বুদ্ধ পূর্ণিমার আলোকে বিশ্বমৈত্রী

এ বছর শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা ১৩ মে। বিশ্বের বৌদ্ধদের জন্য এক মহাপবিত্র ও সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন। বৈশাখী পূর্ণিমার পুণ্য তিথিতে তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধের জীবনের ত্রি–স্মৃতি বিজড়িত এই মহোৎসবের দিনকে ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথায় উদ্‌যাপনের ব্যাপক প্রস্তুতি থাকে বিশ্বের প্রতিটি বৌদ্ধের ঘর, বৌদ্ধমন্দির ও উপাসনালয়ে।
আজ থেকে ২ হাজার ৬৪২ বছর আগে ভারতবর্ষের হিমালয়ের পাদদেশে বৈশাখী পূর্ণিমার পুণ্যস্নাত এই দিনে রাজ ঐশ্বর্যে, বিত্তবৈভবে কাপিলাবস্তুর রাজপুত্র হিসেবে অলোকসামান্য এক শিশুর জন্ম হয়। রাজা শুদ্ধধন পুত্রের নাম রাখেন সিদ্ধার্থ গৌতম। যৌবনের প্রারম্ভে নগর পরিভ্রমণে জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর বাস্তব চিত্র দেখে রাজনন্দন শিহরিত হলেন। এই জাগতিক দুঃখ-কষ্টের চিরন্তন সত্যের অনিবার্য রূপ তাঁর মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিল। একদিন গভীর রাতে নিজ রাজ্য, মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে পড়লেন জন্ম-জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর রহস্যের সন্ধানে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বহু সাধক, সাধু-সন্ন্যাসীর সান্নিধ্যে এসেও বাঞ্চিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেন না। অবশেষে ভারতের বিহার রাজ্যের গয়ার নৈরঞ্জনা নদীর কুলবেষ্টিত সবুজ অরণ্যে অশ্বত্থ বৃক্ষের নিচে বিশ্বজগতে জন্ম-জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর হাত থেকে মানুষের মুক্তির পথ অন্বেষণে দীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনার মাধ্যমে বুদ্ধত্ব লাভ করলেন, হলেন মহাজ্ঞানী সম্যক সম্বুদ্ধ। সেই দিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমার পুণ্য তিথি। কঠোর ধ্যান সাধনায় লব্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে জগতের অনিত্যতা সম্পর্কে তিনি সম্যকরূপে জ্ঞাত হলেন। পরে ভিক্ষুসংঘের মধ্যে অনেকবার তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ বলেছেন, ‘এই সংসার থেকে মুক্তিলাভ করতে গেলে নির্বাণ বা পরম নিবৃত্তি লাভই একান্ত সুখ। মানুষের সব দুঃখের মূলে রয়েছে অবিদ্যা, তৃষ্ণা ও মায়ার বন্ধন। তৃষ্ণার ফলে মানুষ জন্ম-জন্মান্তরের আবর্তে ঘুরে বেড়ায়। পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করে। সেটা আরও দুঃখজনক। জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, প্রিয়জন বিয়োগ ও অপ্রিয় সংযোগ প্রভৃতি দুঃখে পরিপূর্ণ এই জগৎ-সংসার। বলা যায় এ জগৎ দুঃখময়।’ এখানে সুখ বা আনন্দের স্থায়িত্ব কোথায়? এ জন্য বুদ্ধ সমস্ত তৃষ্ণার মূলে কুঠারাঘাত করে নির্বাণ শান্তি লাভের কথা বলেছেন।
বৌদ্ধদর্শন ও চেতনার মূল কথা হলো ত্যাগ ও সংযম। ত্যাগের স্বাভাবিক পরিণতিতেই আসে সংযম। দেহে-মনে কথায় ও কাজে যখন এই ত্যাগ ও সংযমের সমন্বয় ঘটে, তখনই মনের মধ্যে ব্রহ্ম চেতনা জাগ্রত হয়। জগতের অনিত্যতার রূপ তখন উপেক্ষা পারমিতে রূপান্তরিত হয়। কায়মনোবাক্যে চিন্তায়-চেতনায় যখন বিমুক্তি ভাব উদয় হবে, তখনই নির্বাণের পথ প্রশস্ত হবে। সংযমের অপূর্ব মহিমা বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জীবনধারা দেখলেই বোঝা যায়। এই সংযম থেকেই সর্বত্যাগী গৈরিক সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ।
মানুষের আত্মশক্তিকেই বৌদ্ধদর্শনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মে বলা আছে ‘কর্মই ধর্ম’। কর্মে ও প্রয়াসে যার ওপর সুবিবেকের নিয়ন্ত্রণ থাকে, সে-ই আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়। যুদ্ধে হাজারো মানুষকে জয় না করে, যিনি কেবল নিজেকে জয় করেন, তিনি শ্রেষ্ঠ সংগ্রামজয়ী। আত্মজয়ের এই মহিমা যে ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে প্রবল, তিনি অনায়াসে অন্যকে অহিংসা, করুণা, মায়া-মমতায় মৈত্রীর নির্মল পরশে জয় করতে সক্ষম হন। বুদ্ধ মানুষের কর্মের মধ্যেই মানবতার শ্রেষ্ঠ মহিমা উপলব্ধি করতেন। অন্য ধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের এখানেই তফাৎ। অন্য ধর্ম ও দর্শনে যেখানে ঈশ্বরের কৃতিত্ব ও মহিমাকেই সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়েছে, বুদ্ধ সেখানে মানুষের আত্মশক্তি ও বিকাশ ক্ষমতাকে দিয়েছেন সর্বাধিক মর্যাদা। তাঁর মতে, মানুষ আত্মশক্তির বলেই পূর্ণতা লাভ করতে পারে, এর জন্য ঐশ্বরিক করুণা বা সহায়তার প্রয়োজন হয় না।
বুদ্ধের জীবনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৈত্রী, করুণা সম্পর্কে অভিনব উপলব্ধির প্রকাশ লক্ষ করা যায়। মানুষের আত্মমর্যাদাবোধের সম্মানে যেন আঘাত না আসে, সেদিকে বিশেষ লক্ষ রাখার কথা বলেছেন তিনি। কাউকে ছোট করে কেউ বড় হতে পারে না। যেখানে মৈত্রী, করুণা, মমতা, ভালোবাসা থাকে না, সেখানে মনুষ্যত্ববোধের বোধনমন্ত্র জাগ্রত হয় না। বুদ্ধের লক্ষ্যই ছিল মানুষে-মানুষে অনির্বচনীয় আনন্দলোক প্রাপ্তি। সেই আনন্দের বর্ণছটা যেন মানুষ ও অন্য প্রাণিকুলেও ছড়িয়ে পড়ে, তা-ই বুদ্ধের উদাত্ত আহ্বানে ধ্বনিত হয় জগতের সব প্রাণীর সুখ ও মঙ্গল কামনায়। কিন্তু মনের মধ্যে অহংবোধ থাকলে সেই মঙ্গল ও আনন্দ কখনো লাভ করা যায় না। তিনি বাসনা বিলুপ্তির কথা বলেছেন বারবার। নিজেকে লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে রেখে সব প্রাণীর কল্যাণ চিন্তায় নিমগ্ন থাকতে বলেছেন। এই ব্যাপারে ত্রিপিটকের সুত্তনিপাতের করণীয় মৈত্রী সূত্রের একটি অংশ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য—
‘মাতা যথা নিয়াং পুত্তং আয়ুসা এক পুত্তমনুরক্খে
এবম্পি সব্বেভূতেসু মানসম্ভাবয়ে অপরিমাণং’
করুণার ক্ষেত্রেও আমরা একই ভাবাদর্শ অনুসরণ করি। ভাবনায় বলা হয়েছে, পরের সুখে সুখী ও পরের দুঃখে দুঃখী হতে হবে। সুখ ও দুঃখে নির্বিকার থাকা অবস্থার নাম হলো উপেক্ষা। বুদ্ধ দুঃখের নিরোধের উপায় নির্ণয় করতে গিয়ে একেবারে মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। তাঁর মতে, প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতির আলোকে দেখা যায়, অবিদ্যার ক্ষয় থেকে সংস্কারের, সংস্কারের ক্ষয় থেকে বিজ্ঞানের ক্ষয়। আবার বিজ্ঞানের ক্ষয়ে নামরূপের ক্ষয়, আর নামরূপের ক্ষয় হলে ছয় আয়তনের ক্ষয়। এভাবে স্পর্শের ক্ষয়। পরিশেষে এসব উপাদান পরম্পরার ক্ষয় হলে আর জন্ম নেই, জরা নেই, ব্যাধি নেই, মৃত্যু নেই। এখানেই সকল দুঃখের পরিসমাপ্তি বা নিবৃত্তি ঘটে। নির্বাণের দ্বার প্রশস্ত হয়।
চতুর্বর্গ সত্যের মধ্যে প্রথম সত্যটি হলো মৃত্যু। বুদ্ধ বলেছেন, সংসার যেন এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড। এখানে প্রতিনিয়ত দুঃখের আগুন ধিকধিক করে জ্বলছে। জরা, ব্যাধি, মৃত্যুর হাত থেকে কারও রক্ষা নেই। সবারই একদিন মৃত্যু আসবে। কাজেই মৃত্যুর জন্য বিলাপ করা বৃথা। জীবের পক্ষে জীবন ও মৃত্যু—দুটিরই সমান গুরুত্ব আছে। রবীন্দ্রচেতনায়ও জীবন ও মৃত্যুকে স্বীকৃতি জানিয়ে ব্যক্ত হয়েছে সত্যের কঠিন উচ্চারণ—‘মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান।’
জীবন ও মৃত্যুকে এই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সত্যরূপে দেখতে পেয়ে সমগ্র জীবন ধরে মৃত্যুকে জীবনের মতোই তিনি ভালোবেসেছেন। মানুষকে সমস্ত জগতের প্রতি বাধাশূন্য, হিংসাশূন্য, শত্রুতাশূন্য মানসে অপরিমাণ মৈত্রী পোষণ করতে উপদেশ দিয়েছেন তথাগত বুদ্ধ। দাঁড়াতে, বসতে, শুতে, যাবৎ নিদ্রিত না হবে, মৈত্রী বন্ধনে অধিষ্ঠিত থাকার যে ব্রহ্মবিহার তাকে জয় করে নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। অপরিমাণ মৈত্রী ও প্রেমেই মানুষ প্রকাশ করে অন্তরের অনির্বাণ সত্যকে। সেই সত্যিতেই একদিন বিশ্বমৈত্রীর স্বর্ণদ্বার উন্মোচিত হবে। ঘুচে যাবে মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ। বিভেদ-বিচ্ছেদ-বিভাজন ও হিংসার যবনিকা টেনে পরস্পরে বিশ্বমৈত্রীর জয়পতাকা ওড়াবে একদিন।
শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমার পুণ্যময় দিনে আমাদের প্রার্থনা হোক বিশ্বশান্তি ও মৈত্রীর। জয় হোক বিশ্বমানবতার। জগতের সব প্রাণী সুখী হোক।