ভালো থাকুক মায়েরা

প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় দেবতাদের মা ‘রিয়া’ ও ‘কিবেলি’কে অর্চনার মধ্য দিয়ে মা দিবসের সূচনা হলেও বর্তমানে পুরো বিশ্বে প্রতিটি মায়ের জন্য এই দিবসটি পালন করা হয়। মাকে ভালোবাসতে বিশেষ কোনো দিনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু নানা ব্যস্ততা ও দায়বদ্ধতার ফাঁকে বছরে একটি দিন মাতৃত্বকে সম্মান জানাতে এবং সন্তানের সঙ্গে মায়ের সম্পর্ককে আরও মজবুত করতে বিশেষ এই দিনটি পালন করায় কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না। তবে কিছু ব্যাপার আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও, তা কতখানি স্বাভাবিক, সেটা ভাবার বিষয়।
সন্তানের কাছে মা দিবসে একজন মায়ের আশা বা আকাঙ্ক্ষা খুব বেশি কিছু নয়। মাকে মা বলে জড়িয়ে ধরা, একটা কার্ডে ছোট করে ধন্যবাদ লেখা, মা খেয়েছে কিনা জানতে চাওয়া, মায়ের জন্য কিছু ফুল বা ভাঙা চায়ের মগটি ফেলে নতুন একটি মগ কিনে আনা—এই তো যথেষ্ট। মায়েরা তো এতেই সুখী। কিন্তু সব মায়েরা কি সৌভাগ্যবতী হন? সব মায়েরা কি ‘মা দিবসে’ সন্তানকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেন? পারেন না। তার মানে, মা দিবস একদিকে যেমন মায়েদের চোখে সুখের জল আনে, তেমনি মায়েদের জন্য কষ্টও আনে বটে।
আনোয়ারা বেগম। বয়স ৭০-এর কাছাকাছি। গত ১২ বছর যাবৎ তিনি থাকেন মেয়ের কাছে নিউইয়র্কে। স্বভাবে শান্ত ও সংসারে মনোযোগী আনোয়ারা বেগম সারা জীবন সংসারের নানান আবদার মিটিয়েছেন মুখ বুজে। কখনো তিনি সন্তানদের সঙ্গে উচ্চবাক্যে কথা বলেননি। কখনো সয়ে যাওয়া ব্যথা প্রকাশ করেননি সন্তানদের সামনে। কত হাজারবার যে মিথ্যা বলেছেন তিনি শুধু নিজে না খেয়ে সন্তানদের মুখে প্রিয় খাবার তুলে দিতে! কত হাজারবার যে তিনি কৌশলে সামলে নিয়েছেন পরিস্থিতি শুধু সন্তানদের রক্ষা করতে! তবু শেষ রক্ষা তাঁর হয়নি, ১৯ বছরের যুবক সন্তানকে হত্যা করা হলো একদিন। বুকে পাথর বেঁধে তাও সয়ে গেলেন, সামলে নিলেন নিজেকে। আনোয়ারা বেগমের নব্বই পার করা মা প্রায় অর্ধেক জীবন কাটিয়েছেন তাঁর কাছে। নিউইয়র্ক পাড়ি দেওয়ার পর তাঁর মা গত হলেন। তিনি শেষ দেখা দেখতে পারলেন না। সে ব্যথাও সয়ে গেলেন নীরবে।
স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সবাই তাই ভাবেন। কিন্তু আসলেই কি সব সওয়া যায়? সব ক্ষতি কি মেনে নেওয়া যায়? আজ যখন মা দিবসে তাঁর নিউইয়র্কার মেয়ে তাঁকে দু হাতে সোনার বালা গড়িয়ে দেন, তখন তিনি কতটা খুশি থাকেন? মা দিবস কি তাকে শহীদ সন্তান ও নিজ মায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না? মা দিবসে মেয়ের কাছে পাওয়া উপহার নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘মা দিবস কি বুঝি না। মেয়ে তো আমারে সব সময় যত্ন করে। এতগুলা ডলার খরচ কইরা এগুলা কিনার দরকার আছে?’
বুঝতে পারলাম ‘মা দিবস’ একটি বিশেষ দিন হলেও তাঁর কাছে এই দিনটি বাড়তি কোনো মানে রাখে না। মা দিবস নিয়ে তাঁর ভাবনা জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘সবাই তো সবার মারে মা কইয়া ডাকে। এই দেশে আইয়া দেখলাম এই দিনে কত কি দেয় মারে। আমার পুলাডা বাঁইচা থাকলে তো আমারেও মা কইয়া ডাকত! আমার মা-ডা বাঁইচা থাকলে তো আমিও তারে কিছু দিতাম, যত্ন করতাম! মারে তো শেষ দেহাও দেখলাম না!’
আনোয়ারা বেগমের দুই মেয়ে নিউইয়র্ক থাকলেও বাকি সন্তানেরা থাকেন বাংলাদেশে। সবাই তাঁর প্রতি যত্নশীল বলে তিনি জানালেন। ফোনে রোজ কথা হয় তাদের সঙ্গে। ছেলে-বউ, নাতি-নাতনি সবাই যোগাযোগ রাখেন নিয়মিত। এক ফাঁকে জানতে চাইলাম, ‘মা দিবস এলেই কি তাদের খুব মনে পড়ে?’
তিনি একটু উদাস হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘মা দিবস বুঝি না। পুলার লাশ তো রোজই চোখে ভাসে! মারে তো রোজ মনে পড়ে। সবাইরে দেহি এই দিন খালি মা মা করে। টিভিতে খবরে দেহায়। রাস্তায় ফুল বেচে মাগোর জন্য। পুলাপানে ফুল কিনে। বিদেশি মাগুলান ফুল হাতে নিয়া রাস্তায় দেহি হাঁইটা যায় পুলা-মাইয়ার লগে। তহন কেমন জানি লাগে বুকের মইদ্যে।’
আনোয়ারা বেগম শুধু একমাত্র মা নন, যিনি ‘মা দিবসে’ এলেই উদাস হন। এমন অগণিত মা রয়েছেন আমাদের মাঝে, যারা ভালো থেকেও এই দিনটিতে বুক ভাঙা নিশ্বাস ফেলেন। অনেক মায়েদের মতো তাঁরা আনন্দ-উল্লাসে ‘মা দিবস’ উদ্‌যাপন করতে পারেন না। তাঁরা কেউ শহীদের মা, কেউ অভাগা মা, কেউ বা সন্তান হারা দুঃখী মা।
গেল বছরের কথা মনে পড়ল। মাতৃত্বের সম্মানে যখন পুরো বিশ্বে মা দিবস পালিত হচ্ছিল, তখন প্রিয় ছেলে সন্তান ও পুত্রবধূর মধ্যযুগীয় নির্যাতনের শিকার এক হতভাগিনী মা কিশোরগঞ্জের ভাগলপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক ওয়ার্ড কাতরাচ্ছিলেন অসহ্য যন্ত্রণায়। বুক ভাসাচ্ছিলেন চোখের জলে। তিন মেয়েকে বঞ্চিত করে সম্পত্তি লিখে দিতে রাজি না হওয়ায় একমাত্র ছেলে ও তার স্ত্রী বর্বরোচিত নির্যাতনে ষাটোর্ধ্ব আম্বিয়া খাতুনের ডান হাতের হাড় চূর্ণ করে দেয়। মাথায় গভীর জখম করে, চারটি দাঁতও ভেঙে দেয়। খবরটি এসেছিল গত বছর ১৪ মে যুগান্তর পত্রিকায়।
আমাদের সমাজে সন্তান দ্বারা নির্যাতিত আম্বিয়া খাতুনদের অভাব নেই। তাঁদের জন্য ‘মা দিবস’ কোনো ‌অর্থ বহন করে না। তাঁদের কাছে বেঁচে থাকাটাই যেন অনেক। আমাদের আশপাশে আনোয়ারা বেগমের মতো শহীদ জননীদের কমতি নেই। তাঁদের কাছে ‘মা দিবস’ মানে চোখের জলে কিছু স্মৃতিচারণ।
‘মা’ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আর মায়ের কাছে ‘সন্তান’ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ। প্রতিটি মা ভালোবাসা ও মমতার চাদরে জড়িয়ে সন্তানকে লালন করেন। নিজে না খেয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেন। সন্তানের জন্য মায়ের মমতা শুধু মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান নয়, পশুদের মধ্যেও লক্ষণীয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি এলাকায় চার কুকুর শাবককে স্তন্যপান করাচ্ছে একটি ‘মা’ গরু। জানা গিয়েছিল যে, ওই কুকুর শাবকদের মা গাড়ি চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। তারপর ঠান্ডায় অনাথ হয়ে পড়ে চারটি শাবক। তখনই এগিয়ে আসে আরেক ‘মা’ গরু। গরুর স্তন্যপান করেই সুস্থ হয় চারটি কুকুর ছানা।
এটাই মা। হোক মানুষ বা পশু। মায়ের মাতৃত্ব ও ভালোবাসা অসীম। আর সেই মায়ের প্রতি সামান্য কৃতজ্ঞতা জমা থাকুক প্রতিটি সন্তানের হৃদয়ে। প্রতিটি মায়ের বুকজুড়ে ঘিরে থাকুক তার প্রিয় সন্তানেরা। ‘মা দিবস’ হোক সব মায়ের জন্য বিশেষ একটি দিন। ‘মা দিবস’ হোক প্রতিটি মায়ের মুখে হাসি ফুটানোর অঙ্গীকার। ভালো থাকুক আমাদের মায়েরা।