কমিউনিটির অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখুক প্রথম আলো

আধপেটা খেয়ে ছাত্র পড়ানো শিক্ষকের গল্প আমরা সবাই শুনেছি। কিন্তু কষ্টেসৃষ্টে, টানাপোড়েনে থেকে পত্রিকা সম্পাদনা করে চলা সম্পাদকের গল্প ততটা প্রচলিত নয়। শিক্ষকতার মতোই সাংবাদিকতা ও পত্রিকা সম্পাদনা যে নিছক পেশা ছিল না, বরং সমাজের একটি মহান ব্রত ছিল সেটা, এই বাজার অর্থনীতিতে তা বোঝানো কঠিন। কিন্তু অর্থের টানাটানির মধ্যেও প্রগাঢ় জ্ঞান, আদর্শ আর কর্তব্যনিষ্ঠা—এই নিয়েই বাংলা পত্রপত্রিকার সম্পাদনা করেছেন একসময়ের সম্পাদকেরা। তাই বাংলা সমাজ প্রগতি ও তথাকথিত রেনেসাঁর এই পত্রিকাগুলো ও তাদের সম্পাদকদের অবদান অস্বীকার করার নয়। যদিও সম্পাদক হিসেবে অনেকেই ইতিহাসে পরিচিতি পাননি। 

এই ডিজিটাল যুগে কেউ হয়তো পত্রিকা সম্পাদনার এই ইতিহাসের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকতে পারেন। কিন্তু কেবল মুদ্রণ কিংবা ডিজিটাল মাধ্যমের টেকনিক্যাল মুখ্য বিষয় নয়, সম্পাদনা কাজে যে প্রগাঢ় জ্ঞান, আদর্শগত দৃঢ়তা, বাণিজ্যিক লাভের উদ্দেশ্যে ভেসে না গিয়ে মেরুদণ্ড সোজা রেখে সত্য ও উৎকর্ষের সন্ধানে ব্রতী থাকার নিষ্ঠার প্রয়োজন হয়, এটা সেই সজীব বিষয়। এই ইতিহাস তাই আজও প্রাসঙ্গিক। চারদিকে যখন করপোরেট ও বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকার দাপটে সংবাদ ও সাহিত্যের মূল্যমান নির্ধারিত হচ্ছে, তখন হয়তো এটি আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক।
তাই সংবাদ কী, সেটি শেখানোর জন্য সাংবাদিকতার শিক্ষকেরা প্রায়ই একটা কথা বলে থাকেন। সংবাদ হলো এমন কোনো তথ্য, যার প্রকাশে সর্বদাই সমাজের কোনো না কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আপত্তি থাকে। এমন তথ্য প্রচারই সাংবাদিকতা, বাকি যা কিছু, সবই হলো বিজ্ঞাপনী প্রচার। কথাটা সেই সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত একইভাবে সত্যি।
পাঠক, ওপরের ভূমিকাটি মূলত নিউইয়র্কে প্রকাশিত বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িকী নিয়ে কিছু বলার উদ্দেশ্য থেকে। নিউইয়র্কে সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকার সংখ্যা এখন নিদেনপক্ষে ১৫ থেকে ১৬টি। একসময় এ সংখ্যা আরও বেশি ছিল। মাঝেমধ্যে কোনো কোনোটির অকালমৃত্যুর কারণে আপাত এই সংখ্যা। সম্প্রতি ঢাকার দুটি দৈনিক পত্রিকা নিউইয়র্কে তাদের সাপ্তাহিক সংস্করণ প্রকাশের মাধ্যমে এখানকার সাপ্তাহিকের মিছিলে যুক্ত হয়েছে। অবশ্য স্থানীয় পত্রিকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই দুই পত্রিকার যুক্ত হওয়াকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি বলেই মনে হয়। সম্ভবত, পত্রিকা দুটি টিকে থাকার ক্ষেত্রে তাদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতাই ঈর্ষার কারণ।
তবে সব পত্রিকাই নাকি কমিউনিটির সেবায় নিবেদিত বলে দাবি করে থাকে। আর তাই বিনা পয়সায় পাঠকের কাছে বিলি-বণ্টন করা হয়। ফলে কোন পত্রিকার প্রচারসংখ্যা কত, অনুমান করে নিতে হয়। যদিও অনেকেই নিজেদের পত্রিকাকে বহুল প্রচারিত বলে দাবি করে থাকেন। আমার লেখার প্রতিপাদ্য সেটা নয়। আমার এক অনুজপ্রতিম বন্ধু ইব্রাহিম চৌধুরী ঢাকার পত্রিকা প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক। তাঁকে উপলক্ষ করেই এই লেখা।
ইব্রাহিম চৌধুরীর সাংবাদিকতার শুরু দৈনিক আজকের কাগজ–এর মাধ্যমে। ১৯৯০–৯১ সাল পর্যন্ত সিলেট প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। তারপর ১৯৯৫ সালে চলে আসেন আমেরিকায়। আমেরিকায় আসার পর দেশে এবং মাঝেমধ্যে অনিয়মিতভাবে স্থানীয় পত্রিকায় লিখতেন। ২০০২ সাল থেকে দৈনিক প্রথম আলোয় উত্তর আমেরিকার প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। ২০১৭ সালে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত হন। গত ২৬ মার্চ পত্রিকাটি তিন বছরে পা দিয়েছে।
ইব্রাহিম চৌধুরীকে দেশে থেকেই জানি ও চিনি। একজন সামাজিক অ্যাকটিভিস্ট হিসেবে দেখে এসেছি। পরে পরিচিত হয়েছি পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখনীর সঙ্গে। নিউইয়র্কের স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে দেশের লেখকদেরই প্রাধান্য দেওয়া হতো বেশি। স্থানীয় লেখকের সংখ্যাও তেমন ছিল না। গুটি কয়েক লেখক অনিয়মিত লিখতেন। ইব্রাহিম চৌধুরী তাঁদের একজন। মাঝেমধ্যে তাঁর অনিয়মিত লেখা দৃষ্টি আকর্ষণ করত। লেখার মধ্যে স্বকীয়তা ও সামাজিক বাস্তবতার প্রকাশ লক্ষ করতাম। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সম্পর্কের কাছাকাছি হয়েছি। যদিও আগে থেকেই চেনা–জানার সম্পর্ক। বিশেষ করে পত্রিকা অফিস জ্যামাইকা থেকে জ্যাকসন হাইটসে স্থানান্তরিত হওয়ার পর লেখক-লেখিকাদের একটি আড্ডার জায়গা তৈরি করে। সেই আড্ডায় আমিও মাঝেমধ্যে শরিক হওয়ার চেষ্টা করি। এ উদ্যোগ ও কৃতিত্ব অবশ্যই ইব্রাহিম চৌধুরীর। সেই আড্ডায় স্থানীয় লেখক-লেখিকাদের পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার একটা প্রচেষ্টা লক্ষ করি। এর মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে কবি-সাহিত্যিক-লেখকদের একটি গ্রুপ গড়ে উঠেছে। পত্রিকার বিভিন্ন বিভাগ সমৃদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে এই উদ্যোগের লক্ষ্য অব্যর্থ।
সংবাদপত্র সমাজ ও সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ হবে—এটাই স্বাভাবিক। কেননা, দায়বদ্ধতা সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের পূর্ব শর্ত। অথচ তারা নিজেদের বাকি সবার নিয়ন্তা মনে করে। তাদের যেন কারওর কাছে কোনো জবাবদিহির দায় নেই। তাই মাঝেমধ্যে প্রশ্ন ওঠে, কীভাবে সংবাদমাধ্যমের দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত করা যায়, যাতে মানুষের অনুভূতি ও মানসিক অবস্থা বুঝে তারা কাজ করবে। প্রশ্ন আসে, তারা যে জবাবদিহি করবে, সেটাই তো স্পষ্ট নয়। কারণ, ক্ষমতায় ভারসাম্যের অভাব এত প্রবল যে দায়বদ্ধতার ধারণাকে প্রচলিত গণমাধ্যম ব্যবস্থায় সহজে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। কেননা, সংবাদমাধ্যমের প্রকাশক ছাড়া সাংবাদিকদের ইচ্ছামতো কোনো কিছু প্রকাশ করার ক্ষমতা আদৌ তাঁদের আইনি অধিকারের মধ্যে পড়ে কি না সন্দেহ। আইন মোতাবেক তাঁদের নিজেদের মালিকপক্ষ ছাড়া আর কারও কাছে কোনো আনুষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা নেই।
অথচ পত্রিকা সম্পাদনায় সম্পাদকের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত, ব্রাহ্মধর্মের নেতা ও তত্ত্ববোধিনী সভার প্রতিষ্ঠাতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার জন্য সম্পাদক নিয়োগ করেছিলেন অক্ষয়কুমার দত্তকে। কিন্তু মালিকের সঙ্গে সম্পাদকের বিরোধও ঐতিহাসিক। মালিক ব্রাহ্ম উপাসক হলেও সম্পাদক পুরোদস্তুর বস্তুবাদী এবং সমাজসংস্কারপন্থী। চিন্তার ফারাক সত্ত্বেও দেবেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন পত্রিকা পরিচালনায়।
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের পত্রিকাগুলো আক্ষরিক অর্থেই সমাজের সমসাময়িক নানা চিন্তায় দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটতো। পুরোনো চলতি ঘটনাগুলো ভেঙে আধুনিক ধারণা নিয়ে আসতে সম্পাদকেরা যেমন ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন, তেমনি কেউ কেউ রক্ষণশীল ভূমিকাও পালন করেছিলেন। কিন্তু সম্পাদকেরা মুখ্যত ছিলেন আদর্শচালিত, বাণিজ্যিক প্রলোভনচালিত নয়। এই বাস্তবতা সব সময় প্রাসঙ্গিক। আমরা প্রবাসীরা প্রত্যাশা করব, শুধু ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, প্রবাসের ১৫ থেকে ১৬টি নিয়মিত ও অনিয়মিত সাপ্তাহিকীর মিছিলে অগ্রসরমাণ নতুন কমিউনিটি গঠনে প্রথম আলো অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।