঁচে থাকে—এটাই প্রত্যাশা।