প্রজাপতি মন

চতুষ্কোণ বারান্দার লোহার নেটের ছিদ্র দিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত হলেই সবুজ ঘাসের দিঘল আচ্ছাদন। তার প্রান্তের সারি সারি চোরাকাঁটা বুঝিয়ে দেয়, এদিকে সচরাচর মানুষের পা পড়ে না। গ্রীষ্মের অলস দুপুরের মাদকতায় বড়রা ঘুমিয়ে পড়লে, এসে দাঁড়াই। বর্ণিল প্রজাপতিরা উড়ে উড়ে আসে, ঘাসে বসে। চোরাকাঁটাগুলোর সঙ্গে চুপি চুপি কথা বলে, আবার যায় উড়ে। প্রজাপতিরা রৌদ্রের প্রখরতায় মোটেও ক্লান্ত নয়। ঝিলমিল পাখা মেলে খেলায় মেতে থাকে। দূরে দুটি বালক পাটখড়ির আগায় আঠা লাগিয়ে ফড়িং ধরায় প্রচেষ্টারত। এসব দৃশ্য দেখছি। 

সংবিৎ ফিরে পেলাম পেছন থেকে মায়ের কাজের সহকর্মী শুকুরের মায়ের কথায়। ‘আফা ফড়িং নেবেন?’ ফড়িং!’ ফড়িং আমি কোথায় পাব? কে ধরে দেবে? শাকুরের মা দূরের বালকদের ডাক দিল, ‘অ্যাই এদিকে আসো তো।’ ডাক শুনে ওরা তাকায়। আস্তে আস্তে বারান্দার কাছে এল। ওরা তো কোনো অপরাধ করেনি। তবে কেন এত ভয়, এত সংকোচ। হয়তো ভেবেছিল কাঁটাতার ঘেরা মাঠে অনধিকার প্রবেশের অপরাধে ডাকা হচ্ছে।
সরকারি অফিসারের বাসার গৃহ পরিচারিকা যেন সাহেবি ভঙ্গিতে ঝাঁজালো কণ্ঠে হুকুম দিল, ‘অ্যাই, একটা ফড়িং দাও তো।’ ওরা বলল, এখনো ধরতে পারিনি। পেলে দেব।
সত্যিই কিছুক্ষণ পর একটা বড় ফড়িং এনে শাকুরের মার হাতে দিল। সে আমাকে ফড়িং ধরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছিল যত, ততই ভয়ে জোরে না না করছিলাম। পা কেমন কাঁটা কাঁটা। মাথাটা বাঁকা হয়ে আসে, যেন কামড় দিতে চায়। আম্মা ঘুম থেকে উঠে এসেছিলেন চিৎকার শুনে। এক সময় শাকুরের মা লম্বা সুতা দিয়ে পেছনটা বেঁধে দিয়ে সুতার অপর প্রান্ত আমার হাতে ধরিয়ে দিল। হেলিকপ্টারের মতো ফড়িং উড়ে যেতে চায় আকাশে।
ছেলেটি বলেছিল, এটা যেনতেন ফড়িং নয় রাজফড়িং। রাজফড়িং কী আমি বুঝি না। শাকুরের মা বুঝিয়ে দিল এটা ফড়িংয়ের রাজা, তাই দেখতে অনেক বড়। জীবনের প্রথম ফড়িং ধরার আনন্দ। কী দারুণ সুখানুভূতি! রাজফড়িং বাঁধা আমার হাতের প্রান্তে। দূর থেকে দেখেছি বহুদিন। আজ অপ্রত্যাশিতভাবে কাছে পেলাম সেই ছেলেটির জন্য। ছেলেটা বাইরে দাঁড়িয়ে দেখছিল আমার কাণ্ড। অমনি শাকুরের মা ধমক দেয়, ‘যাও যাও, চলে যাও।’ ওরা চলে যায়। সে আম্মার উদ্দেশে বলে, যা দুষ্টু ছেলে এইটা, বাপ মায়ের কোনো কথা শোনে না। কেমন ভর দুপুরে রোদে রোদে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ পাড়ার ডানপিটে ছেলে।
বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওরা বল দিয়ে সাতচারা খেলত মাঠে। মাঝে মাঝে বল ছুটে এসে গ্রিলে লাগত। অমনি বুয়ার ধমক, ‘খেলা বন্ধ করে বাসায় ফিরে যাও।’ কিছুক্ষণ বিরত থেকে আবার খেলা শুরু করে দিত। কী ক্ষিপ্র গতিতে ছুটত। কখনো ইচ্ছে করে কারও গায়ে বল ছুড়ে দিত। অমনি কাঁদতে কাঁদতে খেলার সঙ্গী মাঠ ছেড়ে চলে যেত। এ সব দেখতাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে।
সেই বারান্দার সীমানা পেরিয়ে তখনো একা মাঠে পা রাখিনি। অভিভাবকদের অনুমতি ছিল না। প্রয়োজন ও হতো না। বাসার ভেতর বিস্তর জায়গা। ভাইয়ারা বিকেলে মাঠে সাইকেল চালানো শিখত। অথচ একদিন দুপুরে মাঠে নেমে এসেছিলাম। সেই ছেলেটি আমার বারান্দার কাছে এসে বলল, পিঁপড়ের গান শুনবি? আমি হতচকিত হলাম এই প্রশ্নে। ওভাবে কেউ আমাকে তুই বলে সম্বোধন করে না সাধারণত। কিন্তু পিঁপড়ের গান? কী অদ্ভুত ব্যাপার! না জানি কত সুন্দর! এত দিনে তার ওপর আমার আস্থা গড়ে উঠেছিল একটু একটু করে। মনে হয়েছিল ওই ছেলেটা সবই পারে। কীভাবে জ্যান্ত ফড়িং ধরে এনে দেয়। বল নিয়ে কি দুর্দান্ত গতিতে ছোটে! সঙ্গীরা হেরে যায় ওর কাছে। পাশে রেলওয়ের এসডিওর বাসা। সেখানে হেলানো ঝুমকো জবা গাছ। গাছের জড়ানো দুটো ডালে শুয়ে শুয়ে গান ধরে কী সুন্দর। ও সবই পারে।
অত্যুৎসাহে কাউকে কিছু না বলেই দরজা খুলে ওর পিছু পিছু চলে এলাম মাঠে। বড় আম গাছের নিচে। জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী? সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, গিয়াস উদ্দিন।
ওর সঙ্গী প্রতিবাদ করে, ‘না না, ও গিয়াস।’ একটু দূরে একজন ডাক দিল, অ্যাই গিয়াস শোন।’ সে এগিয়ে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে ওর প্রতি কেমন যেন ধারণা জন্ম নিল সে মুহূর্তে। ও মিথ্যা বলে। গুরুতর অন্যায় করেও সত্য বললে বাসায় মাপ পাওয়া যেত কিন্তু সামান্য মিথ্যা বললে আর রক্ষা ছিল না। গিয়াস উদ্দিনের সংক্ষিপ্ত গিয়াস হতে পারে সে বয়সে তা বোঝার ক্ষমতা আমারও ছিল না। তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি মিথ্যে বললে কেন? তুমি তো গিয়াস। ও বলল, দুটোই আমার নাম।
যা হোক তবুও পিঁপড়ার গান শুনব। ফুলের কানে কানে মৌমাছিরা গান করে। রক্তের পিপাসায় মশারাও গান ধরে। খাবারের সুগন্ধিতে মাছিরা গুন গুন করে। আর পিঁপড়েরা? তারা কীভাবে গান করে। তাদের তো দেখেছি মিষ্টির সরোবরে আত্মোৎসর্গ করতে।
জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় পিঁপড়েরা গান করছে, শোনাও।
মাটিতে সামান্য গর্ত করেছে রেখেছে সে। গর্তের ভেতর একটা পাটকাঠি। তার ওপর এক টুকরো কাগজ। কাগজের ওপর ফেলে দেওয়া সিগারেটের তামাক বের করে ছিটিয়ে রেখেছে। ওটা দেখিয়ে বললে, এখানে পিঁপড়েরা গান করছে। চুপ করে শুনতে হবে। আস্তে বসলাম গর্তটার কাছে। কান পেতে থাকলাম গর্তটার দিকে।
গান তো দূরের কথা কোনো শব্দই শুনতে পেলাম না। সে বলল, শুনতে পাচ্ছিস? বললাম, না তো। উঠে দাঁড়ালাম। সে তার সঙ্গীকে সাক্ষী রেখে বলল, একটু আগেও আমরা শুনেছি, তাই না?
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, ওরা গান শুনতে পেল আমি পারলাম না। এবার বলল, কাগজের কাছে মুখ নিয়ে জোরে আ আ করে চিৎকার কর, মাটির নিচ থেকে পিঁপড়েরা চিৎকার দিয়ে গান শুরু করবে। আমি তাই করলাম। গর্তের ওপর মুখ নিয়ে আ-আ করছি উচ্চ স্বরে। এমন সময় ছেলেটি পাটকাঠির অপর প্রান্ত ধাক্কা দিল। গর্তের ভেতর পাটকাঠির ওপরে রাখা কাগজে তামাকের গুঁড়ো পুরোটাই আমার মুখে ঢুকে গেল। অমনি গলা আটকে ভীষণ কাশি। থুতু ফেলেও নিজেকে প্রকৃতিস্থ করতে পারছিলাম না। আর সেই দুষ্টু ছেলে ও তার সঙ্গীটির কি উল্লাস! পূর্ব পরিকল্পিত উপায়ে আমাকে বোকা বানিয়ে ওরা বিশ্ব জয়ের আনন্দ ভোগ করছিল। পকেট থেকে এক টুকরো পাটালি গুড় বের করে খেতে বলল। লজ্জায় দৌড়ে বাসায় ঢুকলাম। খুব রাগ হচ্ছিল। বুয়া ঠিকই বলেছিল, ও দুষ্টু ছেলে। সে মুহূর্তে বুয়াকে বললে ঠিকই ধরে কষে চপেটাঘাত দিত বসিয়ে। কিন্তু বাসার সবাই জেনে যেত। সেদিন বিনা অনুমতিতে বের হওয়ায় শাস্তি পাওয়ার ভয়ে কাউকে বলিনি। যা আজ নিঃসংকোচে বলছি। সেদিন সেই দুষ্টু ছেলেটার ওপর যতটা রাগ হয়েছিল তার চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছিল নিজের ওপর, নিজের বোকামির জন্য। কী অসম্ভব দুষ্টু বুদ্ধ ছিল তার মাথায়!
তারপর ওই স্থান থেকে বাবার বদলি। ঘুরেছি বহু দেশে দেশে। পেয়েছি বহু খেলার সঙ্গী, পাঠ্য সঙ্গী। বহু ঘটনা অঘটনার মধ্য দিয়ে সময় প্রবাহিত হয়েছে। ভুলেছি অনেক ঘটনা। তবুও হঠাৎ বাতাসে পরিচিত আমেজে পুরোনো কিছু স্মৃতি নিয়ে আসে মাঝে মাঝে। সে গিয়াস বা গিয়াস উদ্দিন যাই হোক না কেন। তার কাছে বোকা বনে যাওয়ার দুঃখ, লজ্জা, ক্ষোভের ঘটনাটুকু ছেলেবেলার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তার বদৌলতে প্রথম ফড়িং ধরার যে আনন্দ, তা এই জটিল জীবনে আর খুঁজে পাই না।
ঋতুচক্রের আবর্তে আবার এসেছে গ্রীষ্মকাল। বাতাবি লেবুর ফুল আর আমের মুকুলের মৌ মৌ গন্ধ বাতাসের গায়। এই অলস দীর্ঘ দুপুরে প্রজাপতি মন আমার উড়ে উড়ে যায় সেই সুদূর মধুময় মায়াবী অতীতে। তার রঙিন পাখা মেলে ধরে সেই খোলা সবুজ মাঠে। যেখানে রয়েছে সারি সারি চোরাকাঁটা। দৃষ্টি প্রসারিত হয় সেই লোহার নেটের ছিদ্র পথ দিয়ে। দেখতে পাই-সেই দুপুর, প্রজাপতি আর ফড়িংগুলো ঘাস ছুঁই ছুঁই খেলায় মগ্ন।
আর সেই আমি বারান্দায় নির্জন প্রহরে একা একা গাইছি-নাচছি-গাইছি। ‘উড়ে যাব ওই যে দূরে মেঘের দেশে, আজকে আমার মনের ময়ূর পাখা মেলেছে।’ ছন্দের তালে তালে ঘুরছি। আমার ছোট্ট ফ্রকের কুচিগুলো সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দোল খাচ্ছে আর বাতাসে ফুলে ফুলে উঠছে।