কিবি

কিবিকে সি অফ করতে রায়হান জেএফকেতে গিয়েছিল। কয়েক দিনে কিবির প্রতি আলাদা মায়া জমে গেছে। এখন মন খুব খারাপ তাদের। আসলে তার সাথেই বেশি ক্লোজ হয়েছিল। কাজ থেকে এলেই দৌড়ে এসে গা ঘেঁষে গড়াগড়ি খেত। দূর থেকে বসে পর্যবেক্ষণ করত কী করছে। কিবির খেলনা দিয়ে ওর কাছে ছুড়ে দিলেই, মুহূর্তে সুতা দিয়ে টেনে নিয়ে আসত। দারুণ জমে উঠত তাদের মধ্যে। তখন কাজ থেকে ফিরে আসার ক্লান্তি দূর হয়ে যেত।
সেদিন যাওয়ার বেলা কিবিকে ঘরের বাইরে নেওয়া যাচ্ছিল না। ছোট ছেলে সিমন অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছে। ছয় ঘণ্টা পর লস অ্যাঞ্জেলেস পৌঁছে কল দিল, চোখের জলে কিবি নাকি টাওয়েল ভিজিয়ে ফেলেছে!
মাত্র পনেরো দিনে এত মায়া! হবে হয়তো, ও তো কাউকে পায় না সেখানে। সিমন সেই সকালে অফিসে যায়, আর ফিরে রাতে। কিবির একাই দিন কাটে ঘরে। দু সপ্তাহ আগে তাকে নিয়ে আসায় তাদের যেন ঈদের আনন্দ লেগেছিল।
জেএফকে এয়ারপোর্টে সাড়ে এগারোটায় কিবি আসবে। কদিন ধরে ওর জন্য সুপার মার্কেট থেকে অনেক কেনাকাটা হচ্ছে।
-বাবা, দেখ ওর জন্য এই সব খাবার ও খেলনা কিনেছি। টয়লেটের জন্য আলাদা প্লাস্টিকের বড় ট্রে এখনো আনা হয়নি।
-ওর জন্য আবার খেলনা? মেয়ের দিকে তাকাল।
-হ্যাঁ, তুমি জানো না, ও যখন মুডে থাকে, খেলা খুব পছন্দ করে। ভাইয়া এগুলো আনতে বলল।
-মানি কে দিয়েছে? জিজ্ঞেস করতেই বলল ‘আমিই কিনেছি।’
ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ার উপলক্ষে ইউনিভার্সিটি এক মাস বন্ধ। কদিন আগে মেয়ে বাসায় এসেছে। সে উপলক্ষে ছেলে লস অ্যাঞ্জেলেস অফিস থেকে অতিরিক্ত ছুটি নিয়েছে। তিন সপ্তাহ তাদের সাথে থাকবে। আগেরবার কিবিকে রেখেই এসেছিল; কিন্তু তার মন পড়ে রইল সেখানেই। বারবার তাকে ফোনের রেকর্ডিং শোনাচ্ছিল।
-দেখ বাবা ও আমার জন্য কেমন করে কাঁদছে। রুমমেটও অনেক ভালোবাসে কিবিকে। তার কাছেই রেখে এসেছিল।
-এবার বোঝ তোমার জন্য আমাদের মন কেমন কেঁদে ওঠে। এক বছর পর এলে! আর দুদিন হলো না, কিবি তোমার জন্য ছটফট করছে। তোমার মনের অবস্থাও কিবির মতো।’ ছেলেকে রায়হান বলল।
সেবার থেকে সিমন পণ করেছে আর তাকে রেখে কোথাও যাবে না। কদিন আগে ভাইকে দেখার জন্য সিয়াটল গেল, সঙ্গে কিবি। এখন থেকে কিবিই যেন সব।
শীতের রাত। ছেলের জন্য জ্যাকেট নিয়ে গেল এয়ারপোর্টে। পাতলা সামার জ্যাকেট দিয়ে নিউইয়র্কের ঠান্ডায় পেরে উঠবে না। লস অ্যাঞ্জেলেসে ৭০/৭৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা। নিউইয়র্কে মাইনাস ৪/৫ ডিগ্রি। ক্যালিফোর্নিয়া তাই সবার পছন্দের স্টেট। কিবি কি অ্যাডজাস্ট করতে পারবে? রায়হান ও তার মেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ল।
ওর জন্য তো এয়ারপোর্টে কিছুই নেওয়া হয়নি। সিমন ফোনে বলল, ‘কিচ্ছু হবে না বাবা। কিবির জন্য সঙ্গে উষ্ণ টাওয়েল আছে।’
প্রথম প্রথম ছেলেকে আনতে গাড়ি পার্ক করেই ভেতরে অ্যরাইভালে গিয়ে অপেক্ষা করত। শুধু ক্যারি-অন ও একটা ল্যাপটপ থাকত তার সঙ্গে। ইদানীং ফ্লাই করার আগে বলে দেয়, ল্যান্ড করা মাত্রই যেন ফোন করে, ‘আমরা সেলফোন লট থেকে সোজা আউটসাইড অ্যারাইভালে দু মিনিটের মাথায় গাড়ি নিয়ে চলে আসব। শুধু শুধু পার্কিংয়ে ইজিপাসের বিল বাড়ানোর দরকার নেই।’
কল পাওয়ামাত্রই সেলফোন লট থেকে গাড়ি বের করে জেট ব্লু টার্মিনালের দিকে রওনা হলো। কিন্তু ডানে না গিয়ে বামে টার্ন দিয়ে বসল। ওভার কনফিডেন্সের জন্য খেসারত দিতে হয়। মুহূর্তেই বুঝে গেল ভুল করেছে।
-বাবা তুমি ভুল করেছ?
এত দিন ধরে এয়ারপোর্টে আসে, সাধারণত ভুল হয় না। ইদানীং জিপিএসের ওপর নির্ভরতা এত বেড়েছে যে, ডিভাইস ছাড়া চেনা রাস্তায়ও ভুল করে বসে। মনোযোগ একদমই নেই। এয়ারপোর্টে এক্সিট ভুল করলে অনেক সময় চলে যায় পুনরায় ঠিক ট্র্যাকে ফিরে আসতে। টার্মিনাল-৬ পৌঁছে দেখে সিমন শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।
-তোমাদের দেরি হলো যে বাবা! সিমন জানতে চাইল।
-সেলফোন লট থেকে বের হয়ে ভুল টার্ন দিয়ে ফেলেছিলাম। কিবি কোথায়?
-টাওয়েল দিয়ে ঢেকে রেখেছি, যদি ঠান্ডা লেগে যায়!
-তাড়াতাড়ি গাড়িতে ওঠো। কিবিকে নিয়ে সিমন গাড়িতে উঠল।
কিবি বিস্ময়ে অনুসন্ধানী চোখে তাকাচ্ছিল তাদের দিকে। খুব ক্লান্ত। এত দূরের জার্নি। মেয়ে তাকে ছুঁতে চাইল। খুশিতে আত্মহারা। ‘দেখ বাবা কিবি কত কিউট।’ যেন হাতে চাঁদ পাওয়া।
ছোটবেলা থেকে তাদের শখ ছিল ঘরে পেট রাখবে। থার্ড/ফোর্থ গ্রেডে থাকার সময় সিমন এমন জেদ ধরল, একটা পাপি অথবা ক্যাট আনতেই হবে। কয়েকবার পেট শপে গেল তারা। যেন সত্যিই কিনতে গেছে।
স্কুল শেষে সবাই মিলে একটার পর একটা পেট শপ ঘুরে দেখত। পছন্দ হয়নি এমন অজুহাতে শেষে ম্যাকডোনাল্ডে কিছু খেয়ে বাসায় ফিরে আসত। এটাই একটা রুটিন হয়ে গেল।
তবুও ভালো। কিছুতেই ছেলের কান্নাকাটি ও জেদ শেষ হচ্ছিল না। সিমনকে বলল, ‘অ্যাপার্টমেন্টে ডগ রাখা ঝামেলা। ওকে ছুঁলে নামাজ হবে না।’ কে কার কথা শোনে। পাপি তার চাই। ওর বন্ধুর পাপি আছে। স্কুল থেকে ফিরে ওকে নিয়ে খেলা করে। ওয়াকিং করায়। শেষমেশ আবদার, একটা হ্যাম্পস্টার নাও। শেষে হয়তো বুঝতে পেরেছে বাবা সময়ক্ষেপণ করছে মাত্র।
পড়ার চাপে একসময় ভুলে গেছে পেটের কথা। আজও রায়হানের খুব কষ্ট লাগে সেদিনের সময়ক্ষেপণের কথা মনে হলে। কিন্তু উপায় ছিল না, ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টের চারতলায় কুকুরের সেবাযত্ন করা চাট্টিখানি কথা নয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপার তো আছেই।
ছেলের গ্র্যাজুয়েশনের সময় সবাই লস অ্যাঞ্জেলেসে গেল। খুব নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসে প্রায় বেয়াল্লিশ হাজার স্টুডেন্টস। পরিবেশ গমগম করছে। সে এক অন্য জগৎ। স্থানীয় পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে ছেলের ভাব হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে গেল পাশের একটা শেল্টারে, যেখানে অনেক ডগ আছে। জার্মান শেফার্ড নিয়ে এল। তাকে আদর করে। চুমু খায়। ওর মা বলল, ‘ছি ছি, কুকুরকে কেউ চুমু খায়।’ রায়হানও ছেলের সাথে মাঝে মাঝে ডগকে ওয়াকিং করায়। সে এক অসাধারণ দৃশ্য।
ওর মা বলল, ‘ডগ রাখলে তোমার বাসায় আসব না।’ ভাই-বোন মিলে কি মহা আনন্দ, ডগকে হাঁটাচ্ছে তারা।
পূর্বের অনুশোচনা থেকেই রায়হান তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। হঠাৎ ডগ বিগড়ে গেলে সে ভয় পেয়ে যায়। এত বড় যে ওকে কন্ট্রোল করা প্রায় অসম্ভব। আরেকজন ট্রেইনড মহিলা এসে তাদের সাহায্য করে।
আজ সেই সুদূর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রিয় পেট বাসায় নিয়ে এসেছে। রুমে ঢুকে কিবিকে ছেড়ে দেয়। এদিক থেকে ওদিক যায়। খাঁচা থেকে বের হয়ে মুক্ত পরিবেশে আহ্লাদের শেষ নেই। লিটার বক্সে প্রয়োজনীয় কার্যসিদ্ধি শেষে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। খাবার শেষে টেবিলের নিচে এক কোনায় গিয়ে বসে পড়ল। কিন্তু ঘুমানোর জন্য নির্ধারিত স্থানে গিয়ে ঘুমাল না।
প্রথমদিকে ভিড়তে ইতস্তত করলেও শেষের দিকে তাদের সঙ্গে খেলা করার আগ্রহ বেড়ে যায়। দেখামাত্র দৌড়ে কাছে চলে আসে। ওকে নিয়ে চমৎকার সময় কেটে যাচ্ছিল। পায়ের কাছে এসে এমনভাবে গড়াগড়ি খেত, যেন মানব সন্তান। আস্তে করে খামচে ধরত। আদর পেতে অস্থির হয়ে যেত। হাত বুলিয়ে দেওয়ার পর টেবিলের নিচে গিয়ে বসে থাকত তাদের দিকে চোখ রেখে। কাজ থেকে ফিরলে দৌড়ে কাছে আসত। খুশিতে চার পা দিয়ে রায়হানের আঙুল ধরে মুখে পুরে দিত। হালকা করে দু পাশের দাঁত দিয়ে আলতো করে কামড় দিত। প্রথম দিকে ভয় পেয়েই গিয়েছিল, সত্যিই যদি কামড়ে বসে। এ রকম মানবিক বিড়াল দেখে বিস্ময়ের শেষ ছিল না তাদের।
মেয়ে বলল, ‘কিবির তো তোমার সঙ্গে ভাব হয়ে গেছে বাবা। ভাইয়া খুব চিন্তায় ছিল তোমাকে নিয়ে।’
একদিন দুপুরে কিবিকে পাওয়া যাচ্ছে না। তন্ন তন্ন করে সব রুমে খোঁজা হলো। কিবি নেই। কোথাও নেই। ছেলের মুখ একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ছেলেদের বেডরুমের জানালা সামান্য খোলা ছিল। সিমন বলল, ‘ওই ফাঁক দিয়েই কিবি নিচের দিকে জাম্প দিয়েছে। মেইন ডোর সব সময় বন্ধ থাকে। চারতলা থেকে নেমে নিচে অনেক খোঁজাখুঁজি করল। রাস্তায় গাড়ির নিচে চাপা পড়ে মারা গেল কিনা! না, কোথাও কোনো চিহ্নই নেই। ছেলের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।
-কিবির যদি কিছু হয় আর তোমাদের বাসায় আসব না, ছেলে সোজা মাকে বলে দিল।
-সামান্য একটা বিড়ালের জন্য বাবা-মাকে ছেড়ে দেবে! এত ইমোশনাল হয় না বাবা, আমরা না তোমাকে এত আদরযত্ন করে বড় করলাম। তাহলে তো আমরা মরে যাব, তার মা সিমনকে বলল।
আশ্চর্য, চোখের পলকে কিবি কোথায় হারিয়ে গেল! ছোট বেডরুমে বিছানার নিচে কিনা, আবারও খুঁজল, সেখানে নেই। মেইন বেডরুম অনেক জিনিসে ঠাসা, হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে, নেই। ভগ্ন হৃদয়ে লিভিং রুমে চুপচাপ সবাই বসে রইল। কী হতে পারে, বিরাট প্রশ্ন? সুদূর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এসে এভাবে উধাও! ছেলের মন তো খারাপ হবেই।
সিমন নিশ্চিত, ওদের বেডরুমের জানালা দিয়েই নিচে লাফ দিয়েছে। আহত হয়ে কোথাও হারিয়ে গেছে, অথবা মরে গেছে। মায়ের ওপর আবার রেগে গেল, ‘কেন উইন্ডো খোলা রেখেছিলে আম্মু?’
রায়হান ছেলেদের বেডরুমে নতুন করে খুঁজতে গেল। হঠাৎ বেডের নিচে এক জোড়া উজ্জ্বল চোখ দেখা যায়। সিমন এসে সাথে সাথেই বলল, ‘এই যে কিবি! কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
বেডের কোনায় লুকিয়ে আছে। অন্ধকারে দেখাই যাচ্ছিল না। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এবার কিবিকে চেইন দিয়ে বেঁধে টেবিলের পায়ের সাথে আটকে রাখা হল। ছেলে প্রথমে ধমকাল, তারপর আদর করল, চুমু খেল, ‘বলল এটা তোমার শাস্তি।’ লিভিং রুমও লক করে দিল যাতে কোন অবস্থাতেই বের না হতে পারে।
কিবির পরিণতি দেখে তাদের কষ্ট হচ্ছিল। মিউ মিউ করছিল বারবার। সিমনকে বলল, ‘কিবি কোথাও যাবে না, চেইন খুলে দাও।’
শুধু লিভিং রুম ও ছোট বেডরুমে এখন কিবির সীমাবদ্ধতা। যখন করিডর দিয়ে তারা বেডরুমে অথবা কিচেনে যেত, কিবি দৌড়ে এসে লিভিং রুমের কাচের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকত। খামচি দিয়ে চেষ্টা করত দরজা খুলে ফেলতে।
কিবি চলে যাওয়ার পর বাসায় ফিরে তাদের ঘরটা মনে হলো শূন্যতায় হাহাকার করছে। কদিনে পাল্টে গিয়েছিল ঘরের পরিবেশ। স্থপতি ছেলের অফিস থেকে ফিরে একাকিত্ব ঘোচানো এবং মানসিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে একটা পেট অপরিহার্য ছিল, বুঝতে কিছু সময় লেগেছিল তাদের। কিছুদিন আগে টিভির অনুষ্ঠানে দেখেছে সান ফ্রান্সেসকোতে আইটি প্রকৌশলীরা কাজের শেষে বাড়ির পেছনে মুরগির খামার বানিয়ে অবসর মুহূর্ত পার করে দেয় এদের সঙ্গে খেলা করতে করতে। এতে সারা দিনের ক্লান্তি কেটে যায় নাকি। অনেক দিন পরে রায়হান বুঝতে পারল এ দেশের মানুষ কেন পেট ছাড়া চলতে পারে না। ভিন্ন প্রজাতির হয়েও আত্মার বন্ধন কেমন করে যেন তাদের মধ্যে হয়ে যায়। তখন সুখেদুঃখে এই প্রাণীগুলো তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে পড়ে।